প্রতিবেশীকে ঘায়েল করতে ‘ছেলেকে অপহরণের’ মিথ্যা মামলা দায়ের করে নিজেই ফেঁসে গেলেন পাবনার চাটমোহর উপজেলার আটলংকা গ্রামের আতাউর রহমান ওরফে আক্তারের স্ত্রী হাছিনা খাতুন (৩০)।
বৃহস্পতিবার (২০ ডিসেম্বর) রাতে তাকে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শুক্রবার (২১ ডিসেম্বর) তাকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
চাটমোহর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শরিফুল ইসলাম জানান, আটলংকা গ্রামের হাছিনা খাতুন তার প্রতিবেশী মকবুল হোসেন, তার স্ত্রী শামসুন্নাহার ও ছেলে সুজনকে ফাঁসাতে অপহরণ মামলা করেছিলেন। সেই মামলা পুলিশ ও সিআইডি কর্তৃক তিনবার তদন্ত করার পর আদালতে উদ্দেশ্যমুলক মামলা হিসেবে মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
আর মিথ্যা মামলা করে হয়রানি করার কারণে হাছিনা খাতুনের বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে প্রসিকিউশন দাখিল করেন। যার প্রেক্ষিতে হাছিনা খাতুনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারী করেন আদালত। চাটমোহর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নাসির উদ্দিন সঙ্গী ফোর্সসহ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে নিজ বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করে। এরপর শুক্রবার তাকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
যেভাবে ফেঁসে গেলেন হাছিনা: ২০১৬ সালের ২ নভেম্বর রাতে ছেলেকে অপহরণের অভিযোগ এনে চাটমোহর থানায় মামলা দায়ের করেন চাটমোহর উপজেলার আটলংকা গ্রামের বাসিন্দা মালয়েশিয়া প্রবাসী আতাউর রহমান ওরফে আক্তারের স্ত্রী হাছিনা খাতুন। মামলা নং ০২। মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, ২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবর দুপুরে তার ছেলে জিয়াউর রহমান ওরফে জিয়া (১৩) কে বাড়ি থেকে অপহরণ করে অপহরণকারী চক্রের কাছে সোয়া দুই লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। মামলায় আসামী করা হয় জয়দেব নামের অজ্ঞাতনামা একজন আটলংকা গ্রামের মৃত নুরু মৌলভীর ছেলে মকবুল হোসেন (৬১), তার স্ত্রী শামসুন্নাহার (৫১) ও ছেলে সুজন হোসেন (৩১) কে। আর সাক্ষী করা হয় একই গ্রামের তিনজনকে।
মামলার প্রথমে তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন এসআই তৌরিদুল ইসলাম। তিনি তদন্তে মামলার বাদিনীর অভিযোগ সাক্ষ্য প্রমাণে মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পর ২০১৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট মিথ্যা নং-৪৩, ধারা ৩৪৩/৩৬৫/৩৮৫/৩৮৭ পেনাল কোড দাখিল করেন। এরপর বাদীনি হাছিনা খাতুনের নারাজি আবেদনের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞ আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন।
২০১৭ সালের ৫ মার্চ সিআইডির এসআই এএসএম আরিফুজ্জামান জিন্নাহর উপর তদন্তভার অর্পণ করা হয়। তিনি ১৫ মার্চ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুন:তদন্ত করে বাদীনি ও সাক্ষীদের ছাড়াও এলাকার নিরপেক্ষ মানুষের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। তিনিও তদন্তে মামলায় করা অভিযোগের কোনও সত্যতা না পাওয়ায় অভিযুক্ত আসামীদের মামলা থেকে অব্যাহতি ও বাদীনির বিরুদ্ধে দ: বি: ২১১ ধারায় প্রসিকিউশনের আবেদনসহ বিজ্ঞ আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট মিথ্যা হিসেবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর সাক্ষ্য স্মারকলিপি দাখিল করেন।
এরপর মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য তদন্তকারী অফিসার পরিবর্তন করে একই বছরের ১৯ জুন’১৭ সিআইডি জোন পাবনার সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার এএফএফ তারিক হোসেন খানের উপর দায়িত্ব অর্পণ করেন কর্তৃপক্ষ। তিনি ঘটনাস্থল সরেজমিনে পুন:পরিদর্শন করে মামলাটির বিস্তারিত তদন্ত করেন ও মামলার রহস্য উদঘাটনে গুপ্তচর নিয়োগ করেন। বাদী ও সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
সর্বশেষ তার তদন্তেও বাদীনির অপহরণের অভিযোগটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়। তিনিও আসামীদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতি এবং বাদীনির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আবেদন সহ চূড়ান্ত রিপোর্ট মিথ্যা হিসেবে দাখিল করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সাক্ষ্য স্মারকলিপি দাখিল করেন। এরপর সেখান থেকে ১৭ ডিসেম্বর’১৭ আদেশপ্রাপ্ত হয়ে ২৬ ডিসেম্বর’১৭ তারিখে চাটমোহর থানার ‘চূড়ান্ত রিপোর্ট’ মিথ্যা নং ৪৬ বিজ্ঞ আদালতে দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
ঘটনার পেছনের ঘটনা: তিনবারের তদন্তে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা এই মিথ্যা অপহরণ মামলার পেছনের ঘটনা উদঘাটন করতে সক্ষম হন। বেরিয়ে আসে এক নতুন কাহিনী। তদন্তে জানা যায়, বাদীনি ও বিবাদীদের বাড়ি একই এলাকায় এবং পাশাপাশি। বিবাদী শামসুন্নাহার (স্বামী মকবুল হোসেন) এনজিওতে চাকুরী করা অবস্থায় আটলংকা গ্রামে জমি কিনে বসতবাড়ি তৈরি করে বসবাস করে আসছিলেন।
আর্থিক সংকটের কারণে এবং ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ মেটাতে গিয়ে দেনাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। সেই ধারদেনা মেটানোর জন্য তিনি বাড়ি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন। আর সেই বাড়ি কেনার ইচ্ছা পোষণ করেন প্রতিবেশী প্রবাসী আতাউর ওরফে আক্তারের স্ত্রী হাছিনা খাতুন। এই বাড়ী কেনাবেচা নিয়েই দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
এরই এক পর্যায়ে মকবুল ও তার স্ত্রী-সন্তানকে এলাকা থেকে উৎখাতের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন হাছিনা খাতুন। সেই অকৌশলের অংশ হিসেবে তিনি তার ছেলেকে অপহরণের মিথ্যা নাটক সাজিয়ে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন। মকবুল ও তার পরিবারকে হয়রানী এবং অবৈধ লাভের আশায় হাছিনার ছেলে ভিকটিম জিয়াউর রহমান ওরফে জিয়া ৩১ অক্টোবর’২০১৬ তারিখ দুপুর ২টার দিকে নিজে নিজে আত্মগোপন করে এবং একই তারিখ রাত ৮টার দিকে নিজে নিজে উদ্ধার হয়ে তার মামার কাছে যায়।
পরবর্তীতে বাদীনি হাছিনা খাতুন ২ নভেম্বর’১৬ তারিখ রাত সাড়ে ৮টার দিকে চাটমোহর থানায় চারজনকে আসামী করে অপহরণ মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ তদন্ত ও সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে সাজানো অপহরণ মামলাটি আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় জেলে যেতে হলো হাছিনা খাতুনকে।
এ বিষয়ে বিবাদী মকবুল হোসেন ও তার ছেলে সুজন হোসেন জানান, মিথ্যা মামলা দায়ের করে হাছিনা খাতুন আমাদের মানসিক, পারিবারিক ও আর্থিক ক্ষতিসাধন করেছেন। সর্বোপরি আমাদের হয়রানী করেছেন। তার কারণে গ্রাম ছেড়ে চাটমোহরে গিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে। সত্যের জয় সবসময়। তাই তার ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। তার উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।