প্রাণিজ পুষ্টি চাহিদা পূরণে আধুনিক খামার ও কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থাপনা জরুরি

, জাতীয়

তরিকুল ইসলাম সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-09-01 20:13:01

প্রান্তিক পর্যায়ে ছোট বড় প্রায় ১৩.৬৭ লাখের বেশি খামার প্রতিষ্ঠা হওয়ায় দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে প্রাণিজ সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে খামার বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত রাখতে খামারের ব্যবস্থাপনা, খামারিদের সহায়তা, উৎপাদিত পণ্যের যথাযথ বাজারজাতকরণ ও বাজার সম্প্রসারণ, পণ্যের গুণগতমাণ নিয়ন্ত্রণসহ নানা চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। এ চ্যলেঞ্জ মোকাবিলায় আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনা ও কৃত্রিম প্রজননে নজর দেয়া আবশ্যক বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

বিশ্বায়নের যুগে শুধু পুষ্টি চাহিদা পূরণ নয়, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে দেশের প্রান্তিক খামারিদের কাজ করছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ সংস্থা প্রাণিসম্পদ অধিদফতর এবং বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনষ্টিসিটিউট (বিএলআরআই)। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রাণিসম্পদ অধিদফতর দেশের ৬১ জেলায় প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন (এলডিডিপি) প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যমতে, দশ বছরে দেশে খামার বেড়েছে ১০.২ লাখ, যেখানে ২০১০-১১ অর্থবছরে ছিল ৩.৪৭ লাখ। এ সময়ে গরুর খামার বেড়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার ৪৪০, আগে ছিল ৭৯ হাজার ৮৫০। ছাগল ভেড়ার খামার বেড়ে হয়েছে ৭ লাখ ৯৪ হাজার ৬৩০। আগে ছিল ৭৮ হাজার ৫৭০, পোলট্রি বেড়েছে ১ লাখ ৬০০, আগে ছিল ১ লাখ ৪ হাজার ৫০০। বেড়েছে ফিড মিল, মিট ও মিল্ক প্রসেসিং প্লান্ট। এই মুহূর্তে দেশে রেজিস্টার্ড গবাদি পশুর খামার ৭৮ হাজার ৬৮৪টি এবং পোলট্রি খামার হচ্ছে ৮৬ হাজার ৫৪১। কর্মসংস্থান ৫৪ লাখ ২০ হাজার মানুষের।

প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রব্বানী বার্তা২৪.কম-কে বলেন, দেশের ৬১ জেলার ৪৬৬ উপজেলায় খামার, খামারি এবং পশুভিত্তিক ৫৫০০ প্রোডিউসার গ্রুপ (পিজি) গঠন করা হয়েছে। পিজিতে ১.৯০ লাখ খামারিকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তালিকাভুক্তদের জন্য থাকবে ফিল্ড স্কুল। যেখানে খামারিদের খামার আধুনিকায়ন, দক্ষতা উন্নয়ন, নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় করানো, উৎপাদিত দুধ, মাংস ও ডিমের হাইজিন নিশ্চিত করা, দুধ ও মাংসের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং খামারে উৎপাদিত পণ্যের বিপণন ব্যবস্থাপনার উপরে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দেয়া হবে।

ড. রব্বানী বলেন, যারা নিবন্ধিত নয় তাদের ডেমো টাইপের (প্রদর্শনী প্লট, আধুনিক গবাদি পশুর খামার, জলবায়ু সহিষ্ণু খামার, শেড তৈরি ইত্যাদি) তৈরি করে উদ্বুদ্ধ করা হবে।

কৃত্রিম প্রজনন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এলডিপিপি দেশের ৯ জেলায় কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের অফিস নির্মাণ ও দুটি অফিস সংস্কার করে দিচ্ছে। এছাড়াও ঢাকায় সাভারে সরকারি খামারে ৪৮টি শতভাগ ফ্রিজিয়ান বকনা দেওয়া হয়েছে। বাকি ৬টিতে ৩০টি করে লোকাল ক্রস ব্রিড দেওয়া হয়েছে। কৃত্রিম প্রজনন বা জাত উন্নয়নে ৫০ হাজার গাভীর ডাটাবেইজও তৈরি করা হবে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে প্রাণিসম্পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত। প্রাণিসম্পদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সরকার যান্ত্রিকীকরণ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আধুনিক খামার গড়ে তোলা ও কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের উদ্যোগের ফলে খামার ও ব্যক্তি পর্যায়ে অধিক দুধ ও মাংস উৎপাদনশীল জাতের গবাদিপশু পালন বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মানসম্মত প্রাণিজ আমিষ সরবরাহ বাড়ছে। যা মানুষের পুষ্টি ও আমিষের যোগানে বড় ভূমিকা রাখছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, পোলট্রি খামারসহ ডিম ও বাচ্চা উৎপাদন হ্যাচারি স্থাপনরে ফলে প্রতিবছর বাড়ছে মাংস, দুধ ও ডিম উৎপাদন। ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে দুধের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ৫০ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন, মাংস ৩৬ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন এবং ডিমের উৎপাদন ছিল ৭৫১ কোটি ৭৪ লাখ। ২০২১-২২ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে দুধ উৎপাদন ১৩০.৭৪ লাখ মেট্রিক টন, মাংস ৯২.৬৫ লাখ মেট্রিক টন এবং ডিমের উৎপাদন ২৩৩৫.৩৫ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। দশ বছরের ব্যবধানে দুধের উৎপাদন বেড়েছে ৮০.০৪ লাখ মে. টন। মাংসের উৎপাদন বেড়েছে ৫৬.৪৫ লাখ মে. টন। একই সময়ে ডিমের উৎপাদন বেড়েছে ১৫৭.৩৬ কোটি পিস।

বর্তমানে দেশে মোট মাংসের উৎপাদন ৯২.৬৪ লাখ মে. টন। এর মধ্যে গরুর মাংস ৪৭.৭০ লাখ মে, টন, পোলট্রির মাংস ৩৮.৪৪ মে.টন, মহিষ ১.৬৯ লাখ মে. টন, ছাগল ৪.৩১ লাখ মে. টন,ভেড়া ০.৩০ লাখ মে.টন এবং অন্যান্য (উট, দুম্বা) ০.২০ লাখ মে. টন।

জাতীয় পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক এবং অধ্যাপক ড. খুরশিদ জাহান বলেন, আমাদের পুষ্টি চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ পূরণ করতে পারি এই খাত থেকে। কৃষি বেইজড পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে ৭০ শতাংশ। আমাদের শরীর প্রাণিজ প্রোটিন যতটা দ্রুত গ্রহণ করতে পারে, কৃষিজ তেমনটা পারে না। আমাদের শরীরে অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি হিম আয়রন প্রাণিজ থেকেই পাওয়া যায়। আমরা সিরিয়াল ফুডের দিকে ঝুঁকে পরেছি। ফলে অনেক পুষ্টি অনু আমাদের শরীরে অনুপস্থিত থেকে যাচ্ছে। তাই খাদ্যাভাসে ফুড ডাইভার্সিটি প্রয়োজন। পাশাপাশি একটি পুষ্টিহীন জাতি গঠনে দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি স্কুল গুলোতে দুপুরে পুষ্টিকর খাবার পরিবেশনসহ দেশে সরকারের নেওয়া দরিদ্র ও অতি দরিদ্রবান্ধব কর্মসূচিতে সরকারকে সাবসিডি দিয়ে প্রাণিজ আমিষ বিতরণ করতে হবে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পশুপুষ্টি) বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল মামুন বলেন, প্রাণিসম্পদের মাধ্যমে পুষ্টি চাহিদা পূরণের গতি বাড়ছে। আমাদের দেশের এখন যে গবাদি পশু রয়েছে তার ৩৫ ভাগই হচ্ছে ক্রস ব্রিড বা উন্নত জাতের। এতে করে গ্রামাঞ্চলের মানুষও কম বেশি দুধ ও মাংস গ্রহণ করতে পারছে। একজন বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ৫০-৫০ গ্রাম প্রোটিন দরকার হয়। দুটি ডিম খেলেও তা পূরণ করা সম্ভব। তবে দেখা যাচ্ছে প্রয়োজনীয় প্রোটিনের দুই তৃতীয়াংশ আসে প্রাণিজ সম্পদ থেকে।

পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন মানুষের দৈহিক ওজনের (প্রতি কেজির) জন্য ৮ গ্রাম প্রোটিন দরকার। গরুর মাংস বাড়ন্ত শিশুদের শক্তিশালী, বুদ্ধিবৃত্তিক গঠন, রক্ত বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে। প্রতি ৮৫ গ্রাম গরুর মাংসে আছে ৯-১৩ বছর বয়সী শিশুর দৈনিক চাহিদার ১২৫ শতাংশ ভিটামিন বি, ১২, ৯০ শতাংশ প্রোটিন, ৭৪ শতাংশ জিংক, ৪২ শতাংশ সেলেনিয়াম, ৩২ শতাংশ ভিটামিন বি৬, ৩২ শতাংশ আয়রন, ২৯ শতাংশ নায়াসিন, ২৩ শতাংশ রিবোফ্লাভিন এবং ১৬ শতাংশ ফসফরাস রয়েছে।

গরুর চেয়ে মহিষের মাংস পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। গরুর মাংসে চর্বির পরিমাণ ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হলেও মহিষের মাংসে মাত্র ২ শতাংশ। মহিষের মাংসে গরুর চেয়ে ৪০ শতাংশ কোলেস্টেরল কম, ১১ শতাংশ আমিষ বেশি ও ১০ শতাংশ বেশি মিনারেল রয়েছে। এই মাংসে ভিটামিন বি-১২ এর পরিমাণ অনেক বেশি যা শিশুর দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে সহায়ক। আয়রন পরিমাণ বেশি থাকায় গর্ভকালীন মায়েদের আয়রনের ঘাটতিসহ হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।

পোলট্রি মাংস মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণের অন্যতম উৎস। ব্রয়লার মুরগির মাংসে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন থাকে। এই প্রোটিন শরীরের হাড় ক্ষয় রোধ, ওজন হ্রাস, বিষন্নতা রোধ, হেমোকিস্টাইনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ, হার্টের বিভিন্ন ধরনের কার্ডিও ভাস্কুলার রোগ প্রতিরোধ, ফসফরাসসমৃদ্ধ হওয়ায় কিডনি, লিভার, স্নায়ুতন্ত্র নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে। শরীরে হজম প্রক্রিয়া সহজ করতে ভিটামিন বি-৬-এর ভূমিকা অতুলনীয়। তাছাড়া এই মাংসে নিয়াসিন নামক একটি ভিটামিন থাকে যা শরীরকে ক্যানসারমুক্ত রাখে।

ডিমকে বলা হয় পাওয়ার অব নিউট্রিশন। ডিমের প্রোটিন মাংসপেশী গঠন, ভিটামিন ডি রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ, হাড় ও দাঁত শক্ত রাখে। ভিটামিন এ রাতকানা রোগের ঝুঁকি কমায় এবং ত্বক ও চুলের জন্য অত্যন্ত উপকারী। ডিমের কলিন গর্ভাবস্থায় শিশুর মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবে কাজ করে।

সর্বোচ্চ পুষ্টিমানের জন্যই দুধের শ্রেষ্ঠত্ব। দুধের অপরিহার্য উপাদান ল্যাকটোজ, যা দৈহিক গঠন, বিকাশ ও মেধা বৃদ্ধিতে সহায়ক। মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষার মূল উপাদান দুধ। বাংলাদেশের জনগণের একটি বৃহৎ অংশ তরল দুধ পান থেকে বঞ্চিত। গরুর দুধে আছে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, খনিজ পদার্থ যেমন ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, কোবাল্ট, কপার, জিংক, আয়োডিন ও সেলিনিয়াম। গরুর দুধের কম্পজিশনে পানি ৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ, ল্যাকটোজ ৪ দশমিক ৮ শতাংশ, ফ্যাট ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, প্রোটিন ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) হিসাবে ২০৩০ সালে এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যাবে। ২০৫০ সাল নাগাদ ডিমের চাহিদা বাড়বে ৯০ শতাংশ এবং মাংসের চাহিদা বাড়বে ১৭০ শতাংশ।

বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন বলেন, গরুর সংখ্যা বৃদ্ধি না করে পারকেপিটা উৎপাদন বৃদ্ধির চিন্তা করতে হবে। এজন্য জাত উন্নয়নের বিকল্প নেই। দেশি গরু থেকে ১০০- ১৫০ কেজি মাংস পাই। এর পরিমাণ ৩-৪শ কেজিতে নিয়ে যেতে হবে। উন্নত জাতের বীজ সংগ্রহ করে ক্রস ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে জাত উন্নত করতে হবে। দুধের উৎপাদন ৮-১০ লিটারে উন্নিত করার চিন্তা করতে হবে। মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ বড় সমস্যা। সনাতন পদ্ধতির পরিবর্ত আধুনিক জবাইখানা স্থাপন জরুরি।

তিনি বলেন, জাত উন্নয়নের মাধ্যমে মহিষের দুধের উৎপাদন বাড়াতে হবে। এজন্য ভারতীয় গীর বা অন্যকোনো জাত এনে সিলেকটিভ ব্রিডিংয়ের দিকে যেতে হবে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। খামারিদের আধুনিক শেড, সাইলেজ করা, ভ্যাকসিন দেয়াসহ নানান পরামর্শ দিতে হবে।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, নাটোর সদর এবং নওগাঁর সদর উপজেলার বিভিন্ন খামার ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশই প্রান্তিক খামারি। বেশিরভাগ এলাকাই বৃষ্টির পানিতে ডুবে যায়। বছরের ৪ মাস গো-খাদ্যের সমস্যা দেখা দেয়। খাবার মজুদ কিংবা ঘাস উৎপাদনের কোনো জায়গা থাকে না। রয়েছে এনজিওদের টাকায় কেনা গরু চুরি ও পশু মেরে ফেলার ভয়। খামারের অবস্থাও নাজুক ও স্যাঁতসেঁতে। 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হিসেবে রয়েছে এনজিওদের কিস্তি। উৎপাদিত দুধের প্রায় সব টুকুই তুলে দিতে হয় ঘোষ কিংবা ব্র্যাক, মিল্ক ভিটা, প্রাণ, আকিজসহ বিভিন্ন দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানের কাছে। যেসব এলাকায় দুধ সংগ্রহের ব্যবস্থা নেই সেখানে খামারিরা দুধের দাম পান না। পশুর চিকিৎসায় স্থানীয় হাতুড়ে চিকিৎসকই ভরসা। তবে বড় খামারিরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পশুর চিকিৎসা করিয়ে থাকেন।

এলডিডিপি প্রকল্পভুক্ত পিজির সভাপতি শাহজাদপুরের চরবেলতৈল গ্রামের খামারি সাইদুল ইসলাম বলেন, তার খামারে ৬টি গাভী রয়েছে। খামারটি পাকা করার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা নেই। দুধ বিক্রির টাকা দিয়ে এনজিওর কিস্তি এবং পশু ও নিজেদের খাবার জোটে। দুধ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে না পারায় মাঝে মধ্যে দুধ নষ্ট হয়েও যায়।

সিরাজগঞ্জ

ব্যবসায়ী ফিরোজ হাসান অনিক ৫ একর জায়গায় গড়ে তুলেছেন গরু মোটা তাজাকরণ খামার। কোরবানির সময় বিক্রি করেছেন কয়েক কোটি টাকার গরু। আবাদ করছেন উন্নত জাতের নেপিয়ার ঘাস। নিরাপদ পশু খাদ্য নিশ্চিত করতে গড়ে তুলেছেন ফিড মিল। আধুনিক এই খামারের সঙ্গে গরুর মাংস কেনার চুক্তি করেছে বেঙ্গল মিট।

নাটোর সদর উপজেলার সবচেয়ে বড় গরুর খামার ড্রিম ল্যান্ড ক্যাটেল এন্ড ডেইরি ফার্মে ১৮৪ টি গরু ও মহিষ রয়েছে। যার মধ্যে গরু ১৪৩টি, মহিষ ৪১টি। খামারের প্রতিষ্ঠাতা মো. রেকআত আলী বলেন, প্রতিদিন দুবেলা খামার ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। রয়েছে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা। রয়েছে ডাক্তার। তার খামারে দেশের সবচেয়ে বড় মহিষ রয়েছে। যার উচ্চতা ৫ ফুট তিন ইঞ্চি। দৈর্ঘ্য ৯ ফিটের বেশি। ওজন ১০০০ কেজি। এছাড়াও নিলিরাভি, জাফরাবাদি, মুররা এবং গোলাপী সাদা বাওয়ারি সিং মহিষও রয়েছে।

খামারের গরু প্রসঙ্গে রেকআত আলী বলেন, তার খামারে বর্তমানে দেশাল, ব্রাহমা, ক্রস ব্রাহমা, নেপালি, গির, গয়াল, ফ্রিজিয়াম অস্ট্রাম, ইন্ডিয়ান বাওয়ারি, ব্রাঙ্কাস, স্ট্রবেরি, শাহীওয়ালসহ আরও অন্য জাতের গরু আছে। তার খামারের আকর্ষণ হলো পাঁচ পা এবং দুটি লেজওয়ালা গরু। দেশি গরুর উৎপাদন কম হওয়ায় মানুষ এগুলো লালন পালনে আগ্রহী নয়। এজন্য বেশি বর্ধনশীল জাত উন্নয়ন করা। পাশাপাশি উন্নত জাতের ঘাস চাষের প্রযুক্তিও খামারিদের হস্তান্তর করা প্রয়োজন।

নাটরের শ্রী ধরপুরের শহিদুল ইসলাম ৫ বিঘা মজির উপর মাহিম এ্যাগ্রো নামে বাণিজ্যিক খামার গড়ে তুলেছেন। আধুনিক এই খামারে রয়েছে বিশাল আকারে তিনটি গরু রাখার শেড। আরও একটি শেড নির্মাণাধীন। বর্তমানে এখানে ৬৪টি গরু রয়েছে। একই সীমানার মধ্যে তিনি করছেন উন্নত জাতের ঘাস চাষ।

নাটোর 


নওগাঁর সদর উপজেলার (শেরপুর মধ্য পাড়া) পিজি সদস্য মো. পলাশ উদ্দিনের খামারে ৬টি দুধের গরু রয়েছে। ছোট, স্যাঁতসেঁতে ও অন্ধকার ঘরে রাখা হয়েছে গরুগুলোকে। ফ্লোর পাকা হলেও নেই পর্যাপ্ত আলা ও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা। গরুর পাশাপাশি তিনি ছাগলও পালন করেন। দুধ উৎপাদনের করলেও খাবারের দাম বেশি হওয়ায় দুধ বিক্রি করে লাভ করতে পারেন না।

পিজি সদস্য মেঘনার খামারে গিয়ে দেখা গেছে, ছোট ও অন্ধকার একটি বন্ধ ঘরে ৬টি দুধের গরু রয়েছে। মেঝেতে পানি জমে আছে। একটি গরুর পায়ে ঘাঁ। গোবর পরে আছে। চোর ও ডাকাতের ভয় ও শত্রুতা করে গরুকে কিছু খাওয়াতে পারে এ কারণে খোলামেলা ও আলোবাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

আনন্দ নগর এলাকার মন্ডল পোলট্রি ও হ্যাচারির মালিকের ছেলে মো. আতিকুর রহমান বলেন, এখানে ৫ হাজার লেয়ার প্যারেন্ট স্টক এবং সোনালী প্যারেন্ট স্টক রয়েছে। তারা ইনকিউবেটরের মাধ্যমে বাচ্চা উৎপাদন করেন। পাশাপাশি ডিমও বিক্রি করেন। করোনার কারণে তাদের ব্যবসা এখন মন্দা। ৯৮ হাজার বাচ্চা উৎপাদনে ক্ষমতা থাকলেও তারা এখন শুধু ডিম বিক্রি করছেন। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই সেক্টরে অনেক অগ্রসর হয়েছে। প্রয়োজনীয় ডাক্তার, পরামর্শ, লেবার পেলে এ সেক্টর আরও অগ্রসর হবে। তবে আধুনিক খামারের জন্য যে ধরনের শেড ও প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি দরকার তা সবাই নিতে পারবে না।

নওগাঁ

বাংলাদেশ ন্যাশনাল পুষ্টি কাউন্সিলের (বিএনএনসি) উপপরিচালক আক্তার ইমাম বলেন, এসডিজি অর্জনের জন্য অন্যতম বিষয় হলো দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা। এজন্য সরকারের ২২টি মন্ত্রণালয়রে সঙ্গে কারিকুলাম তৈরিতে বিএনএনসি কাজ করছে। পুষ্টিহীনতার কারণে (৫ বছরের নিচে) দেশে ২০১১ সালে খর্বাকৃতির (স্ট্যান্টিং) হার ছিল ৪১ শতাংশ যা বর্তমানে কমে ২৮ শতাংশ হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশ কমানের জন্য কাজ চলছে। কৃশতা (ওয়াস্টিং) ১৫.৬ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে কমিয়ে আনার কথা থাকলে এখন ১০ শতাংশে রয়েছে। কমওজনের (আন্ডারওয়েট) ক্ষেত্রে ৩৬ শতাংশ থেকে নামিয়ে আনার জন্য কাজ চলছে।

তিনি বলেন, প্রাণিজ পুষ্টি চাহিদা পূরণে অনেক ক্ষেত্রেই আমারা স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও বন্টন গত কিছুটা সমস্যা রয়েছে। এ কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করতে পারে। এক্ষেত্রে ওএমএসের মাধ্যমে দারিদ্র মানুষের জন্য জন্য দুধ, মাংস ও ডিম সরবরাহের বিষয়টিও আমরা প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবো।

কেন্দ্রীয় পশু হাসপাতালের সাবেক প্রধান চিকিৎসক ডা. এবিএম শহীদউল্লাহ বলেন, খামারিদের আধুনিক খামারের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা ও সম্ভাবনা, স্বাস্থ্য সচেতন না, খামার ব্যবস্থাপনা, অপচিকিৎসা, এন্টিবায়োটিকের ব্যবহারের অপকারিতা রোধ, কৃত্রিম প্রজনন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তবেই স্বাস্থ্য সম্মতভাবে খামার পরিচালনা করতে পারবে। সেখানে উৎপাদিত পণ্যও স্বাস্থ্য সম্মত হবে। রোগ বালাই কম হবে। অহেতুক ব্যয় কমবে। দেশজ প্রাণিসম্পদের উৎপাদন কম একারণে খামারিদের অধিক উৎপাদনশীল বীজ বা সিমেন সরবরাহ করতে হবে। তবেই কাঙ্ক্ষিত অর্জন সম্ভব হবে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), ইউএসএআইডি এবং ডেটা ফর ইমপ্যাক্ট এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা (১৬ আগস্ট ২০২২) হয়েছে, দেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী এক কোটি ৭০ লাখ নারী এখনও অপুষ্টির শিকার, যা মোট বিবাহিত নারীর ৪৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এদের বড় একটি অংশের উচ্চতার তুলনায় ওজন বেশি। অন্য অংশের উচ্চতার তুলনায় ওজন কম। এসব নারী প্রতি বছর ১৪ লাখ শিশুর জন্ম দিচ্ছেন।

২০২১ সালের প্রবীণ দিবসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) করা এক গবেষণায় বলা হয়েছে-দেশে যত প্রবীণ রয়েছে তার এক-চতুর্থাংশ পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। আরও সহজভাবে বললে প্রতি ১০০ জন প্রবীণের মধ্যে পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন ২৫ জন। আর পুষ্টিহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছেন ৬৫ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবীণ। প্রবীণ পুরুষদের অপুষ্টিতে ভোগার হার যেখানে ২২ শতাংশ, সেখানে ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ নারী ভোগেন পুষ্টিহীনতায়।

খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সুপারিশ অনুযায়ী একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের দৈনিক ন্যূনতম ২৫০ মি.লি. দুধের বিপরীতে আমরা পাচ্ছি ২০৯ মিলি লিটার। এক্ষেত্রে আমরা প্রায় ৪১ মিলি লিটার দুধ কম পাচ্ছি। তেমনি মাংসের ক্ষেত্রে ১২০ গ্রামে চাহিদার বিপরীতে আমরা পাচ্ছি ১৪৮গ্রাম। এক্ষেত্রে আমরা প্রায় ২৮ গ্রাম মাংস বেশি পাচ্ছি। জনপ্রতি বছরে ১০৪টি করে ডিমের চাহিদার রিপরীতে আমরা জনপ্রতি পাচ্ছি ১৩৬টি ডিম।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) সূত্র জানায়, আধুনিক খামার ও কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থাপনায় গরু হৃষ্টপুষ্টকরণ, প্যারেন্টস্টক উৎপাদন, অধিক ডিম উৎপাদনশীল মুরগির জাত উদ্ভাবন, দেশীয় মুরগির কৌলিক মান উন্নয়ন, সিলেকটিভ ব্রিডিং, দেশি মুরগির মতো সোনলী মুরগির জাত উদ্ভাবন, দুগ্ধবতী গাভীর জন্য 'মিনা মিক্স' উদ্ভাবন, গো-খাদ্য কর্নস্ট্র প্যালেট ফিড, গরু এবং ছাগল-ভেড়ার বাচ্চার জন্য মিল্ক-রিপ্লেসার এবং স্টার্টার খাদ্য উদ্ভাবন, ঘাসের চারটি উন্নত জাত 'নেপিয়ার-১, ২, ৩ ও ৪' উন্নয়ন, ভেজা খড়, ভুট্টা খড় বা সবুজ ঘাস সংরক্ষণ প্রযুক্তি, ইউএমএস, টোটাল মিক্সড রেশন বা টিএমআর উদ্ভাবন করা হয়েছে।

দেশে কৃত্রিম প্রজননের প্রসার বাড়ছে। দশ বছরের ব্যবধানে এর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২.৮৯ মিলয়ন কৃত্রিম প্রজননের সংখ্যা বেড়ে ৪.২৩ মিলিয়ন, একইভাবে সিমেন উৎপাদন হয়েছে ৩.৪৫ থেকে ৪.৫১ মিলিয়ন, গবাদি পশুর টিকা ১২.৭১-২৩.৭৫ মিলিয়ন, পোলট্রি টিকা উৎপাদন ১৬৪.৭১-২৯৬.৭২ মিলিয়ন,হাঁসমুরগির টিকা প্রদান ১৫৮.৭৮-২৯৪.০৪ মিলিয়নে উন্নিত হয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর