ফরিদপুরে বিজয়ের সাধ মেলে একদিন পরে

ঢাকা, জাতীয়

রেজাউল করিম বিপুল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-05 11:57:30

১৯৭১ এর ডিসেম্বর মাস। দেশের বিভিন্ন জেলায় তখন পাকিস্তানি মিলিটারিরা আত্মসমর্পণ করছে, শত্রু মুক্ত হচ্ছে দেশ। ফরিদপুরে তখনো নির্যাতন, হামলা, লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে পাক বাহিনী ও তার দোসররা।

১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক বিজয় অর্জনের ১ দিন পরে ১৭ ডিসেম্বর দুপুরে ফরিদপুর সার্কিট হাউজে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি মিলিটারিরা। সেদিন সকালেও পাকসেনা ও বিহারীদের সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধ করেছে ফরিদপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধা মো. শামসুদ্দিন মোল্যা ১৭ ডিসেম্বরের যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. মোকাররম হোসেন ও আবুল ফয়েজ শাহ নেওয়াজ এবং মুজিব বাহিনীর থানা কমান্ডার নীতি ভূষণ সাহার নেতৃত্বে আমরা ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান রাজবাড়ী জেলার সুলতান পুর ইউনিয়নের লক্ষণদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থান করেছিলাম। আমাদের ওপর দায়িত্ব ছিল মুক্তি ও মুজিব বাহিনীর যৌথ কমান্ডের নেতৃত্বে বিভিন্ন জায়গায় গেরিলা অপারেশন করা। দেশের অনেক জায়গা তখন শত্রুমুক্ত হলেও ফরিদপুর ছিল পাক হানাদারদের দখলে। যৌথ কমান্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফরিদপুর শহর আক্রমণ করার জন্য আবুল ফয়েজ শাহনেওয়াজের নেতৃত্বে ৩০-৪০ জনের একটি দল অম্বিকাপুর ইউনিয়নের ভাষানচরে অবস্থান নেয়।

হাবিলদার আবু তাহের দেওয়ানের নেতৃত্বে ১৪ জনের অপর একটি দলে আমরা চরমাধবদিয়া ইউনিয়নের আব্দুল মোল্লার বাড়িতে অবস্থান নেই।

আগের দিন ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও ফরিদপুরে থাকা হায়েনারা তখনো আত্মসমর্পণ করেনি।’

তিনি তার বর্ণনায় বলেন, ‘১৭ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় আমরা নাস্তা করছিলাম, এমন সময় ক্যাম্পে খবর এলো গোয়ালন্দ সশস্ত্র পাক বাহিনী পদ্মার পাড় দিয়ে ফরিদপুরের দিকে এগিয়ে আসছে।

আমাদের কমান্ডার আবু তাহের দেওয়ান দ্রুত পজিশন নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। আমরা পদ্মা থেকে উঠে আসা একটা নালার ভেতরে পজিশন নিলাম। পাক মিলিশিয়া ও বিহারীদের দলটি সামনে চলে আসল, আমরা গুলি চালালাম, ওরাও পাল্টা গুলি শুরু করে দিল।

এরই মধ্যে আমাদের কমান্ডার পাশের ফয়েজ ভাইয়ের ক্যাম্প ও খলিলপুরের যৌথ কমান্ডের ক্যাম্পে খবর পাঠিয়ে দেন। আমাদের কাছে অস্ত্র বলতে এলএমজি, এসএলআর, রাইফেল, স্টেনগান ও গ্রেনেড ছিল। ফায়ারিংয়ের এক পর্যায়ে আমরা বুঝতে পারি যে আমরা ওদের গুলির রেঞ্জের ভেতরে। তখন আমরা গুলি করতে করতে পিছু হটতে থাকি।

এ সময় আমাদের সহযোদ্ধা ইউনুস মোল্লার গুলি লাগে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন। খবর পেয়ে যৌথ বাহিনী ক্যাম্প থেকে নীতি ভূষণ সাহা, খান মাহাবুবে খোদা, আবুল ফয়েজ শাহনেওয়াজ এবং মেজবাউদ্দীন খান মিরাজের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এই যুদ্ধে অংশ নেয়।

অন্যদিকে খবর পেয়ে মানিকগঞ্জ থেকে ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিমের নেতৃত্বে লঞ্চে করে পদ্মা পার হয়ে বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে অংশ নিতে আসে।

এছাড়া আগরতলা মামলার ৫ নাম্বার আসামি ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সাব সেক্টর কমান্ডার নূর মোহাম্মদ ক্যাপ্টেন বাবুল তার টিম থেকে ২ ট্রাকে করে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠায় এই যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য। বেলা ২টার দিকে শেষ হয় এই যুদ্ধ । প্রায় শতাধিক মিলিশিয়া ও বিহারী মারা যায় এখানে।

কথা বলার এই পর্যায়ে শামসুদ্দিন মোল্যা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘যুদ্ধ শেষ, মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষত বিক্ষত চরাঞ্চল জুড়ে আনন্দে ফায়ারিং করছে। আর সেই সময় আমারা সহযোদ্ধা ইউনুস মোল্লার মরদেহ নিয়ে ৩৮ দাগ গ্রামে তার বাড়িতে যাই।’

মুক্তিযোদ্ধা মো. সাখাওয়াত হোসেন জানান, এই ১৭ ডিসেম্বরই মুক্তিযোদ্ধা শাহ মো. আবু জাফরের নেতৃত্বে ৩০-৩৫ জনের মুজিব বাহিনীর একটি টিম বিজয়ের খবর শুনে বোয়ালমারী থেকে ফরিদপুর আসার পথে মাঝকান্দি নামক জায়গায় কামারখালী থেকে আসা পাক আর্মির দুটি ট্রাকের সামনা সামনি হয়ে যায়। মুজিব বাহিনীর যোদ্ধারা কমান্ডারের নির্দেশে পজিশন নিয়ে ফায়ারিং শুরু করলে পাক আর্মির ট্রাক থেকে এক অফিসার হাত উঁচু করে নেমে এসে আত্মসমর্পণ করে। পরে মুজিব বাহিনীর যোদ্ধারা ওদের আটক করে ফরিদপুর সার্কিট হাউসে নিয়ে আসে।

আগরতলা মামলার ৫ নাম্বার আসামি ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সাব সেক্টর কমান্ডার নূর মোহাম্মদ ক্যাপ্টেন বাবুল পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের বিষয়ে বলেন, ‘ হেমায়েত বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে গোপালগঞ্জকে মুক্ত করে আমরা ফরিদপুর আক্রমণ করার জন্য ভাঙ্গায় এসে অবস্থান নেই। এরই মাঝে খরব আসে ঢাকাতে পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে, আমরা যুদ্ধে জয়ী হয়েছি। খবর পেয়ে আমি আমার দল নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই ফরিদপুরে ঢুকি।’

তিনি বলেন, ‘ফরিদপুরে ঢুকেই আমি পাকিস্তানি আর্মির কমান্ডার আরবান খানকে আত্মসমর্পণের জন্য বলি। আরবান খান আমার পাঠানো লোকের কাছে জানিয়ে দেয় সে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে না। তবে তিনি মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মিত্র বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার রাজেন্দ্র প্রসাদ নাথ ফরিদপুরে উপস্থিত হন। আরবান খান রাজেন্দ্র প্রসাদ নাথ ও আমার কাছে আত্মসমর্পণ করে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে বিজয়ের ১ দিন পরে ফরিদপুর জেলা শত্রুমুক্ত হয়। এখানে বিজয়ের সাধ মিলে একদিন পরে।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর