ভিক্ষাই সম্বল রাজশাহীর সেই ৪২ শহীদের পরিবারের

রাজশাহী, জাতীয়

ইলিয়াস আরাফাত, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 08:49:35

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার যুগীশো পালশা গ্রামে ৪২ জন হিন্দুধর্মালম্বীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। শহীদ হওয়া এসব হিন্দুধর্মালম্বীদের কপালে জোটেনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।

স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও এ ৪২ হিন্দুধর্মালম্বীর পরিবারের সদস্যদের খোঁজ নেয়নি কেউ। সরকার মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের ব্যাপারে আন্তরিক হলেও এখনো এই ৪২ শহীদের পরিবারের পাশে দাঁড়াননি কেউ। বর্তমানে শহীদদের পরিবারের সদস্যরা অনেকেই ভিক্ষা করে সংসার চালাচ্ছেন।

শহীদ বিভারণ চন্দ্র প্রামাণিকের স্ত্রী নিয়তী বালা জানান, তার স্বামীকে প্রকাশ্য দিবালোকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাক-হানাদার বাহিনী। স্বামীকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। সন্তানদের মুখে দুবেলা দুমুঠো ভাত তুলে দিতে তাকে নামতে হয় ভিক্ষা করতে।

এখনো এ গ্রাম থেকে সে গ্রামে ভিক্ষা করে বেড়ান নিয়তি বালা। শুধু নিয়তী বালা একা নন। তার সাথে ভিক্ষা করতে বের হন আরো ৩০ থেকে ৩৫ জন হিন্দু ধর্মালম্বী মহিলা। তাদের স্বামীকেও হত্যা করেছিল হানাদার বাহিনী।

শনিবার (১৫ ডিসেম্বর) দুপুরে কথা হয় নিয়তী বালার সাথে। সে সময়ের দুঃসহ ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কেঁদেই ফেলেন নিয়তী বালা। ভিক্ষা করতে যাবার কথা ভুলে গিয়ে মাটিতে বসে পড়েন। এ সময় তার সঙ্গে ভিক্ষা করতে বের হচ্ছিলেন একই গ্রামের আরও বেশ কয়েক জন শহীদের স্ত্রী।

ভিক্ষা করে জীবন চালান যুগীশু পালসা গ্রামের শহীদ শিতল দাসের স্ত্রী পঞ্চমী দাস (৭২), নগেন চন্দ্র দাসের স্ত্রী সুধাশু বালা (৭০), ঘেতন চন্দ্র দাসের স্ত্রী সুশীলা বালা (৭১), নিবারণ চন্দ্র দাসের স্ত্রী সুন্দরী দাস (৭০), শ্রীকান্ত দাসের স্ত্রী তরু বালা (৭২), যোগেন্দ্র নাথের স্ত্রী অনন্ত বালা (৬৯), যদুনাথ চন্দ্র দাসের স্ত্রী প্রমীলা দেবী (৬৬) ও নগেন্দ্র নাথ কর্মকারের স্ত্রী যমুনা বালাসহ প্রায় ৩৫ জন হিন্দু ধর্মালম্বী মহিলা।

নিয়তী বালা বাংলা ১৩৭৮ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর সে দিনের সে নির্মম হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘দিনটি ছিল রোববার। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে দুটি গাড়িতে পাক বাহিনী ঢুকে পড়ে গ্রামে। পাক বাহিনীর গাড়িতে সেদিন ছিল বখতিয়ারপুর গ্রামের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ সরকার। তার নির্দেশে গ্রামের ৪২ পুরুষকে ডেকে নেওয়া হয়।’

‘সেদিন ৯ বছর বয়সী ছেলেকে রেখে বিভারণ চন্দ্র কিছুতেই যেতে চাচ্ছিলেন না। ছেলেটাও বিভারণের লুঙ্গি টেনে ধরেছিলেন পেছন থেকে। এ দৃশ্য দেখে পাক বাহিনীর কয়েকজন সদস্য রেগে গিয়ে ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে বিভারণকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যান।’

‘তারপর সেই বাঁশ ঝাড়ের কাছে নিয়ে গিয়ে মাটির দিকে মুখ করে শুইয়ে দিয়ে বুট আর বেয়োনেট দিয়ে খুঁচাতে থাকে পাক বাহিনীর সদস্যরা। এরপর ব্রাশফায়ার করে ৪২ জনকেই হত্যা করা হয়।’

‘হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে পাক বাহিনী চলে গেলেও আব্দুল আজিজ সরকারের নেতৃত্বে সেদিন সমস্ত হিন্দুপল্লীতে আগুন ধরিয়ে লুটপাট চালানো হয়। সাথে কিছু চাল ডাল নিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে হিন্দুপল্লীর সদস্যরা সেদিন রাতের আঁধারে ভারত চলে যান।’

দেশ স্বাধীন হলে ফিরে এসে দেখেন বাড়িঘর সব খোলা মাঠ হয়ে গেছে। হাঁস-মুরগী, গরু ছাগল যা ছিলো সব লুটপাট করা হয়েছে। ফসলী জমিগুলো দখল হয়ে গেছে। তবু স্বাধীন দেশে বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টায় আজও ভিক্ষা করে বেঁচে আছেন।

শহীদ শিতল দাসের স্ত্রী পঞ্চমী দাস অভিযোগ করেন, তাদের স্বামীদের এভাবে হত্যা করা হলেও মেলেনি শহীদের স্বীকৃতি। এমনকি যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জীবনধারনের জন্য দেওয়া হয়নি সরকারি কোনো অনুদান। তাই জীবিকার তাগিদে ও পরিবারের সদস্যদের মুখে দুবেলা দুমুঠো ভাত তুলে দিতেই ভিক্ষা করছেন।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আন্তরিক না হওয়ায় ভাগ্যন্নোয়ন হয়নি বলে দাবি করেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। নির্বাচনের সময় তাদের প্রয়োজন পড়ে। তাদের ভাগ্যন্নোয়নে দেওয়া হয় নানা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি। কিন্তু নির্বাচনের পর আর দেখা মেলে না নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের। সংসার চালাতে ভিক্ষাবৃত্তিই একমাত্র অবলম্বন তাদের।

তবে শেষ বয়সে এসে আর ভিক্ষাবৃত্তি করতে চান না নিয়তী বালা কিংবা পঞ্চমী দাসরা। তাদের দাবি সরকার তাদের জন্য না হলেও তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হলেও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর