মনবাসনা পূরণ করতেই ‘পদ্মপুরাণ’

খুলনা, জাতীয়

এস এম জামাল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 11:44:03

মনের বাসনা পূরণ করতেই গ্রামাঞ্চলে আয়োজন করা হয় পদ্মপুরাণ গানের। সাধারণত রাত জেগে মনসা-মঙ্গলের নাটক পরিবেশন করা হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গভীর রাত পর্যন্ত তাঁরা যা করেন, এর পুরোটাই নাচ-গান-নাটক। এ নাটক নামেমাত্র মঞ্চে পরিবেশন করা হয়।

বিশেষ করে মানুষকে যখন সর্পদংশনে তাড়া করে তখন মনের ভেতর জমে থাকা এসব আতঙ্ক তাড়ানোর জন্যই এই গানের আয়োজন করা হয়। আবার অনেকের ক্ষেত্রে চর্মজাতীয় ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ায় এসব সারানোর কোন উপায় না পেয়েও এই গানের আসর দিয়ে থাকেন।

এই পদ্মপুরাণ গানের জন্য একটি দলে ১০-১৫জনের সদস্য প্রয়োজন। ঢোলক বাদ্যের সঙ্গে আরও কিছু বাদ্যযন্ত্র নিয়ে কখনো গানের আসর আবার কখনো কথাকাব্য নিয়ে রচিত এই পদ্মপুরাণ গান। এজন্য কোনো মুখস্ত বিদ্যায় কিংবা বই পড়ে তাদের শিখতে হয়নি। শখের বসে আবার অনেকের ভালোলাগার থেকেই এই দলের সদস্য হিসেবে সম্পৃক্ত হয়। এ শিল্পীরা সরাসরি এই আসর মাতিয়ে রাখেন। দর্শক শ্রোতারাও বেশ উপভোগ করেন পদ্মপুরাণ।

এই পদ্মপুরাণ গানের মূল বিষয় হচ্ছে কালনাগিনীর দংশনে লক্ষীন্দরের মৃত্যু থেকে শুরু করে আগাগোড়া বেহুলারই কাহিনী। প্রথম দিকে একটানা সাপের গীত আর সাপের বর্ণনা। নানা প্রকার ও নানা জাতের বাস্তব ও কাল্পনিক সাপের বর্ণনায় পূর্ণ এই গানের প্রথম অংশ। শেষে বর্ণনা করা হয় ভুরা বা ভেলাভাসিয়ে বেহুলার ইন্দ্রপুরীতে গমন ও মৃত স্বামীর প্রাণ ফিরে পাওয়ার বর্ণনা। এভাবেই শেষ করতে হয় মুল অনুষ্ঠানের।

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার পোড়াদহ ইউনিয়নের তেঘরিয়া গ্রামের পদ্মপুরাণের নামকরা দলনেতা ছিলেন ফজর আলী মৃধা। তার নেতৃত্বে আশপাশ এলাকাসহ পার্শ্ববর্তী জেলায় পদ্মপুরাণ গানের নেতৃত্ব দিতেন। তারই শিষ্যত্ব লাভ করেন তার ছোটভাই ইউনুস আলী মৃধা।

শনিবার (২০ অক্টোবর) মিরপুর উপজেলার মশান গ্রামের জামাল উদ্দিনের বাড়ির আঙ্গিনায় এই গানের আসর বসে। দিনে এবং রাতে চলে একটানা এই গানের আসর।

ইউনুস আলী মৃধা বার্তা২৪.কমকে বলেন, পদ্মপুরাণ গানে দলে ১২-১৫জন থাকে। ঢোলকসহ অন্যান্য বাদকের পাশাপাশি একটি টিমের অন্তত ৩-৪ জন পুরুষকে শাড়ি পরিয়ে, চুল লাগিয়ে ও মেকাপ করে তাদের নারী সাজানো হয়। এভাবেই চলতে থাকে পুরো অনুষ্ঠান। দিন রাত মিলিয়ে আমাদের সম্পন্ন করতে হয় বেহুলা লক্ষীন্দরের আত্মকাহিনীকে কেন্দ্র করে নাটিকার পাশাপাশি গান করা হয়।

তবে এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে এক সপ্তাহ সময় লাগে। কিন্তু অর্থনৈতিক দৈনতার কারণে দুই রাত ও এক দিনের মধ্যেই শেষ করতে হয় আসর। গানের জন্য আমরা ৫-১২হাজার টাকা পর্যন্ত নেই।

পদ্মপুরাণ গানের সাথে কাজ করে আসা আরেক শিল্পী মিরা বার্তা২৪.কমকে জানান, পদ্মপুরাণকে আবার বা মনসার গান বলেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। পদ্মপুরাণ এ অঞ্চলের একটি উল্লেখযোগ্য কাব্য আলেখ্য। সাপের দেবীমনসা বা পদ্মার নাম অনুসারে এই নামকরণ। এই গান বর্ণনামূলক।

তিনি বলেন, যে মনসা দেবীকে পূজা দিতে চাননি চাঁদ সওদাগর, শত বছর ধরে বাঙালি সেই মনসা দেবীকে পূজা দিয়ে যাচ্ছে। শত বছর ধরে বংশ পরম্পরায় এ রীতি পালন করে আসছেন জনগণ। হিন্দু, মুসলমান সবাই। তাঁদের বিশ্বাস, এ সময় মা মনসার পূজা দিলে সারা বছর সাপ আর বিরক্ত করবে না তাঁদের। এমন সব কাহিনী নিয়েই এই পদ্মপুরাণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে।

এই দলের আরেক সদস্য নারী শাওন। যার ভুমিকা নারীর হিসেবে অভিনয় করা। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি রাইচ মিলে কাজ করি। পাশাপাশি নাচগান আমার কাছে ছোটবেলা থকেই ভালো লাগতো। তাই এই দলের সাথে মিশতাম। এখন শিল্পী হিসেবে পদ্মপুরাণ গানে অংশগ্রহণ করে থাকি। এই অনুষ্ঠান তো আর সারা মাস থাকে না। তাই কাজের পাশাপাশি সময় সুযোগ করেই অংশ নিয়ে থাকি। ২-৩দিন ধরে অনুষ্ঠান করলে আমি হাজারখানেক টাকা পেয়ে থাকি।

স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই মনসার গানের আয়োজন করলে সাপের কামড়ে পরিবারের কারো অকাল মৃত্যু ঘটবে না।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর