সুন্দরবনে বনবিবি পূজা ও মেলা

খুলনা, জাতীয়

মানজারুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, খুলনা, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 05:08:17

সুন্দরবনের কোল ঘেঁষা জনপদে অনুষ্ঠিত হলো ঐতিহ্যবাহী বনবিবি পূজা। প্রতি বছরের পহেলা মাঘে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল বনসংলগ্ন লোকালয়ে বনবিবি’র পূজা অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি উপাদান এ ‘মা বনবিবি’ পূজা। এ পূজায় প্রধান দেবতা হল ‘মা বনবিবি’। 'বনবিবি' দক্ষিণাঞ্চলের হাজারো সুন্দরবনজীবীর মনে ভক্তি, শ্রদ্ধা আর পূজার দেবী।

পঞ্জিকা অনুসারে, পহেলা মাঘ, বুধবার (১৬ জানুয়ারি) বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চলে বনবিবির পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পূজা হয়, খুলনার দাকোপ উপজেলার বাণীশান্তা ইউনিয়নের ঢাংমারী গ্রামে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, এ পূজায় বনবিবি, শাহ জঙ্গলি, ধনা, মনা, গাজী কালু, দুঃখে, দক্ষিণ রায়ের (সুন্দরবনের বাঘের মূর্তি) তৈরি করা হয়। গ্রামবাসীরা অস্থায়ী মণ্ডপ তৈরি করে এ পূজার আয়োজন করে। বেলা শুরু হলেই স্থাপিত মণ্ডপে শুরু হয় পুঁথি পাঠ। এর পর পূজার সাথে সাথে দেয়া হয় অঞ্জলি। মন্ত্রপাঠ, প্রসাদ বিতরণ ও মণ্ডপে মণ্ডপে শিরনি বিতরণ করা হয় এ পূজাকে উপলক্ষ করে।

ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মনোবাসনা পূর্ণ করতে মান্নত করেন। এছাড়াও দিনভর এ বনবিবি পূজা উপলক্ষে মুড়ি, মুড়কি, বাতাসা, মিষ্টি, ধুপ, ধুনো, খেলনা, চা বিস্কুট, শাখার দোকানসহ নানা ধরনের দোকান দিয়ে গ্রামীণ মেলা বসে সর্বত্র। হাজারো ভক্ত ও দর্শনার্থীর ভিড়ে মুখরিত গ্রামের মেঠোপথ। পূজা উপলক্ষে ভক্ত ও দর্শনার্থীরা সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ও নদীতে নৌ ভ্রমণে বের হন।

ঢাংমারির বাসিন্দা উৎপল রায় বার্তা২৪.কম কে বলেন, 'জন্মের পর থেকে আমরা মা বনবিবি’র পূজা করছি। এ পূজা করলে সুন্দরবনের ভয়ংকর বাঘ, কুমির, সাপসহ বিভিন্ন বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেন মা বনবিবি। বনের পাশের মানুষদের রক্ষা করেন বনবিবি। এ অঞ্চলে ১৮৯৬ সাল থেকে বনবিবির পূজা হয়।'

উল্লেখ্য, কথিত আছে বহু বছর আগে সুন্দরবনের পাশের এক গ্রামের এক দরিদ্র মায়ের সাথে তার শিশু থাকত। শিশু ছেলেটির নাম ছিল দুঃখে। একদিন দুঃখে সুন্দরবনে মধু আহরণ করতে যান ধনে আর মনে নামের দুই ব্যবসায়ীর সাথে। যাবার আগে দুঃখের মা তাকে বলে দেন, 'বনে আমার মতো তোর আরেক মা আছেন। কোনো বিপদে পড়লে তাকে ডাকবি।'

তখন সুন্দরবনে গাজী নামে এক আউলিয়া থাকতেন। আর দক্ষিণ রায় ছিল বাঘবেশী অপশক্তি। গাজীর সঙ্গে সখ্যতা ছিল দক্ষিণ রায়ের। এক রাতে দক্ষিণ রায় ব্যবসায়ী ধনে-মনের স্বপ্নে আসেন। দুই ভাইকে প্রচুর মধু আর সম্পদ দেওয়ার লোভ দেন দক্ষিণ রায়। এর ফলে শিশু দুঃখেকে উৎসর্গ করার প্রস্তাব দেন। অন্যথায় ধনে-মনের নৌকা ডুবে যাওয়া ও মধু না পাওয়ার ভয় দেখানো হয়। এরপর ধনে আর মনে ভয়ে দুঃখেকে উৎসর্গ করে তাকে পানি আনতে পাঠিয়ে নৌকা ছেড়ে লোকালয়ে ফিরে যান।

দুঃখে তার মায়ের কথামতো বনের মাকে স্মরণ করে। বনবিবি এসে দুঃখেকে বাঘরূপী দক্ষিণ রায়ের কবল থেকে উদ্ধার করেন এবং তাকে কুমিরের পিঠে ভাসিয়ে মায়ের কাছে ফেরত পাঠান।

এছাড়া বনবিবির ভাই শাহ জঙ্গলি বাঘরূপী দক্ষিণ রায় ও গাজী আউলিয়াকে ধরে বনবিবির কাছে নিয়ে যান। গাজী-দক্ষিণ রায়ের সঙ্গ ছেড়ে বনবিবির পক্ষ নেন। এভাবেই পরবর্তী সময়ে বনবিবি সুন্দরবনজীবী মানুষের কাছে দেবীর মর্যাদা পেয়ে পূজিত হতে শুরু করেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর