দুবলার চরে নানা সমস্যার পরও উৎসবমুখর জেলেপল্লী

খুলনা, জাতীয়

আবু হোসাইন সুমন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-26 08:10:23

বঙ্গোপসাগর পাড়ে সুন্দরবনের দুবলার চরে চলছে শুটকি মৌসুম। চলতি এ মৌসুমকে ঘিরে সাগর থেকে মাছ আহরণ ও শুটকি তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটছে জেলে পল্লীগুলোর হাজারো জেলে-মহাজনের। গত বছরের তুলনায় এ বছর জেলেদের জালে অনেক বেশি মাছ ধরা পড়ায় জেলেদের মধ্যে আনন্দ থাকলেও রয়েছে সমস্যাও। এ খাত থেকে প্রতি মৌসুমে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় হলেও জেলেদের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্টদের।

বনবিভাগ ও জেলে-মহাজন সূত্রে জানা যায়, শুটকি মৌসুমকে ঘিরে দুবলার চরের আলোরকোল, অফিসকিল্লার, মেহেরআলীর চর, নারকেলবাড়িয়া, শেলা ও ছাপড়াখালীসহ বিভিন্ন চরে প্রায় ৫০ হাজার জেলে ৫/৬ মাসের জন্য অস্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তোলেন। প্রতি বছর অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সাগর থেকে মাছ আহরণ করে চরগুলোতে শুটকি তৈরির কাজ করে থাকে জেলেরা। কিন্তু এ বছর সাগর ও সুন্দরবন থেকে ইলিশসহ সকল ধরণের মাছ আহরণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় প্রায় একমাস পরেই শুরু হয়েছে শুটকি মৌসুম।

এই একমাসের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চরগুলোতে এখন জেলেদের মধ্যে মাছ আহরণ ও শুকানোর প্রতিযোগিতা চলছে। জেল-মহাজন ও শুটকি শ্রমিকেরা সাগর পাড়ে বালুর চরে লইট্যা, রুপচাঁদা, খলিসা, ছুরি, ভেদা, পোয়া, দাইতনা, মেদ, জাবা, কাইন, ভোলা, ঢ্যালা, চিংড়ি ও বিভিন্ন প্রজাতির সাদা মাছসহ অন্তত একশ প্রজাতির কাঁচা মাছ শুটকি প্রক্রিয়াকরণ করছেন।  জেলেরা সারারাত সাগরে মাছ ধরার পর ভোরের সূর্য উঠার আগেই তা চরে নিয়ে আসেন। তারপর তা প্রজাতি ভেদে আলাদা আলাদা শুকিয়ে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করে থাকেন। এভাবেই শুটকি হয় সাগর পাড়ের দুবলা, মেহেরআলী, আলোরকোল, অফিস কিল্লা, মাঝির কিল্লা, শেলার চর, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া, বড় আমবাড়িয়া, মানিকখালী, কবরখালী ও চাপড়া খালী, কোকিলমনিসহ ছোট-বড় অনন্ত ১৩টি চরাঞ্চালে।

সাগর ও সুন্দরবন উপকূলীয় মোংলা, রামপাল, বাগেরহাট. সাতক্ষীরা, খুলানা, পাইকগাছা, পিরোজপুর, বরগুনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শুটকি তৈরিতে দুবলার জেলে পল্লীর অধিনস্থ এসব চরে এসে অস্থায়ী বসতি গড়েন। আগামী আরো পাঁচ তারা চরগুলোতে শুটকি তৈরি করবেন। তেরিকৃত শুটকি খুলনা, ঢাকা, চট্টগ্রাম ছাড়াও বিদেশে রফতানি হয়ে আসছে।

বনবিভাগ শুধু প্রতি শুটকি মৌসুমে জেলেদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করলেও জেলেদের জন্য চরগুলোতে নেই পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার ও চিকিৎসা ব্যবস্থা। এছাড়া সেখানে রয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। বিশুদ্ধ পানির অভাবে চরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে পানি বাহিত রোগ।

দুবলা ফিসারম্যান গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মো: কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, পুরো চরে রয়েছে মাত্র ৫টি সাইক্লোন শেল্টার। ঝড়-জলোচ্ছাসে সেগুলোতে আশ্রয় নিতে পারে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার লোক। বাকী ৩০/৩৫ হাজার লোকের নিরুপায় হয়ে আশ্রয় নিতে হয় বনের ভিতরের বিভিন্ন ছোট ছোট খালে ও বড় গাছে। পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টারের অভাবে দুবলার চরে সিডর ও আইলার আঘাতে  ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির পাশাপাশি মারা যায় প্রায় সহস্রাধিক জেলে ও বহদ্দার। সাগর পাড়ের জেলেপল্লীগুলোতে দুর্যোগে নিরাপত্তা ও সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে ৪০টি সাইক্লোন শেল্টার ও ৪০টি দিঘি খননের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবী জানিয়ে আসছেন দুবলা ফিসারম্যান গ্রুপ। 

এছাড়া গভীর সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের কাছে দুর্যোগের কোন বার্তা না পৌছানো ও দিক নির্ণয়ের জন্য কোন বয়া বাতি না থাকায় অনেক জেলেই সাগর থেকে দ্রুত ফিরতে পারে না। দিক ভুল করে চলে যায় ভারতের জলসীমায়। আইনি জটিলতায় সেখানেই তাদের জেল-জরিমানার শিকার হতে হয়।

জেলে পল্লীগুলোতে পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তার কথাও স্বীকার করে পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো: মাহমুদুল হাসান বলেন, এবার চরগুলোতে সেবা দেয়ার জন্য ৫টি ভাসমান মেডিকেল টিমকে কাজ করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এছাড়া সুন্দরবনের দুবলা, মেহেরআলী, আলোরকোলসহ বিভিন্ন ফরেস্ট স্টেশন ও ক্যাম্প এলাকায় দুর্যোগ মোকাবেলায় আধুনিক বহুতল (তিনতলা) ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শীঘ্রই সেগুলোর অনুমোদন মিলবে এবং কাজ শুরু হবে। ইতিমধ্যে হরিণটানা এলাকায় সাইক্লোন শেল্টারের আদলে আধুনিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। তাতে ওখানকার সকলে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে পারবেন।

তিনি আরো বলেন, এ বছর অন্যান্যবারের তুলনায় মাছ অনেক বেশি পড়ছে। তাই গত বছর এখান থেকে প্রায় ২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হলেও এবার কোন ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এরচেয়ে অনেক বেশি আয় হবে বলে আশাবাদী তিনি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর