একাত্তরের নৃশংসতা ঘুমাতে দেয় না অঞ্জু রায়কে

, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজবাড়ী | 2023-09-01 21:46:16

অঞ্জু রায় (৭২), একজন নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা । তার বাড়ি রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। ১৯৭১ সালে শরণার্থী ক্যাম্পে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়েছেন তিনি।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের হানাদারবাহিনীর ভয়াবহ নৃশংসতা এবং বাংলার মুক্তিকামী মানুষের স্বদেশ প্রেমের কথা এখনো মনে পড়ে তার। পাকিস্তানিদের বর্বরতার কথা মনে পড়লে তিনি এখনো ঘুমাতে পারেন না বলে জানান। সেদিনের সেই ভয়াল রাত্রিগুলো তাকে এখনো তাড়া করে ফেরে।

বার্তা২৪.কমের এই প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয় অঞ্জু রায়ের। একান্ত সাক্ষাৎকারে গল্প শোনান তিনি সেই দুর্বিষহ দিনের কথা। সেদিনের সেই ভয়াবহতার বর্ণনা দিতে গিয়ে অঝরে কেঁদে ফেলেন তিনি। স্মরণ করেন স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে।

মুক্তিযোদ্ধা সনদ

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অঞ্জু রায় বলেন, দেশে যখন যুদ্ধ বাঁধে তখন আমি কুষ্টিয়া গার্লস কলেজের একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হলে আমি বাবার বাড়ি ইসলামপুর ইউনিয়নের ঠাকুর নওপাড়া গ্রামে চলে আসি। তারপরের ইতিহাস অনেক কষ্টের ইতিহাস।

নিজ জন্মভূমি ছেড়ে ১৯৭১ সালে সম্ভবত এপ্রিলের মাঝামাঝি আমরা সপরিবারে দেশ ত্যাগ করে পাড়ি জমায় ভারতে। আশ্রয় মেলে কল্যানীর ৬নং ক্যাম্পে। বাবা মৃত কুঞ্জ বিহারী রায় ছিলেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। আমরা যে ক্যাম্পে আশ্রিত ছিলেন সেই ক্যাম্পে বাবা অসুস্থ শরণার্থী ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা প্রদান করতে থাকেন। বাবার সঙ্গে আমিও নার্সিংয়ের কাজ করতে থাকি।

একদিন কলকাতার বনগাঁ থেকে আমাদের ক্যাম্পে আসেন ডাক্তার ননী গোপাল সাহা। তিনি ক্যাম্পে এসে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সুচিকিৎসা ও সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে ম্যাট্রিক পাস মেয়ে খুঁজতে থাকেন। ওই ক্যাম্পে আমিই একমাত্র মেয়ে ছিলাম যে কিনা বিজ্ঞানে ম্যাট্রিক পাস। প্রথম দিকে আমি একটু সংশয়ে ছিলাম। বিষয়টি মা শিশু বালা রায় ও বাবা বুঝতে পেরে তারা আমাকে বলেন- আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। তুমি সামনে না আগালে আমরা পিছিয়ে পড়ব। এ কথার পর আর বসে থাকিনি। ডা. ননী গোপাল সাহার সঙ্গে চলে আসি এক কাপড়ে। তারপর ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে কাঁধে নেই দুটি হাসপাতালের দায়িত্ব।

বীর মুক্তিযোদ্ধা অঞ্জু রায়

আমার সেবার আন্তরিকতা দেখে আমাকে টিম লিডার করে দেন। আমার নিয়ন্ত্রণে ৭ জন স্বেচ্ছাসেবক নার্স ছিলেন। আমাদের টিম দিনরাত ২৪ ঘণ্টা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সুস্থ করতে কাজ করেছে। বালিয়াকান্দির সাধুখালী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা সুকুমারকেও আমি চিকিৎসা দিয়েছি। তিনি গুলিবিদ্ধ ছিলেন। এখনো তিনি বেঁচে আছেন।

দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে আমরা আবার সপরিবারে দেশে ফিরে আসি। স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রাখার কি অনুভূতি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। তবে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ দেখে কেঁদে ছিলাম। কি বর্বরতায় না চালিয়েছিল পাকিস্তানি দোসররা। একাত্তরের ভয়াবহতার কথা মনে পড়লে আজও ঘুমাতে পারি না।

আবেগজড়িত কণ্ঠে অঞ্জু রায় বার্তা২৪.কম-কে বলেন, যেদিন দেশ শত্রুমুক্ত হলো সেদিন প্রতিটি শরণার্থী ক্যাম্পে কি আনন্দ। সবাই উচ্ছ্বসিত। সবার কণ্ঠেই একই স্লোগান ‘জয় বাংলা’। সবাই মন খুলে গাইতে থাকে দেশের গান।

স্বাধীন দেশে এখন কেমন আছেন- এমন প্রশ্ন করলে তার জবাবে অঞ্জু রায় বার্তা২৪.কম-কে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের আত্মত্যাগের এই রক্তস্নাত সোনার বাংলায় আজও শকুনের থাবা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে সোনার বাংলা গড়তে নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছেন তা নিঃসন্দেহে আরেকটি এযুগের মুক্তিযুদ্ধ। যতদিন শেখ হাসিনা থাকবেন ততদিন আমরা মুক্তিযোদ্ধারা ভালো থাকব। ততদিন দেশ ভালো থাকবে, দেশের মানুষ ভালো থাকবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর