তাদের চোখে বন্যা যেন মৃত্যুপুরী!

, জাতীয়

আরিফ জাওয়াদ, ঢাবি করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-25 00:36:31

সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণে গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ২১ জন শিক্ষার্থীর একটি দল। বেড়াতে গিয়ে বন্যার কবলে পড়ে আটকা পড়েন তারা। গত সোমবার (২০ জুন) সকল অনিশ্চয়তার শঙ্কা কাটিয়ে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ক্যাম্পাসে ফেরত আসেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুরোধে স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় প্রায় ৭০ ঘণ্টা পর তারা সেখান থেকে উদ্ধার হন। ফেরত আসা সকল শিক্ষার্থীর চোখেই বন্যা যেন একটি মৃত্যপুরী। যেখানে মৃত্যুকে অতি নিকট থেকে দেখে এসেছেন বলে জানিয়েছেন বন্যায় আটকে থাকা শিক্ষার্থীরা।

ফিরে আসা শিক্ষার্থীদের একজন মারিয়া হাসিবা বলেন, মৃত্যুকে অনেক কাছ থেকে দেখেছি। যেখানে আমরা একজন আরেকজনের সহায় ছিলাম। মৃত্যু, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, ধৈর্যধারণ করার ক্ষমতা একদম কাছ থেকে দেখেছি। যেখানে পরবর্তী এক মিনিটের নিশ্চয়তা ছিল না, যেকোন সময় মৃত্যু হতে পারে এটা ভেবেও নিশ্চিন্ত থাকার চেষ্টা করেছি। ওই কয়েকদিন কষ্ট হয়েছে শুধু ঘুম আর কাপড়ের জন্য। সম্পূর্ণ ভেজা কাপড় গায়ে শুকিয়েছে। গলা সমান পানির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হয়েছে, স্রোত এতো বেশি যে যেকোনও সময় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এমন শঙ্কা কাজ করার পরও স্থির থেকেছি।

তাহসীন নাওয়ার প্রাচী নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, যেখানে লঞ্চের ধারণক্ষমতা ৪০ জন। সেই লঞ্চে আমরা ১০০ জনের বেশি। যাত্রার মধ্যে চলতে থাকে কখনো আর্তনাদ আর কান্নার শব্দ। লঞ্চডুবির খবরে সব সময় আমরা মৃত্যুর সংখ্যা গুনি, সেই বিষয়টি মাথার মধ্যে ঘুরছিল। এমন সংখ্যাতেই কি আমি ও আমার বন্ধুদের জীবন শেষ হয়ে যাবে? ট্রমার চূড়ান্ত সময় পার করতে হয়েছে আমাদের।

এ ঘটনায় আজমল হোসেনে প্রান্ত নামে এক শিক্ষার্থী এতোটাই বিমর্ষ যে তিনি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছিলেন না। কিছুটা থেমে তিনি বলেন, দুর্যোগের পুরোটা সময় আমরা নিজেরাই একে অপরের প্রথম অবলম্বন ছিলাম। যখনই কেউ ঘাবড়ে গিয়েছে, আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছে; আমরা তাকে মানসিক শক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

আটকে পড়ার শুরু থেকেই তাদের অবস্থা গণমাধ্যম, প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে আসছিলেন শোয়াইব আহমেদ। ফিরে আসার পূর্ববর্তী পুরো ঘটনার আদ্যপান্ত বর্ণনা করেন তিনি।

সুনামগঞ্জে আটকাপড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ শিক্ষার্থী

শোয়াইব আহমেদ বলেন, আমরা ১৪ তারিখ রাতে সুনামগঞ্জে যাই। ১৫ তারিখ সেখানে গিয়ে পৌঁছাই। সেদিন তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। আমরা প্রথমদিন সুন্দরভাবে টাঙ্গুয়ার হাওর, নীলাদ্রি লেক উপভোগ করেছি। সব ঠিকঠাক চলছিল। পরের দিন (১৬ জুন) শিমুল বাগান ও বারিক্কা টিলা দেখতে আমাদের লঞ্চ যাত্রা শুরু করে। যাত্রা শুরুর আধঘণ্টার মধ্যে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়। কিন্তু সেই বৃষ্টিই যে আমাদের জীবনের সবচেয়ে বাজে দিন টেনে আনবে সেটা কেউ আন্দাজও করতে পারিনি।

পাহাড়ি ঢল আর মুষলধারে বৃষ্টির কারণে পানি খুব তাড়াতাড়ি বাড়ছিল, আর নদীর স্রোত অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল। আর এখান থেকেই শুরু হল বিপদ। পরে আমরা শিমুল বাগান যাওয়া ছেড়ে শহরে যাওয়ার জন্য চেষ্টা শুরু করি। লঞ্চ থেকে বিশ্বম্ভপুর নেমে যাই। সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে চালবনের দিকে যাই। কিন্তু সেখানেও খুবই বাজে অবস্থা ছিল রাস্তার। কোমর সমান পানি ছিল রাস্তার উপর। সেই পানি ভেঙে অটোরিকশা নিয়ে আমরা যাই। অটোরিকশা থেকে নেমে সবার পা তখন নিথর হয়ে যাচ্ছিল, হাঁটতে পারছিল না। এরপর আমরা চালবনে গিয়ে একটা ট্রলারে উঠি। যেটা সুনামগঞ্জ শহরে নিয়ে যাবে। সেই ট্রলারে ওঠার আগ থেকে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল, বৃষ্টির একেকটা ফোঁটা মনে হচ্ছিল বুলেটের মতো আঘাত করছে। আর প্রচুর বজ্রপাত হচ্ছিল। আমরা এক ঘণ্টার পথ প্রায় ৩ ঘণ্টায় পাড়ি দেই। এরপর আমরা সুনামগঞ্জ শহরে পৌঁছি।

তিনি আরও বলেন, এসময় এতো ভারী বর্ষণ হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল গুলি হচ্ছে। কোনোমতে সেখানে পানসী নামে একটি হোটেলে আমরা আশ্রয় নিই। ওই দিন রাতেই ১১টায় ঢাকায় ফেরার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বন্যার পানির কারণে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢাকার সঙ্গে সবধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকলো পানি। সন্ধ্যায় যেখানে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পানি ছিল, সকাল হতে হতে সেখানে গলা পানি।

আটকা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পরে আমরা ওখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় ১৭ জুন পুলিশ লাইন্সে আশ্রয় পাই। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর সেখানে আমরা একটু রেস্ট নেওয়ার সুযোগ পাই। এর আগে আমরা কেউই আগের দিন ঘুমাতে পারিনি, ওয়াশরুম ব্যবহার করতে পারিনি।

তিনি বলেন, ওই সময়টা ছিল উদ্বেগ, ভয় আর উৎকণ্ঠার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল খাদ্যসংকট। মুড়ি আর গুড় ছাড়া কিছুই পাচ্ছি না আমরা। পুলিশ লাইন্সে গিয়ে আমাদের যেটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল খাবার ও ঘুম; সেটার ব্যবস্থা হয়। পরদিন ১৮ জুন সকালে স্থানীয় পুলিশ সুপার লঞ্চ ভাড়া করে আমাদের তুলে দেন। সিলেটে পাঠানোর জন্য পুলিশ একটি লঞ্চের ব্যবস্থা করে। সেটিতে করে আমরা যাত্রা শুরু করি সকালে। এই লঞ্চটা আমাদের সবার জীবনের সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা দিয়েছে। দুপুর ২টায় লঞ্চ যাত্রা শুরু করে রাত ৮টা পর্যন্ত মাত্র চারভাগের একভাগ যেতে পারে। রাত হওয়ায় নাবিক কিছুই দেখতে পারছিলেন না, নদীর স্রোত এত বেশি ছিল যে নাবিক লঞ্চের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছিল না। এসবের কারণে রাত সাড়ে ৮টার দিকে লঞ্চ গিয়ে সুরমা নদীর পাশে একটা জায়গায় গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। সবার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। এর আগে লঞ্চের দুটো ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। তাই আমরা সবাই নিজেদের জীবনের আশা ছেড়ে দিচ্ছিলাম।

শোয়াইব আহমেদ আরও বলেন, লঞ্চ ওখানে আটকানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং ৯৯৯ এ কল করি। কিন্তু অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে তাদের ইমার্জেন্সি বোটগুলোও সাহায্য করতে আসতে পারছিল না।

পরে রাত ৩টার দিকে লঞ্চটিকে ওই জায়গা থেকে সরানো হয় এবং লঞ্চ আবার চলতে শুরু করে। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে (১৯ জুন) ছাতকের কাছাকাছি একটি ফেরিঘাটে নোঙর করে। তখন সঙ্গে সঙ্গেই আমরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। পরে তারা আমাদের ওই ঘাটেই অবস্থান করতে বলে। আমরা সেখানে অবস্থান করি এবং সকাল ৮টার দিকে সেনাবাহিনীর ৫টি স্পিডবোট আমাদের ওখানে গিয়ে পৌঁছায়। আমরা সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। এতটা বাজে রাত আমাদের জীবনে কখনো আসেনি। পরে আমাদের সবাইকে গোবিন্দগঞ্জে একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।

এই কয়েকদিনের অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়েছে এই লঞ্চ জার্নি। প্রায় ২০ ঘণ্টা পর আমরা ছাতক এসে পৌঁছাই। পরে সেনাবাহিনী উদ্ধার করে আমাদের ঢাকায় পৌঁছে দেয়। শোয়াইব আহমেদ বলেন, আমরা যে সবার সঙ্গে আবার দেখা করতে পারব, সেটা ভাবতেই পারিনি। বেঁচে আছি, এটা ভেবেই আনন্দে কাঁদছি বারবার।

‘আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই যারা আমাদের উদ্ধারের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন পুরোটা সময়– বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা), উপ-উপাচার্য (প্রশাসন), প্রক্টর স্যার, বিভাগের চেয়ারম্যান স্যার এবং বিশেষ করে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলার সব বাহিনীকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দিতে চাই।’

উল্লেখ্য, সবশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১২টি জেলায় বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অন্তত ৪০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে সিলেট বিভাগের চার জেলার বন্যা পরিস্থিতি তীব্র।

এ সম্পর্কিত আরও খবর