সমুদ্রে মৎস্য শিকারে আর লাইসেন্স দেবে না সরকার

, জাতীয়

তরিকুল ইসলাম সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-25 18:39:51

সমুদ্রগামী মৎস্য শিকারে উপযোগী জাহাজ নির্মাণ, আমদানি কিংবা শিকারের জন্য নতুন করে আর লাইসেন্স বা অনুমোদন দেবে না সরকার।

সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত (সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালা ২০২৩) বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে।

বিধিমালা অনুযায়ী, সমুদ্রে আহরণযোগ্য মৎস্য সম্পদের পরিমাণ নিরুপণ না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে আর কোনো নৌযান আসছে না। নতুন করে সমুদ্রে মৎস্য শিকার উপযোগী পরিমাণ নির্ধারণ সাপেক্ষে জাহাজের অনুমতি দেয়া হবে। এ জন্য জরিপ করাতে হবে। জরিপ শেষে প্রয়োজন হলে নতুন জাহাজের অনুমতি দেবে সরকার। তবে, নৌযান ডুবে গেলে বা দুর্ঘটনায় ব্যবহারের অনুপযোগী হলেই শুধু নতুন লাইসেন্স দেয়া হবে।

কাঠের ট্রলারের বিষয়ে বলা হয়েছে, নতুন করে কোনো কাঠের ট্রলারের নকশা, আমদানি করার সুযোগ নেই। তবে কোনো মালিক যদি কাঠের ট্রলারের লাইসেন্স জমা সাপেক্ষ স্টিলের জাহাজ নামাতে পারবেন। বাণিজ্যিক ট্রলার নিষিদ্ধকরণে বলা হয়েছে- বিধিমালা কার্যকরের ৫ বছর অতিবাহিত হলে তা বটম ট্রলিং থেকে মিড ওয়াটার ট্রলিং ট্রলারে রূপান্তর করা যাবে। তবে আগের লাইসেন্সটি জমা দিয়ে নতুন লাইসেন্স নিতে হবে।

চিংড়ি পোনা বা ব্রুড আহরণের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে- চিংড়ি পোনা বা ব্রুড আহরণে বাণিজ্যিক জাহাজকে বটম ট্রলিং করতে হলে জাহাজের বয়স কোনো ক্রমেই ১০ বছরের বেশি হবে না।

অবৈধ সম্পর্কে বলা হয়েছে, সরকারি অনুমতি ছাড়া মৎস্য শিকারে বা জলসীমায় প্রবেশ, সরকারি আইন ও বিধিমালায় উল্লেখিত নিয়মকানুন পরিপালনে ব্যর্থ হলে, একই অপরাধ বা জরিমানা বার বার (তিনবার) হলে সংশ্লিষ্ট নৌযান বাতিল বা অবৈধ হিসেবে গণ্য করা হবে।

আহরিত মৎস্য প্যাকেটজাত করার ক্ষেত্রে প্যাকেটের গায়ে জাহাজের নাম উল্লেখ করে ট্যাগ লাগানো প্যাকেটের ওজন সর্বোচ্চ ১৫ কেজি করা, বাস্কেটে প্যাকেট করা হলে তা বরফ ও মাছ সমানুপাতে করতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২৫ কেজি নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে রফতানিমুখী হলে বায়ারদের চাহিদা অনুযায়ী প্যাকিং করা যাবে বলেও বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

বিদেশি জাহাজের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশের সমুদ্রসীমায় মৎস্য শিকার করলে সেদেশের প্রতিনিধি বা অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের অফিস থাকতে হবে। যেখানে প্রয়োজনে যোগাযোগ করা ও মামলা মোকদ্দমার বিষয়টি পরিচালনা করা যাবে। জাহাজটি কখন কোথায় যাচ্ছে বা কি কি মাছ শিকার করছে বা কোন জায়গায় মাছ শিকার করছে তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরকারি প্রশাসনকে জানাতে হবে।

মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞায় বলা হয়েছে, প্রতিবছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত সমুদ্রে মাছ ধরা বা শিকার বন্ধ থকবে। তবে এটি সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সময় পরিবর্তন হতে পারে। সে সময়ে সকল মাছ ধরা বন্ধ থাকবে। তবে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার পর ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত ধৃত মাছ মজুদ ও সংরক্ষণ করা যাবে। এ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। ইলিশ মাছ ধরা বা জাটকা ধরা নিষেধাজ্ঞার সময়েও সমুদ্রে ইলিশ মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে। এ সময়ে মাছ ধরার জন্য কোনো জাহাজকে সমুদ্রে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে গবেষণা জাহাজ এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে থকবে। নিয়মানুযায়ী সরকার কর্তৃক জাটকা ২৫ সেন্টিমিটার নির্ধারণ করা হয়েছে। যেটি পরিবর্তনযোগ্য।

প্রত্যেক জাহাজকে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, প্রয়োজনীয় (জীবন রক্ষাসহ) যন্ত্রপাতি ও উপকরণ, অনুমতিপত্র, লাইসেন্স, রেডিও, পরিচয়পত্র, জাহাজে সংরক্ষণ করতে হবে। শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। জাহাজের মাস্টার ব্রিজের বাইরে দৃশ্যমান নাম লিখতে হবে। যাতে দূর থেকে বোঝ যায়। এ ছাড়াও, বাংলাদেশের জলসীমায় গ্রেফতার বা আটক প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, জলীমায় অবৈধভাবে কাউকে আটক করা হলে গ্রেফতারকৃতদের বিষয়ে তথ্য বেতার বা ইমেইলে সংশ্লিষ্টদের জানাতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। বিদেশিদের ক্ষেত্রেও আটককৃতদের সকল তথ্য স্থানীয় প্রশাসনকে বিস্তারিত জানাতে হবে। প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করবে।

এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খ. মাহবুবুল হক বলেন, সমুদ্র মৎস্য গবেষণা জাহাজ আরভি মিন অনুসন্ধানী এবং গবেষণা ইউনিটকে কাজে লাগিয়ে আমরা গবেষণার কাজ করছি। আমরা চাই পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে অন্যান্য দেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে। আমাদের দেশে উপকূলীয় এলাকার অনেক মানুষ রয়েছেন যাদের প্রধান জীবিকা হচ্ছে মৎস্য শিকার। রয়েছে হজার হাজার ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও আর্টিসান বোট। এগুলো নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পরিকল্পিত মৎস্য আহরণ জেলেদের জীবন মান উন্নয়নে সহায়ক হবে সরকারের এ উদ্যোগ।

তিনি আরো বলেন, সামুদ্রিক একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ইইজেড) মৎস্য জরিপ পরিচালনার মাধ্যমে চিংড়ি, তলদেশীয় এবং ভাসমান প্রজাতির মৎস্যের মজুদ নিরূপণ, আহরণ, মৎস্য মজুদ, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য কর্মপরিকল্পনা তৈরির কাজ চলছে। বর্তমানে উপকূলীয় এলাকায় সামুদ্রিক মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ৩৪টি থেকে ৬৫টিতে উন্নীত করা হয়েছে। তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে, কোথায় কোন মাছ পাওয়া যচ্ছে, কী পরিমাণ আসছে সব তথ্য পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অধিকাংশ সামুদ্রিক মৎস্য অগভীর সমুদ্র ও উপকূলীয় এলাকায় আহরণ করা হয়ে থাকে। জাহাজের সক্ষমতা ও যথাযথ ফিশিং প্রযুক্তির অভাবে গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণ কার্যক্রম কার্যকরভাবে পরিচালনা করা হয় না। বর্তমানে আমাদের মৎস্য আহরণ উপকূল থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরত্বে সীমাবদ্ধ। সুনীল অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। বর্তমানে বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্য খাতের অবদান ছিল মাত্র ১৫-২০ শতাংশ (০.৬৫৯ -৭০০মিলিয়ন মে. টন মৎস্য) এ কাজে ২৫৫টি বাণিজ্যিক ট্রলার এবং ৬৭ হাজার ৬৬৯টি আর্টিসানাল নৌযান (এর মধ্যে যান্ত্রিক ৩২ হাজার ৮৫৯টি এবং অযান্ত্রিক ৩৪ হাজার ৮১০টি মৎস্য নৌযান) মৎস্য আহরণে ব্যবহৃত হয়। তবে এ মাছের সিংহভাগই আসে আর্টিসানাল থেকে।

সূত্র আরো জানায়, দেশের অধিকাংশ মাছ ধরা ট্রলার চলাচল বা মাছ ধরে ৪০ মিটার গভিরতার মধ্যে। শুধুমাত্র বাণিজ্যিক ফিশিং বোট ৪০-১০০ মিটার পানির গভীরে চলাচল করে। এগুলো সাধারনত বাগদা চিংড়ি এবং ফিন ফিশ আহরণে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রপার ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ইলিশ মাছ। বর্তমানে বিশ্বের ৫০-৬০ শতাংশ ইলিশ মাছ বাংলাদেশের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক জলরাশিতে, ২০-২৫ শতাংশ মিয়ানমারে, ১৫-২০শতাংশ ভারতে এবং অবশিষ্ট ৫-১০ শতাংশ অন্যান্য দেশে আহরিত হয়। এখনও পর্যন্ত দেশে মৎস্য আহরণ সনাতন কৌশল ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বিশেষ করে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে পুরনো কৌশল ব্যবহার হতে বের হয়ে আসতে হবে এবং সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যমান মৎস্য আহরণ ক্ষেত্রের বাইরে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত গভীর একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ গভীর সমুদ্র থেকে বিশালাকার পেলাজিক মৎস্য আহরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই নতুন নতুন মৎস্য ক্ষেত্র অনুসন্ধানের লক্ষ্যে বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক মৎস্যের স্টক/মজুদ নির্ণয়ের জন্য জরিপ সম্পাদন করতে হবে। ২০১৮ সালে আরভি মিন সন্ধানি নামক জাহাজ বঙ্গোপসাগরে একটি মৎস্য জরিপ ও মৎস্য ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত প্রাথমিক গবেষণা করেছে। তবে সুনীল অর্থনীতির পুরোপুরি সুফল পেতে আরো বেশি পরিমাণে এ ধরনের জরিপ সম্পাদন প্রয়োজন।

মৎস্য অধিদপ্তরের (সামুদ্রিক শাখা) উপপ্রধান কর্মকর্তা ড. মুহাম্মদ তানভীর হোসেন চৌধুরী বলেন, সমুদ্র সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্যই সরকার এ বিধিমালা জারি করেছে। দেশের সমুদ্র সম্পদের উন্নয়নে গুরুত্ব অনুযায়ী প্রয়োজনীয় বিধির প্রচলন করা যাবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর