কিশোরগঞ্জের মেধাপুত্র শাহ্ আজিজুল হক

, জাতীয়

শাহ্ ইস্কান্দর আলী স্বপন, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | 2023-09-01 12:23:07

কিশোরগঞ্জ উত্তরাঞ্চলের অকৃত্রিম মেধাপুত্র শাহ্ আজিজুল হক। মল্লিকপুর ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে তিনি আমার জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী ছিলেন। শৈশবেই তিনি প্রকৃতিকে পাঠশালার সাথে সমন্বয় করে তার শিক্ষাঙ্গন বিস্তৃত করেন, ঝাঁকড়া চুলে দাপিয়ে বেড়ান কৈশোর-যৌবন। গাছে চড়া পাখি ধরা বল্টু খেলা থেকে যাত্রা পালা কি নেই তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে, সমাজনীতি রাজনীতি সবকিছুতেই তিনি হয়ে উঠেন মফস্বল শহর কিশোরগঞ্জের মেধা মননের উর্বর ভূমির অকৃত্রিম পরিচর্যাকারী। আইন বিচার অঙ্গনে তার মেধার প্রভাব আলোকিত করেছিলো প্রতিষ্ঠানটিকে। তিনি ৬ বার কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। জীবদ্দশায় তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন, কিশোরগঞ্জের সমাজ- সংস্কৃতি- ইতিহাস বিষয়ক সমীক্ষাধর্মী মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা লাভ করে।

পেশাগত কারণে ঢাকা ও দেশের বাইরে অবস্থান করায় বেশ কয়েক যুগ শাহ্ আজিজুল হক’র সাথে আমার দেখা হয়নি। ক’বছর আগে হঠাৎ একদিন তার সাথে দেখা করতে শহরের উকিল পাড়ায় তার নয়নাভিরাম বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠি। আমাকে দেখা মাত্রই তিনি সতীর্থের আবেগে জড়িয়ে ধরেন। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি পাশের কিচেন থেকে এক কাপ চা এনে নিজ হাতে এগিয়ে ধরে বলেন, ‘এই নাও দারুচিনি- এলাচ চা, আমিই বানিয়েছি।’

আমার যে চা’য়ে অভ্যেস নেই!

তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ এক বিশেষ চা খেয়ে দেখো হে। মুহূর্তে মনে পড়লো আমার ব্যবসা শুরুর অর্বাচীন সময়, তখন ১৯৯১ সাল। গুলশানে অবস্থিত চায়না এম্বাসিতে নাংচাং প্রভিন্সের জিয়াংসু টেক্সটাইল কর্মকর্তাদের সাথে তাদের উৎপাদিত ইয়ার্ন ও ফেব্রিক সম্পর্কিত মিটিং করতে গিয়েছিলাম। তাদের আপ্যায়ন চা পানে অনীহা প্রকাশ করায়, তারা ভেবে নিয়েছিলেন যে আমাদের প্রতিষ্ঠান বুঝি তাদের সাথে ব্যবসায় সম্মত নয়।

পরদিন চায়না এম্বাসির বিজনেস এটাচি মিস্টার ওয়াই.এইচ.লি অবাক করে দিয়ে আমার মতিঝিল অফিসে এসে হাজির। আমার পার্টনার কোম্পানি চেয়ারম্যান এ.আর. খান’ র কাছে মিস্টার লি জানতে চান, জিয়াংসু টেক্সটাইল’র সাথে আমাদের ব্যবসায় অনীহার কারণগুলো কি কি? প্রসঙ্গত চীন দেশের মানুষ মিটিং এ কেউ যদি তাদের আপ্যায়ন গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেন তবে তারা মনে করেন যে প্রতিপক্ষ তাদের সাথে কাজ করতে সম্মত নন। কিশোরগঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার বহুকাল পর কিশোরগঞ্জের ক্ষণজন্মা এ ব্যক্তির বিশ্বজনীন সৌজন্যতা ও তার প্রজ্ঞাময় চোখে তাকিয়ে ক্ষণিকেই মুগ্ধ হলাম।

হতবাক হলাম কিশোরগঞ্জ নিউজ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তার অনবদ্য বক্তৃতায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি ও পাবলিক লাইব্রেরি’র মঞ্চে বিখ্যাত বাগ্মীদের বক্তৃতা কৌশল যেন নিমেষেই সমর্পিত হলো তার কণ্ঠের মাধুর্য ও বাক্য প্রয়োগের অসাধারণ কলা বিদ্যায়।
নিমেষেই আমার উপলব্ধি হলো, কেন তার এ মেধাকণ্ঠ উচ্চারিত হচ্ছে না রাজধানীর বিখ্যাত বক্তৃতা মঞ্চ গুলোয় বা দেশের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ফরাসি দার্শনিক দর্শন শাস্ত্রের জনক রেনে দেকার্ত তার কুঁড়ে ঘরের সিলিং এ নিরালায় বসে গভীর ধ্যানে নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন। আর কিশোরগঞ্জের মেধাপুত্র শাহ্ আজিজুল হক তার নিজ ভূমি কিশোরগঞ্জের মানুষ আর প্রকৃতিকে অবলম্বন করে তার সহজাত মেধা দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অতি সহজেই অতিক্রম করেন জীবন দর্শনের সকল স্তর অবলীলায়।

তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতো শ্রেণিকক্ষে অংশগ্রহণ না করে কৃতিত্বের সাথে অর্জন করেছিলেন উচ্চশিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক সব মেধা সনদ। তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দিয়ে তিনি নজর কাড়েন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানধারী ব্যাক্তিত্বের।তার সহজাত প্রবণতায় তিনি মানুষ ও প্রকৃতিকে জানতে গিয়ে স্বতঃসিদ্ধভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন মেধা ও সৃজনশীলতার এক অনন্য উচ্চতায়। এ জন্যই শাহ্ আজিজুল হক প্রায়শই তার বক্তৃতায় বলতেন প্রকৃতিই তার পাঠশালা।

কোভিড-১৯ পরিস্থতিতে কিশোরগঞ্জ থাকাকালীন সময়ে কিশোরগঞ্জ নিউজ-এ প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে আমার একটি লেখা “আমার গেরিলাবেলা” পড়ে একদিন তিনি আমায় ফোন করলেন।

পত্রিকায় প্রকাশিত আমার লেখাটির কয়েক লাইন, “আমি শুস্ক মলিন চেহারার এ কিশোর মুক্তিযোদ্ধার দিকে তাকালাম, মুহূর্তেই যেন তার চোখে-মুখে কৈশোর ঝলমল করে উঠলো, একহাতে চাইনিজ রাইফেল আরেক হাতে আমার হাত ধরে দুজন দৌড়ে পাট ক্ষেতের আলে গিয়ে বসলাম। তিনি পেট্রিটা ছোট করে তার রাইফেলটি আমার কাঁধে ঝুলিয়ে দিলেন। আমি শরীরে এক অন্যরকম উত্তাপ অনুভব করলাম। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে কানে ভেসে এলো বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ, "এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তিনি তার কণ্ঠে উচ্চারণ করেন। ফোনে কথাবলার অগ্রভাগে আমার লেখা থেকে পাঠ ও তার কণ্ঠস্বর আমাকে উৎসাহ যোগালো। বললাম, ভাই শৈশবের অভিজ্ঞতা লিখেছি। তিনি ছোট করে বললেন, ‘তুমিই লিখবে।’

আজ এডভোকেট শাহ্ আজিজুল হক’র ১ম মৃত্যুবার্ষিকী।আমার এ লেখা তার বিদেহী আত্মার প্রতি বিনয়ী শ্রদ্ধার্ঘ্য।

এ সম্পর্কিত আরও খবর