পরিত্যক্ত চুলে স্বপ্ন দেখছে শতাধিক পরিবার

খুলনা, জাতীয়

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-27 05:30:22

চুয়াডাঙ্গা: তিন বছর আগে ছাত্তার মিয়া বেকার যুবক ছিলেন। তবে এখন তিনি লাখ টাকার মালিক। ছাত্তারের মতো গ্রামের অনেক যুবকেরই জীবনে আজ এসেছে পরিবর্তন। এই অঞ্চলের মানুষ এক সময় দু’মুঠো ভাতের জন্য অন্যের বাড়িতে দিন মজুরের কাজ খুঁজত। কিন্তু আজ তাদেরই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে ১৫ থেকে ২৫ জন শ্রমিক।

মেয়েদের মাথার আঁচড়ানো পরিত্যক্ত চুলের ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হয়েছে গ্রামের শতাধিক বেকার নারী-পুরুষ। একটা সময় ছিল যখন মানুষের মাথার চুল কেটে সাধারণত ফেলেই দেওয়া হতো। কিন্তু কেউ ভাবেনি এই ফেলে দেওয়া চুল বিদেশে রফতানি করেই দেশ আয় করবে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। বর্তমানে ফেলে দেওয়া চুলকে ঘিরেই দেশে গড়ে উঠেছে কয়েকশ শিল্প প্রতিষ্ঠান। হাজার হাজার লোক নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করছে ফেলে দেওয়া চুলকে কেন্দ্র করে।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছোট জেলা চুয়াডাঙ্গা। জেলার দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গার পল্লীতে গড়ে উঠেছে শতাধিক ছোট বড় চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। এখান থেকে প্রক্রিয়াজাতকৃত এই চুল যাচ্ছে চীনসহ বিভিন্ন দেশে। উপজেলার বিভিন্ন বয়সের মানুষ স্থানীয়ভাবে ও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মেয়েদের মাথার পরিত্যক্ত চুল সংগ্রহ করে এসব কেন্দ্রে বিক্রি করে। ক্রয় করা এসব চুল বিশেষ ব্যবস্থায় প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করা হয় বিদেশি ক্রেতাদের কাছে। মেয়েদের মাথার আঁচড়ানো পরিত্যক্ত চুলের ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হয়েছে গ্রামের শতাধিক বেকার নারী-পুরুষ। আর চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রে কাজ করে বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পেয়েছে প্রতিবন্ধীসহ ৮ হাজার নারী-পুরুষ।

কার্পাসডাঙ্গা চুল সমিতির সভাপতি শহীদ বিশ্বাস জানান, এ সময় এক শ্রেণির দালাল পরিত্যক্ত চুল সংগ্রহ করে চোরাই পথে ভারতে পাচার করত। চুল সংগ্রহের কাজে তারা ফেরিওয়ালাদের ব্যবহার করত। চোরাচালান ব্যাপক আকার ধারণ করলে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে চুলসহ অনেকেই ধরা পড়ে। পরবর্তীতে বছর দশেক আগে বিদেশি বায়াররা সরাসরি যোগাযোগ করে কার্পাসডাঙ্গার চুল চোরাচালানকারী যুবকদের সঙ্গে। তারা প্রস্তাব দেয় ভালো চুল সরবরাহের জন্য।

এরপর থেকে গুটি কয়েক যুবক গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করতে থাকে নারীদের মাথার চুল। এই উঠতি যুবকরাই এক সময় চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত ছিল। চুল প্রক্রিয়াজাতের সঙ্গে জড়িত হয়ে সীমান্তে নানা অপরাধের পথ পরিহার করে বেকার যুবকরা এখন স্বাবলম্বী। চুল রফতানি করে চুয়াডাঙ্গা জেলার ৪০ হাজার মানুষের ভাগ্যের চাকা হয়েছে সচল।

চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবসায়ী মিদ্দার জানান, প্রথমে লোহার কাটা বা কাঁচি দিয়ে জড়ানো চুলগুলো ছাড়িয়ে লম্বা করে গোছা করা হয়। এরপর গোছাগুলো শ্যাম্পু দিয়ে একাধিকবার ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। শুকানোর পর বাছাই করে গাডার দিয়ে বেঁধে ছোট বড় আলাদা করে প্যাকেটজাত করে আনা হয় ঢাকায়। সর্বনিম্ন ৮ ইঞ্চি থেকে শুরু করে ৩০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা চুল বিক্রি হয়। ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত প্রতি কেজি চুল বিক্রি হয় ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা। এখান থেকে দেওয়া হয় সরাসরি বায়ারদের কাছে। বিদেশে এসব চুল দিয়ে ক্যাপ তৈরি ও টাক মাথায় হেয়ার প্ল্যান্টেশনসহ আরও নানা কাজে ব্যবহৃত হয়।

গ্রামের আরেক ব্যবসায়ী আবুল জানান, বর্তমানে এক কেজি লম্বা চুলের মূল্য ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। আর একজন চুল ব্যবসায়ী প্রতি মাসে আয় করেন এক থেকে দেড় লাখ টাকা। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিদিন অন্তত ৩ হাজার কেজি চুল আমদানি হয় চুয়াডাঙ্গায়। আর দেশের সবচেয়ে বড় চুলের হাট কার্পাসডাঙ্গায়। প্রথম প্রথম এলাকার মানুষ চুল সংগ্রহ করাকে ও এর সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের ছোট নজরে দেখত। তবে পরবর্তীতে তাদের সে ধারণা পাল্টে যায়।

জেলা প্রশাসক জিয়া উদ্দিন আহমেদ জানান, পরচুল প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এই জেলায় অনেক বেকার যুবকের জীবনে পরিবর্তন ঘটেছে। ছোট বড় গড়ে ওঠা শতাধিক চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা অন্য জেলার বেকার যুবদেরকে কর্মক্ষেত্রে উৎসাহী করবে।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর