‘মানহানি’তে হাতিয়ার এখন সাইবার আইন

, আইন-আদালত

নাজমুল আহসান রাজু, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-09-01 22:48:52

পাঁচ বছর আগেও মানহানির অপরাধের প্রতিকার ফৌজদারি দণ্ডবিধি নির্ভরই ছিল। সেই নির্ভরতা আর নেই বললেই চলে; সংক্ষুব্ধদের বেশিরভাগ এখন সমাধান খুঁজছেন ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। কারণ, ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইনে (পেনাল কোড) মানহানি জামিনযোগ্য ও প্রতিকার সময়সাপেক্ষ। যেখানে ডিজিটাল আইনে মামলার পরপরই বিবাদীকে গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ করার অবারিত সুযোগ রয়েছে। ফলে মানহানির মামলায় দণ্ডবিধির বিকল্প হয়ে ওঠেছে নতুন এই আইন। এর আগে ২০১৩ সালে সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর দণ্ডবিধির পরিবর্তে ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারায় মানহানির এসব মামলা হতো।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সাজা ও জরিমানা বেশি হওয়ায় গত পাঁচ বছরে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় সংবাদপত্রের সম্পাদক, প্রকাশক, প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১০২টি। এ সময়ে ৩৩টি মামলা হয়েছে দণ্ডবিধিতে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং অধিকারের তথ্য অনুসারে, এ পাঁচ বছরে মামলা হয়েছে ১৩৫টি। এর মধ্যে চলতি বছরে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ১২টি, ২০১৮ সালে ১৫টি, ২০১৭ সালে ৭টি , ২০১৬ সালে ৩১ টি, ২০১৫ সালে ১৮টি ও ২০১৪ সালে ৩৩টি মামলা হয়েছে।

ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের দুই মাসে মানহানির ৮৩ ও রাষ্ট্রদ্রোহের ১২টি মামলা হয়েছে। গত বছর ২২ অক্টোবর ডিজিটাল আইনে গ্রেফতার হয়েছিলেন একটি ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক। তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনের ২৫ ও ২৯ ধারায় ২২টি মামলা হয়েছিল। সর্বশেষ গত ৩ সেপ্টেম্বর মানহানির মামলায় দ্বিতীয় দফায় এ সম্পাদককে কারাগারে পাঠান আদালত। অবশ্য একই আদালত তিনদিন পর তার জামিন মঞ্জুর করলে কারামুক্ত হন তিনি।

আইসিটি আইনের ১০২ মামলার সবকটিই বিতর্কিত ৫৭ ধারায় করা। সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশ আর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় মামলার পর ৫৭ ধারার ‘অপব্যবহার ও হয়রানির’ বিষয়টি দেশে-বিদেশে সমালোচিত হয়। ডিজিটাল আইন কার্যকর হওয়ার পর ২৪, ২৫, ২৯ ও ৩১ ধারা প্রয়োগ হচ্ছে মানহানির মামলায়।

আইনজীবীরা জানিয়েছেন, সাইবার আইনে মামলার পর চটজলদি বিবাদীকে গ্রেফতার এবং কারারুদ্ধ করার অবারিত সুযোগ থাকায় এ ধারাগুলোতে মামলা করতে উৎসাহী হচ্ছে বাদীপক্ষ। আইনজীবীরাও বাদীর ক্ষোভকে কাজ লাগিয়ে ‘শর্টকাট’ প্রতিকার পাইয়ে দিতে ৫৭ ধারার পর ২৮, ২৯ ধারায় মামলা রুজুতে উদ্ধুদ্ধ করছেন।

দেশে মানহানি দেওয়ানি ও ফৌজদারি অপরাধ। ফৌজদারি ব্যবস্থায় দণ্ডবিধির ৫০০, ৫০১ ও ৫০২ ধারায় মানহানির মামলার প্রতিকারের সুযোগ রয়েছে। দেওয়ানি ব্যবস্থায় মানহানির জন্য ক্ষতিপূরণ চাওয়া যায়। ফৌজদারিতে মানহানি লঘু একটি অপরাধ। এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মাত্র ২ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড। ফৌজদারি কার্যবিধির ২ নম্বর তফসিল অনুসারে এটি জামিনযোগ্য, আমলঅযোগ্য এবং আপোষযোগ্য অপরাধ। তবে নিম্ন আদালতে মানহানির মামলা নিষ্পত্তির নজির খুবই কম।

বর্তমানে দেশের শতভাগ গণমাধ্যমেরই ডিজিটাল মাধ্যমে আছে। ছাপা সংবাদপত্রের রয়েছে অনলাইন ও ই-পেপার। প্রায় সব টেলিভিশনের অনলাইন ভার্সন রয়েছে। আর অনলাইন নিউজ পোর্টাল তো আছেই। ডিজিটাল মাধ্যমে সংবাদ প্রচার ও প্রকাশ নিয়ে করা মানহানি মামলা ৫৭ ধারার আওতায় পড়ে। এ ধারাটি অজামিনযোগ্য এবং আমলযোগ্য। সাজা অনধিক ১৪ বছরের এবং অন্যূন ৭ বছরের। অর্থদণ্ড রয়েছে ১ কোটি টাকার। এ ধারায় মামলা করার পরপরই আইন শৃঙ্খলাবাহিনী বিবাদীকে গ্রেফতার করার নজির ভুরি ভুরি। আর এ কারণেই ৫৭ ধারায় মামলার হিড়িক পড়েছিল।

৫৭ ধারা বিলুপ্তির পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় মানহানি মামলা হচ্ছে। মামলায় জুড়ে দেওয়া হচ্ছে ২৮ ধারাও। ২৮ ধারায় ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুভূতিতে আঘাতের সাজা পাঁচ বছর ও অর্থদণ্ড ১০ লাখ টাকা। ২৯ ধারায় মানহানির তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের সাজা তিন বছর ও পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার মো. মাসুদ আহমেদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৪, ২৫, ২৯ ও ৩১ ধারায় দৈনিক ‘সময়ের আলো’ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম রতন, মফস্বল সম্পাদক, সময়ের আলোর শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি হৃদয় দেবনাথ, অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগো নিউজের জেলা প্রতিনিধি রিপন দে’সহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর আগে ‘কোটিপতি শ্রমিকের আলীশান বাড়ী’ শিরোনামে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন হৃদয় দেবনাথ। পরে গত ১১ জুন দৈনিকে সময়ের আলো পত্রিকায় ‘পেশায় দিনমজুর সম্পদ কোটি টাকার’ এবং জাগোনিউজে ১০ জুন ‘পত্রিকার হকার থেকে কোটিপতি, বানালেন রাজকীয় বাড়ি’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় তাদের বিরুদ্ধে মামলাটি হয়।

সাংবাদিক ও কলাম লেখক আফসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ৮ জুন ৫৭ ধারায় মামলা হয়। একই বছরের ১২ জুন হাইকোর্ট থেকে চার সপ্তাহের আগাম জামিন পেয়ে কারারুদ্ধ হওয়া এড়াতে সক্ষম হন তিনি। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় করা এ মামলায় ফেইসবুকে অসত্য বক্তব্য দেয়ার অভিযোগ করা হয়। ঢাকার তেজগাঁও লিংক রোডের পিকাসো রেস্টুরেন্টের অন্যতম মালিক বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণের মামলার অন্যতম আসামি সাদমান সাকিফের বাবা মোহাম্মদ হোসেন জনি। আফসান চৌধুরীর ফেসবুক স্ট্যাটাসে সাদমান সাকিফের বাবা হিসেবে মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী উল্লেখ করায় মামলাটি করা হয়।

২০১৭ সালের ৬ জুলাই আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় দৈনিক সকালের খবরের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাবেক সহ-সভাপতি আজমল হক হেলালসহ দুইজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন পিরোজপুরের রুস্তম আলী ফরাজী কলেজের প্রভাষক মো. ফারুক হোসেন। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রুস্তম আলীকে নিয়ে একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস শেয়ার করাকে কেন্দ্র করে মঠবাড়িয়া থানায় এ মামলা দায়ের করা হয়। মামলার পাঁচদিন পর হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নেন আজমল হক হেলাল।

ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট ফরিদপুরের সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে আইসিটি আইনের মামলায় গ্রেফতার করা হয়। তিনি অনলাইন নিউজ পোর্টাল উত্তরাধিকার ৭১ এর সম্পাদক। সমালোচনার মুখে ২০ আগস্ট জামিন পেয়ে কারামুক্ত হন তিনি।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিকের সঙ্গে। তিনি বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, আইনগত প্রতিকারের আরো উপায় থাকা সত্বেও সবাই ডিজিটাল আইনে ঝুঁকছেন। এর কারণ যার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে তাকে হয়রানি করা। মানহানির মামলার কারণে সব ধরনের মুক্তচিন্তা ও বাকস্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় যে মামলাগুলো করা হয়েছিল সবকটিই ছিল হয়রানির জন্য করা। ৫৭ ধারা থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮, ২৯ ও ৩২ ধারার উৎপত্তি। এই তিনটি ধারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক। মানহানির মামলা যদি করতে হয় তাহলে দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিধান রয়েছে। তা না করে ৫৭ ধারায় এবং ডিজিটাল আইনে করা মামলার উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর