ঘরে বসে শামীমার মাসে আয় ৪০ হাজার টাকা

, জাতীয়

আরিফুল ইসলাম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, টাঙ্গাইল | 2023-08-28 05:18:29

বর্তমানে নারীরা কোনো কাজেই পিছিয়ে নেই। তারা তাদের নিজ যোগ্যতায় এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়তই। ঘরে বাইরে সব পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করছে। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা। অনলাইন ব্যবসায়ের প্রবর্তনের ফলে নারীরা আরও বেশি পরিমাণে সফল উদ্যোক্তায় পরিণত হচ্ছে। নিজের জমানো মাত্র ৩০০ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করে বর্তমানে ৩ লাখেরও বেশি টাকার পুঁজি করেছেন ‘আনকোরা’র স্বত্ত্বাধিকারী শামীমা সুলতানা। প্রতি মাসে আয় করছেন ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা।

নিজের স্বামী ও এক মেয়েকে ঠিক যতটুকু সময় দেন, তার চেয়ে বেশি সময় দেন নিজের ফেসবুক ভিত্তিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আনকোরায়। এক কন্যা সন্তানের মা অনার্স শেষ না হতেই যখন চাকরির আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরতে গিয়ে নিজের মধ্যে হতাশা আবিষ্কার করলেন, ঠিক তখনই ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন মাথায় চাপে। এরপর স্বামীর অনুপ্রেরণায় নিজেকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুললেন। ‘আনকোরা’ ফেসবুক পেজ তার জীবনকে নিয়ে গেল এক অনন্য উচ্চতায়। 

এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় তাকে। কিন্তু সংসার ও সন্তান লালন-পালনের পাশাপাশি সফলতার সঙ্গে চালিয়ে যান পড়াশোনা। শামীমা সুলতানা টাঙ্গাইলের কুমুদিনী সরকারি মহিলা কলেজ থেকে অনার্স শেষ করেছেন। চাকরির আশায় বসে না থেকে তিনি উইয়ের মাধ্যমে শুরু করেছেন অনলাইন ব্যবসা। ‘আনকোরা’ নামে ফেসবুক পেজ খুলে দেশীয় আমসত্ত্ব বিভিন্ন রকমের আচার ফেসবুক পেজে আপলোড দিতে থাকেন। ধীরে ধীরে অর্ডার আসতে থাকে। সেইসঙ্গে মানুষের চাহিদাও বাড়তে থাকে; ফলে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে ‘আনকোরা’ পেজ।

শামীমা সুলতানা বলেন, ছোটবেলা থেকে নিজে কিছু করতে চাইতাম তবে সেটা চাকরি না, নিজের স্বাধীনতা থাকবে এমন কিছু রান্না-বান্নায় মোটামুটি ঝোঁক থাকলেও কিভাবে কি করবো সেটা বুঝতাম না। আমার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্পটা শুরু মূলত করোনাকালীন ঘরবন্দি সময়ে। করোনার জন্য স্বাভাবিক জনজীবন যখন স্থবির তখন ফেসবুকে দেখা পেয়েছিলাম ‘উই’ নামক একটি ফেসবুক পেজ। যেখানে হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তাদের মিলন-মেলা। ঘরে বসেই সব সামলাচ্ছেন তারা, বেশ একটা সাহস সাথে অনুপ্রেরণাও পেলাম। তখন আমারও মনে হলো আমিও তো কিছু করতে পারি। রান্নার প্রতি টুকটাক ঝোক থাকার কারণে আচার বানানোটা ভালোই পারতাম আর সেটা নিয়ে সেখান থেকেই শুরু হলো উদ্যোক্তা জীবনের গল্প। এ জন্য কষ্ট হলেও কাজ দিয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়। নিয়মিত থেকে নিজেকে নিজের কাজের মাঝে টিকিয়ে রাখতে হয়। অন্যের সমালোচনা বা কটু কথা শুনে যদি শুরুতেই হতাশ হয়ে যান তবে কখনোই কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবেন না। আর আপনি যখন সত্যি ভালো কিছু করছেন বা করবেন তখন পারিবারিক বা সামাজিকভাবে সমর্থন এমনিতেই পেয়ে যাবেন। তবু আমার ক্ষেত্রে যেটা না বললেই নয় আমার স্বামী শুরু থেকেই আমাকে সমর্থন করে আসছেন যে কারণে এগিয়ে যাওয়াটাও আমার পক্ষে অনেক সহজ হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, প্রায় ৩ বছরের উদ্যোক্তা জীবনে আমি একদিনও অনিয়মিত হইনি। যেহেতু আমি এখনও ছাত্রী সেই সাথে সংসার বাচ্চা তো আছেই তবুও আমি আমার কাজের জায়গায় শতভাগ দেয়ার চেষ্টা করি। আমি এখন যতটা এগিয়ে আসতে পেরেছি সেটা হলো আমার নিয়মিত ধৈর্য ধরে থাকার জন্য। ভালো পণ্য প্রতিনিয়তই গ্রহণের জন্য আর যেটা না বললেই নয় তা হলো একজন মানুষ হিসেবে ভালো ব্যবহার যা ছাড়া ব্যবসা বা কাস্টমার কোনটাই ধরে রাখা সম্ভব না। আসলে আমি যখন উদ্যোক্তা হয়েছি তখন ছিল করোনাকালীন ঘরবন্দি সময়। তাই উদ্যোক্তা হতে গিয়ে শুরুতেই কোন ট্রেনিং নেয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। প্রথমত আমি আমার কাজে নিয়মিত ভাবে ছিলাম। কাজটাকে সিরিয়াসভাবে নিয়েছি।

শামীমা বলেন, আপনি যা কিছু করুন না কেন সেটা সৎ ভাবে করতে হবে। সততা না থাকলে আপনি যে কোন সময় কাজ থেকে ছিটকে পড়তে পারেন। আর সততা ব্যবসার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধৈর্য ধরে যে কোন পরিস্থিতিতে নিজেকে টিকে থাকতে হবে। ব্যক্তিগত পরিচয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ যখন মানুষ আপনাকে চিনবে বা আপনার কাজ নিয়ে জানবে তখনই কেবল সে কিনতে আগ্রহী হবে। আমার কাজ নিয়ে আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী। তাছাড়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো সবার আগে মানুষ হিসেবে আপনাকে ভালো ব্যবহার করতে হবে। এটা কাস্টমার ডিলিং এর ক্ষেত্রে ভীষণ জরুরি। যেহেতু আমার ব্যবসা পুরোপুরি অনলাইন ভিত্তিক, সেখানে একটা মানুষকে সরাসরি না দেখে তার সাথে ডিল করাটা খুবই কঠিন। সেক্ষেত্রে ভালো ব্যবহারটা অবশ্যই জরুরি। কথা দিয়ে কথা রাখতে পারলে ক্রেতার বিশ্বস্ততা অর্জন সহজ হয়ে যায়।

তিনি বলেন, নারীরা ঘর সংসার সামলে চাকরি করবে ব্যাপারটা ইদানীং কিছুটা সহজ হলেও উদ্যোক্তা হওয়াটা মেয়েদের জন্য একরকম যুদ্ধের মতন! তবু ইচ্ছাশক্তি, সততা, সাহস আর টিকে থাকার প্রবল ধৈর্য থাকলে আসলে সবটাই সম্ভব আমার মনে হয়। আত্নবিশ্বাসী হতে হবে তবে সেটা যেন অতিরিক্ত না হয়। পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল হতে হবে সেই সাথে নিয়মিত থাকতে হবে। হতাশ হওয়া যাবে না যে কোন পরিস্থিতিতে নিজেকে টিকিয়ে রাখার মানসিকতা থাকতে হবে। ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে হবে। আচার-আচরণে যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকতে হবে। টাইম ম্যানেজমেন্ট, কমিটমেন্ট ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উদ্যোক্তা জীবনের ক্ষেত্রে সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে আর কথা কাজে মিল রাখাটাও ভীষণ জরুরি। কাজের ক্ষেত্র আর পারিবারিক ক্ষেত্র আলাদা রাখতে হবে। টিম ওয়ার্ক করতে হবে এবং তা লিড করার যোগ্যতা থাকতে হবে। আপনার কাজের ক্ষেত্র যত বড় হবে টিম ওয়ার্ক তত জরুরি হয়ে উঠবে। প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হতে হবে। কারণ এটা ২০২২ সাল ডিজিটাল যুগ যেখানে প্রায় সবাই এখন প্রযুক্তি নির্ভর। মানুষ যত প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ছে অনলাইন ব্যবসা তত জমজমাট হয়ে উঠছে। আর আমার কাছে মনে হয় পোশাকের চেয়ে খাবার-দাবারে মানুষের আগ্রহ বেশি। আর সেখানে হোমমেড মানেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকরভাবে বাসার খাবারটাই মানুষ পাচ্ছে। যদিও খাবার নিয়ে কাজ করাটা চ্যালেঞ্জিং তবুও আপনার খাবার যখন ক্রেতার ভালো লাগবে তখন সেই ক্রেতা কিন্তু রিপিট ক্রেতা হয়ে বারবার ফেরত আসবে। প্রতিটা ফুড রিলেটেড আইটেমের ক্রেতা থেকে রিপিট ক্রেতার অংকটা কিন্তু বেশ ভালো রকমেরই হয় বা হচ্ছে। তবে সেক্ষেত্রে ডেলিভারি বা কুরিয়ারের ব্যাপারটা যত সহজ হবে ফুড আইটেমটা আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।

তিনি আরো বলেন, আনকোরাকে একটা ব্র্যান্ড হিসেবে গড়তে চাই! আনকোরার মাধ্যমে যেন তাদের জন্য কিছুটা হলেও করতে পারি, সেই চেষ্টায় আমার এই আনকোরার সৃষ্টি। বিএসসি অনার্স (পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ) শেষ। বর্তমানে এমএসসি (পদার্থবিজ্ঞান) অধ্যয়নরত আছি। অল্প বয়সে বিয়ে, বাচ্চা, সংসার, পড়াশোনা সামলে একজন উদ্যোক্তাও! আমি কিছু করছি বরং আমার বাবা, স্বামীর পরিচয় ছাড়াও আমার একটা পরিচয় আছে আর তা হলো আনকোরার স্বত্ত্বাধিকারী আমি শামীমা সুলতানা। এটাই আমার সফলতা আমার নিজের পরিচয়। ইচ্ছাশক্তি, সাহস, আত্নবিশ্বাস আর পরিশ্রমের মানসিকতা থাকলে বিনিয়োগটা কোন সমস্যা বলে আমার মনে হয় না। আপনি কোথাও ঘুরতে গেলেও কিন্তু হাজারখানি টাকা খরচ হয় সেটা না হয় নিজের উদ্যোগেই প্রথম ইনভেস্ট করুন। প্রথমেই লাখ লাখ টাকা ইনভেস্ট করতে হবে এমন কিন্তু না। শুরুটা অল্প থেকেই করুন, আস্তে আস্তে কাজ বুঝে পরিধি বাড়াবেন। আমার ৩০০ টাকার উদ্যোগ কিন্তু তিন লাখ ছাড়িয়েছে বহু আগেই! নিজের টার্গেট সেট করুন। পাঁচ বছর পর নিজেকে বা নিজের উদ্যোগকে কোথায় দেখতে চান সেই হিসাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করুন। সৎ থেকে পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকতে হবে যে কোন পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে সামলাতে হবে, কোন ভাবেই হতাশ হওয়া যাবে না। নিয়মিত ভাবে নিজের কাজে লেগে থাকতে হবে। সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রেখে কাজ করুন সৎভাবে লাখ টাকা বিক্রি করা কোন ব্যাপারনা। সব ধরনের আচার আমসত্ত্ব নিয়ে, আমার সিগনেচার আইটেম আচারি শুঁটকি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর