রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে কর্মহীন ৪৭ শতাংশ শ্রমিক

খুলনা, জাতীয়

মানজারুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 13:15:29

কাঁচা পাট সংকটে পরেছে খুলনা-যশোর অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত নয়টি পাটকল। পাট সংকটের কারণে এসব মিলগুলোতে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। এছাড়া উৎপাদিত পাট পণ্য তুলনামূলক বিক্রি কম হওয়ায় প্রতিদিনই মজুদ পণ্যের পরিমাণ বাড়ছে। পাট না থাকায় শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পরেছে।

সরেজমিনে পাটকলে গিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে প্রায় ৩১৫ কোটি টাকার পাটপণ্য অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এসব পণ্য সময় মতো বিক্রি করতে না পেরে আর্থিক সংকটে পড়েছে পাটকলগুলো। এতে শ্রমিক-কর্মচারীদের নিয়মিত মজুরিও পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানা যায়।

খুলনা-যশোর অঞ্চলের ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল হল- ক্রিসেন্ট, প্লাটিনাম, খালিশপুর, দৌলতপুর, স্টার, ইস্টার্ন, আলীম, জে জে আই ও কার্পেটিং। এসব পাটকলে স্যাকিং, হেসিয়ান, সিবিসি এবং ইয়ার্ন এই চার ধরনের পণ্য উৎপাদন হয়। চলতি অর্থবছরে এসব পাটকলে দৈনিক ৩ হাজার ৬৫০টি তাঁত চালু রেখে পণ্য উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেয় বিজেএমসি। কিন্তু বর্তমানে চালু রয়েছে ২ হাজার ৯৯টি তাঁত। যা লক্ষ্যমাত্রার ৫৭ শতাংশ। ফলে মিলগুলির ৪৭ শতাংশ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে রয়েছে।

এদিকে বর্তমানে খুলনা-যশোর অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত নয়টি পাটকলে মজুদ পণ্যের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৫৫ মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য আনুমানিক প্রায় ৩১৫ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ পরিষদের কার্যকরী আহ্বায়ক ও ক্রিসেন্ট জুট মিলের সিবিএ সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন বার্তা২৪.কমকে জানান, বর্তমানে কাঁচা পাটের মৌসুম চলছে। অথচ পাটক্রয়ে অর্থ বরাদ্দ নেই। ফলে এখন স্বল্পমূল্যে পাটক্রয় করতে পারছে না মিলগুলো। পরবর্তীতে বেশি মূল্য দিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাটক্রয় করতে হবে। এতে পাটপণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও যেমন বেড়ে যাবে, তেমনি লোকসানেও পড়বে মিলগুলো।

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও জানান, শ্রমিকরা নিয়মিত মজুরি পাচ্ছে না। গত খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি ও বেতন দেয়া হয়। একই সঙ্গে ঈদ উল আজহার পূর্বে শ্রমিক কর্মচারীদের আংশিক মজুরি ও বোনাস দেয়া হয়। সর্বশেষ চলতি মাসে শ্রমিক কর্মচারীদের সকল মজুরি ও বেতন দেয়া হয়েছে। আবার কবে মজুরি দেয়া হবে সে বিষয়ে কেউ জানে না। এ অবস্থার পরিত্রাণের জন্য মৌসুমেই পাটক্রয়ে অর্থ বরাদ্দ এবং উৎপাদিত পাটপণ্য বিক্রির জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে এ শ্রমিক নেতা।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ পরিষদের কার্যকরী যুগ্ম আহ্বায়ক ও প্লাটিনাম জুট মিলের সিবিএ সাবেক সাধারণ সম্পাদক খলিলুর রহমান বার্তা২৪.কমকে জানান, পাট না থাকায় শ্রমিকরা মিলে এসেও কর্মহীন অবস্থায় আছে। অন্যদিকে পণ্য বিক্রি না হওয়ায় সবশেষ দুই সপ্তাহ শ্রমিকরা মজুরি পাচ্ছে না।

সরকারি উদ্যোগে বিদেশে পাটপণ্য বিক্রির উপরে গুরুত্বারোপ করে এ শ্রমিক নেতা আরও বলেন, ‘বিদেশে পাটপণ্য বিক্রির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও আন্তরিক হতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশের পাট পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু দিন দিন আমাদের পণ্য কিনতে বিদেশ থেকে কেন অনীহা প্রকাশ করে তা খতিয়ে দেখে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।’

এ বিষয়ে ক্রিসেন্ট জুট মিলের মহাব্যবস্থাপক গাজী শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে পাটক্রয়ের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। একই সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ উৎপাদিত পণ্য মজুদ রয়েছে। দেশে ও বহির্বিশ্বে বর্তমানে পাটপণ্যের চাহিদা কম। চাহিদা কমে যাওয়ায় বিক্রি হচ্ছে না। আর্থিক সংকটে চলছে মিল। ফলে কাঁচা পাট কিনতে পারছি না। মৌসুম শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কাঁচা পাটের অভাবে মিলে দৈনিক উৎপাদন যেখানে ৭০ টন ছিল, সেখানে ২৫-২৬ টনে নেমে এসেছে।’

ইস্টার্ন জুট মিলের প্রকল্প প্রধান ড. জিএএম মাহবুব উর রশিদ জুলফিকার জানান, পাটক্রয়ে অর্থের জোগান দিতে না পারায় উৎপাদন কমেছে। মিলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক ৩৪ মেট্রিক টন থাকলেও এখন তা সাড়ে ৭ মেট্রিকটন থেকে ১০ মেট্রিকটন পর্যন্ত পাটপণ্য উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদন হ্রাস পেলে ব্যয়ও বেড়ে যায়। এতে লোকসান হচ্ছে। তবে পাটক্রয় বাড়লে উৎপাদনও বাড়বে। বহির্বিশ্বে চাহিদা কমে যাওয়ায় মিলে পণ্য মজুদের পরিমাণ বাড়ছে। স্থানীয় বাজারে পণ্যে পাটের মোড়কীকরণ আইন বাস্তবায়ন হলে বিক্রি বেড়ে যাবে। সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতনতা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

বিজেএমসির আঞ্চলিক সমন্বয় কর্মকর্তা শেখ রহমত উল্লাহ জানান, বহির্বিশ্বে পাটের চাহিদা কমে গেছে। অর্থের অভাবে প্রয়োজনীয় কাঁচা পাট ক্রয় করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে উৎপাদিত পাট পণ্যের মজুদ বেড়ে গেছে। মজুদ পণ্য বিক্রি করতে পারলে মিলগুলোর সংকট কেটে যাবে। প্রয়োজনীয় পাট ক্রয় করতে পারবে। পাটের মোড়কীকরণ আইন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে স্থানীয় বাজারে পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাবে। সরকার এ বিষয়ে কাজ করছে। অল্প সময়ের ভেতরে এ সংকট সমাধান হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

মিল কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে কাঁচামাল হিসেবে মিলগুলির পাট কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৪৮ হাজার ৫৯৬ কুইন্টাল। কিন্তু গত চার মাসে কেনা হয়েছে মাত্র ৮১ হাজার ৬১০ কুইন্টাল। যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১১ শতাংশ। অর্থাভাবে চাহিদা মতো কাঁচা পাট ক্রয় করা সম্ভব হচ্ছে না। সম্ভব হচ্ছে না লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদনও। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হলে অর্থ সংকট কাটবে বলছে বিজেএমসি কর্তৃপক্ষ।

উল্লেখ্য, বর্তমানে স্থানীয় বাজারে পাট পণ্যের কিছুটা চাহিদা বেড়েছে। চাতাল মিলে প্রচুর পাট পণ্যের প্রয়োজন হয়। তবে ২০১০ সালের পাটের মোড়কীকরণের যে আইন আছে সেটি শতভাগ বাস্তবায়ন হলে স্থানীয় বাজারে আরও বেশি পাট বিক্রি করা সম্ভব হবে। মিলগুলো আধুনিক করার জন্য সরকারের উদ্যোগও রয়েছে। খুলনার প্লাটিনাম মিলসহ ৬টি মিলে বিএমআরই এর পরিকল্পনা রয়েছে। মিলগুলোতে বর্তমানে বিএমআরই-এর কোনো বিকল্প নেই।

এ সম্পর্কিত আরও খবর