ঘানি ভাঙা খাঁটি সরিষার তেলের খোঁজে

বিবিধ, লাইফস্টাইল

ফাওজিয়া ফারহাত অনীকা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, লাইফস্টাইল | 2023-12-12 19:58:54

এতো ভেজালের ভিড়ে বিশুদ্ধ কোন কিছু পাওয়া সত্যিই কষ্টকর।

দোকানে পাওয়া ‘খাঁটি সরিষার তেল’ এর উপর ভরসা রাখাটাও যেন বেশ সাহসিকতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ইদানিং। যে কারণে ব্যাকপ্যাক কাঁধে এক সকালে বেরিয়ে পড়া, ঘানি ভাঙা খাঁটি ও বিশুদ্ধ সরিষার তেলের খোঁজে।

গন্তব্য ছিল সাভার। ঢাকা থেকে এতোদূর যাওয়া যে উদ্দেশ্যে, সেখানে যাওয়ার জন্য প্রথমে নামতে হবে সাভার বাসস্ট্যান্ডে। এরপর রিকশা নিয়ে যেতে হবে সাভারের ‘দক্ষিন নামা বাজার’ এলাকায়। এই বাজারেই খোঁজ মেলে ঘানি ভাঙা সরিষার তেলের দোকানের। দোকানটির নাম রুবেল এন্টারপ্রাইজ।

 

নতুন এক অভিজ্ঞতা, নতুন কিছু দৃশ্য

দোকানে ঢুকতেই অপরিচিত দৃশ্যে আটকে যায় চোখ। কলুদ বলদের সাহায্যে ঘুরছে কাঠের তৈরি ঘানি। ঘানি ঘোরার সঙ্গে তাল রেখে ফোঁটায় ফোঁটায় চুইয়ে পড়ছে বিশুদ্ধ সরিষার তেল। কিছুক্ষণ পরপর ঘানির বলদ পরিবর্তন করছেন দায়িত্বরত ব্যক্তি। সরিষা শেষ হলে বস্তা থেকে নতুন সরিষা এনে দিচ্ছেন আবার। শহুরে চোখ এই দৃশ্যের সাথে পরিচিত নয়। অনেকটা অবাক ও কিছুটা উত্তেজনা নিয়ে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে গল্প করতে বসে পড়ি দোকানের মালিক মোঃ আরশাদ আলী-র সঙ্গে।

কথায় কথায় জানালেন, বিগত বিশ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি কাজ করছেন ঘানি ভাঙা সরিষার তেল নিয়ে। তার বাবাও এই ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে সাভারে তিনি নিজের দোকান দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন।

ইলেকট্রিক কলে নয়, কাঠের ঘানি ভাঙা তেলই বিশুদ্ধ!

নামা বাজারে বেশ কয়েকটি ইলেকট্রিক কলে ভাঙা সরিষার তেলের দোকান আছে। তার মাঝে আরশাদ আলীর দোকানটা যেন প্রাচীন ঐতিহ্যকে আগলে রেখেছে পরিশ্রম ও সততার সঙ্গে। তিনি জানান, কাঠের ঘানি ভাঙা তেল ও ইলেকট্রিক কলে ভাঙা তেলের ভেতর রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। পার্থক্যটা কেমন?

আমরা সবাই জানি যে খাঁটি সরিষার তেলের ঝাঁজ খুব কড়া হয়। আদতে ঘটনা ভিন্ন। একেবারে খাঁটি দেশীয় সরিষা কাঠের ঘানিতে ভাঙা হলে, সেই তেলের ঝাঁজ হয় খুবই কম। কিন্তু সুঘ্রাণ হয় তীব্র! যেখানে ইলেকট্রিক কলে পিষ্ট হয়ে ও অনেকটা পুড়ে যে সরিষার তেল পাওয়া যায়, তার সুঘ্রাণ তীব্র না থাকলেও, ঝাঁজ থাকে অনেক বেশি। কারণ, তেল তৈরির প্রক্রিয়ায় সরিষা পুড়ে তেল তৈরি হয়।

আরশাদ আলীর ছেলে মোঃ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গেও কথা হয় এই তেল নিয়ে। তিনি জানান, সদ্যজাত শিশুর শরীরেও এই তেল ব্যবহার করা যাবে নিশ্চিন্তে। একেবারে ঝাঁজবিহীন হওয়ায়, শিশুর শরীরে কোন জ্বালাপোড়া হবে না এবং শিশুর শরীরে তেলের সম্পূর্ণ পুষ্টিই শোষিত হবে।

সচেতন ক্রেতাদের পছন্দ যে সরিষার তেল

ষাট বছর বয়সী আরশাদ আলী ও আশরাফুল ইসলামের সাথে গল্প করার মাঝেই বেশ কয়েকজন ক্রেতা আসলেন সরিষার তেল কেনার জন্য। এর মাঝে একজন হলেন মোঃ ওহাব। ‘কেন এই সরিষার তেল কিনছেন? দোকানেও তো কত ধরণের সরিষার তেল আছে, ইলেকট্রিক কলে ভাঙা সরিষার তেলও আছে। সব কিছু বাদ দিয়ে এই তেল কেন’?

খুব আনন্দের সঙ্গে উত্তরে তিনি জানালেন, বিগত প্রায় বছর দশেক ধরে এই রুবেল এন্টারপ্রাইজ থেকে নিয়মিত সরিষার তেল কিনছেন তিনি। এই অভ্যাসে কোন ব্যতিক্রম হয়নি কখনো। ঘানি ভাঙা এই সরিষার তেল ছাড়া অন্য সরিষার তেলের রান্না তিনি খেতে পারেন না, ব্যবহারও করতে পারেন না।

মোঃ ওহাবের কথার জের ধরে আরশাদ আলী জানালেন, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তো বটেই দেশের বাইরেও তার তেলের কদর ও চাহিদা রয়েছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ি উৎপাদন নেই। ক্রেতাদের চাহিদার জোগান দিতেই হিমসিম খেতে হয় তাদের।

যে কারণে ইলেকট্রিক ঘানি নয়, কাঠের ঘানি ভাঙা সরিষার তেলের ব্যবসা

আরশাদ আলীর কাছে প্রশ্ন করেছিলাম, এই কাঠের ঘানি ভাঙা সরিষার তেল বিক্রির পাশাপাশি ইলেকট্রিক কল দিয়ে সরিষার তেল তৈরির পরিকল্পনা আছে কিনা তার। উত্তরে মিষ্টি হেসে জানালেন, যতদিন তিনি বেঁচে থাকবেন, যতদিন তার এই ব্যবসা থাকবে- ততদিন এই কাঠের ঘানি ভাঙা সরিষার তেল বিক্রি করেই কাটাবেন।

দিনে তিন মণ সরিষা থেকে ৪৫-৫০ কেজি তেল তৈরি হয়। যেখানে ইলেকট্রিক কলে তিন মণ সরিষা থেকে প্রায় দেড়শ কেজি তেল তৈরি করা সম্ভব। এই কারণে তেলের দামটাও একটু বেশি পড়ে তার। প্রতি কেজি ২২০ টাকা। দামটা চড়া হলেও, বিশুদ্ধতার নিশ্চয়তা থাকায় ক্রেতারা তার কাছ থেকেই নিতে চান সরিষার তেল।

খুব প্রফুল্ল ও গর্বভরে তিনি আরও জানান, আজতক দেশী ও বিদেশি সরিষা মিশিয়ে তেল তৈরি করেননি তিনি। যে কারণে পরিচিত মহলে তার বেশ সুনাম রয়েছে। তার পরিশ্রম ও সততার স্থানে কোন আঁচ কখনোই আসতে দেননি বলেই, ক্রেতাদের কাছ থেকে পেয়েছেন অফুরান ভালোবাসা।

এই সকল কারণে নিজের ছোট ব্যবসার পরিসরের মাঝেই, কাঠের ঘানিতে ভাঙা বিশুদ্ধ ও খাঁটি সরিষার তেলই বিক্রি করে যেতে চান সবসময়। তার ছেলে আশরাফুল ইসলামেরও ইচ্ছা আছে বাবার হাতে গড়ে ওঠা এই ব্যবসার হাল ধরে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।

গল্পে গল্পে দিন গড়ালে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিদায় নিতে হয় তাদের কাছ থেকে। ফেরার পথে অবাক হয়ে ভাবতে হয়, এখনও কেউ খুব যত্নে আগলে রেখেছে নিজের হাতে গড়ে তোলা সীমিত লাভের ব্যবসা। যার সাথেই কিনা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্যের দারুন একটি দিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর