ভয়াবহ লোডশেডিংয়ে বেড়েছে হাতপাখার চাহিদা

, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বগুড়া | 2023-08-30 12:12:58

তাল পাখার গ্রাম আড়োলায় নতুন করে ব্যস্ততা বেড়েছে বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কারণে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে বাসা বাড়িতে হাতপাখার চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে হাতপাখা বিক্রেতারা ভিড় করছেন কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নে আড়োলা গ্রামে। এই গ্রামের প্রতিটি ঘড়ে ঘড়ে নারী- পুরুষ থেকে শুরু করে শিশুরাও তালের পাতা দিয়ে তৈরি করে থাকে রকমারি হাতপাখা।

সাধারণত ফাল্গুন-চৈত্র মাস থেকে হাত পাখা তৈরির কাজ শুরু হয়ে চলে ভাদ্র মাস পর্যন্ত। জৈষ্ঠ্য মাস পার হলে কাজের চাপ কমতে থাকে। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম।

আড়োলা গ্রামের পাশাপাশি আতালপাড়া, যোগীরভবনসহ আশে পাশের গ্রামগুলোতে বিভিন্ন প্রকারের তালপাতার পাখা তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কারিগররা।

হাতপাখা তৈরির গ্রামগুলে ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ফাল্গুন মাস থেকে তালপাতার পাখা তৈরির কাজ শুরু করেছে এখানকার পাখা তৈরির কারিগররা। ঠিক কত বছর আগে এই এলাকায় হাতপাখা তৈরির কাজ শুরু হয় তার কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও প্রবীণ ব্যক্তিদের মতে একশ বছর বা তারও বেশি আগে আড়োলা গ্রামে তাল পাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরির কাজ শুরু হয়। আর তখন থেকেই গ্রামের পেশা হিসেবে বেছে নেয় হাতপাখা তৈরির কাজ। এক সময় হাত পাখা তৈরির কাজ ছড়িয়ে পড়ে পাশের গ্রামগুলোতে।

গ্রামগুলো ঘুরে দেখা যায়, শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত বসে নেই। নারী-পুরুষ মিলে সবাই তৈরি করছে বিভিন্ন প্রকারের সৌখিন তালপাতার হাতপাখা।পুরুষেরা কাঁচা বাশের কাজ করছেন। আর নারীরা সুই-সুতা দিয়ে পাখা বাঁধানো ও রঙের কাজ করছেন। পাখার চাহিদা মেটাতে গরম মৌসুমে নারী-পুরুষের নিশ্বাস ফেলার সুযোগ নেই। চুলায় ভাত-তরকারি তুলে দিয়ে পাখা তৈরির কাজ নিয়ে বসেন তারা। শিশু-কিশোরেরাও লেখাপড়া ও খেলাধুলার পাশাপাশি মা-বাবার সঙ্গে পাখার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারেরা আসেন পাখা নিতে। আবার অনেকে কারিগরদের আগাম টাকা দিয়ে পাখা তৈরি করিয়ে নেন।

প্রতি বছরের মতো এবারও ভাদ্র মাস পর্যন্ত এখানকার পাখা তৈরি কারিগরদের এই ব্যস্ততা থাকবে জানা গেছে। গরমের তীব্রতা যত বাড়বে ততই বাড়বে পাখা তৈরি কারিগরদের ব্যস্ততা। কারণ এ বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় মানুষজন যখন গরম সইতে না পারে তখন একমাত্র ভরসা এই তালপাতার পাখা। বর্তমানে রোদের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় এবং লোডশেডিংয়ের ফলে অতিষ্ট হয়ে পড়েছে বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা। যার ফলে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা ছুটে আসছেন পাখা কেনার জন্য। এখানকার ৪/৫টি গ্রামের প্রায় ৫’শ পরিবার তালপাতার পাখা তৈরি করে থাকে। এদের মধ্যে কেউ শ্রমিক হিসেবে আবার কেউ নিজের তহবিলে পাখা তৈরি করেন। আবার স্থানীয় কয়েকজন মহাজন শ্রমিক খাটিয়ে প্রতি মৌসুমে ৩০/৪০ হাজার পাখা তৈরি করে নিয়ে বড় বড় ব্যাবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে থাকে।

এখানে ৫ প্রকারের পাখা তৈরি হয়। এসব পাখার নাম দেওয়া হয়েছে ডাটা পাখা, হরতন পাখা, ঘুরকি পাখা, পকেট পাখা ও আমান পাখা। এখানে পাখা তৈরির কাজে নারীরা অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। নারীরা সংসারের কাজের পাশাপাশি এই পাখা তৈরি করে বাড়তি আয় করে থাকেন। নারীরা বাড়তি আয়ের জন্য বিভিন্ন মহাজনের পাখা তৈরি করে। চুক্তি ভিত্তিক ১’শ পাখা তৈরি করলে তারা পাখার প্রকারভেদে ৬০ থেকে ১০০ টাকা পায়। চুক্তিভিত্তিক পাখা তৈরিকারক পারভীন, সহিদা, বৃষ্টি সহ একাধিক মহিলা বলেন, পাখা তৈরি থেকে শুরু করে পাখা তৈরির আনুষঙ্গিক কাজের উপর নির্ভর করে তারা পারিশ্রমিক পায়।

মহাজন সালাম জানান, তারা সারা বছরই ব্যস্ত থাকেন তালপাতা সংগ্রহ করাসহ পাখা তৈরির কাজে। পাখা তৈরির শুরুর ২/৩ মাস আগে থেকে নওগাঁ ও জয়পুরহাট জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে তালপাতা কিনে এনে মজুদ করেন। পাখা তৈরি করে বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকারি দরে বিক্রি করেন। সালাম বলেন, এখানকার তৈরি করা তালপাখা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। প্রতি মৌসুমে এখানকার স্থানীয় মহাজনেরা এই ব্যবসায় ৫০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করে।

পাবনা জেলা থেকে পাখা কিনতে আসা ব্যবসায়ী মামুন শেখ ও মিরাজুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশে যত তালপাতার পাখা তৈরি হয় তার বেশির ভাগই এখানকার। সালামের মতো আজগর শেখ বলেন, তালপাতার এই সৌখিন পাখাগুলো সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় বিভিন্ন মেলাতে। আগে শখের বসে এলাকরা নারীরা পাখা তৈরি করতো, সেগুলো কেউ কেউ মেলাতে বিক্রি করতো। আর এখন এই পাখা তৈরির কাজ অনেকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। এলাকার লোকজন বলে এই এলাকায় তাল গাছ বেশি। তাদের বাপ দাদার আদি পেশা এই তাল পাতা দিয়ে পাখা তৈরির কাজ। এখানে ৭/ ৮ বছরের শিশু পর্যন্ত পাখা তৈরি করতে পারে।

পাখা তৈরির কারিগররা বলেন, আধুনিকতার ছোঁয়া সব জায়গাতে ছড়িয়ে পরলেও তাদের তৈরি করা পাখার চাহিদা এখনও কমেনি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর