হয়নি আপিল ট্রাইব্যুনাল, ভরসা হাইকোর্ট

, আইন-আদালত

নাজমুল আহসান রাজু, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-09-01 18:38:02

২০০৬ সালের আইনেই সাইবার আপিল ট্রাইব্যুনালের বিধান ছিল। এরপর ২০১৮ সালের ডিজিটাল আইনেও সে বিধান রাখা হয়। মাঝে ২০১৩ সালে সাইবার ট্রাইব্যুনাল যাত্রা শুরুর এক বছরের মধ্যে একাধিক রায়ও হয়েছে।  তবে হয়নি সেই আপিল ট্রাইব্যুনাল। ফলে সাইবার ট্রাইব্যুনালের রায় বা আদেশে কেউ সংক্ষুব্ধ হলেও তার বিরুদ্ধে আপিল করতে পারছেন না।

যেখানে এ ধরণের অন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে আপিল ট্রাইব্যুনাল আছে। সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলায় আপিল ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় ভরসা করতে হয় শুধু হাইকোর্টকে। সেখানেও রয়েছে বিপত্তি। কারণ ফৌজদারি অপরাধের এখতিয়ারবান হাইকোর্টের বেঞ্চ সাইবার মামলার বিষয়ে শুনতে চান না।

২০১৭ সালের ফরিদপুরের একটি মামলায় পুলিশের দেওয়া ফাইনাল রিপোর্ট (চূড়ান্ত প্রতিবেদন) নিয়ে বাদী পক্ষ সংক্ষুব্ধ। তাদের নারাজি আবেদন খারিজ হয়েছে সাইবার ট্রাইব্যুনালে। আপিল ট্রাইব্যুনাল না থাকায় ন্যায়বিচার পেতে একমাত্র হাইকোর্টে যাওয়ার পথই তাদের জন্য খোলা ছিল। পরে তারা হাইকোর্টে ফৌজদারি রিভিশন আবেদন করেন।

একইভাবে ট্রাইব্যুনালে মামলা নিষ্পত্তি, রায়ে সাজা বা জরিমানা বৃদ্ধি করতে এবং খালাসের বিরুদ্ধে বাদী-বিবাদী পক্ষের আপিল বা রিভিশনের সুযোগ না থাকায় দারুন ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে তাদের মতো অনেককেই। আইসিটি আইনে ৭৫২ টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, ১৫টি মামলায় রায়ে সাজা হয়েছে ১৯ জনের। ৯১ মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। এসবের বিরুদ্ধে একমাত্র হাইকোর্টে যাওয়ার সুযোগ ছিল উভয়পক্ষের। যেখানে আপিল ট্রাইব্যুনাল থাকলে হাইকোর্টে যেতে হতো না কাউকেই।

আইনে সাইবার আপিল ট্রাইব্যুনালের বিধান থাকার পরেও তা গঠন না করায় বিষয়টিকে ন্যায়বিচারের পরিপন্থী হিসেবে দেখছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন না করা আইনের বরখেলাপ। আইনের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য আইন এ বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত সাইবার আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করার পক্ষে মত দিয়েছেন তারা।

আরও পড়ুন: সাত বছরে ২৬৫১ মামলা সাজা ১৫টিতে

পুলিশের ফাইনাল রিপোর্টেই শেষ ৩৩৪ মামলা

আইসিটি আইনের তৃতীয় অংশে সাইবার আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন, ইত্যাদি অংশের উল্লেখ রয়েছে। ৮২ (১) উপধারায় বলা হয়েছে, সরকার  প্রজ্ঞাপন দ্বারা এক বা একাধিক সাইবার আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। দফা (২) বলা হয়েছে আপিল ট্রাইবুনালে সরকার নিযুক্ত একজন চেয়ারম্যান এবং দুইজন সদস্যকে নিয়ে গঠিত হবে। (৩) দফায় বলা হয়েছে আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এমন একজন ব্যক্তি হবেন যিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ছিলেন, বা বিচারক নিযুক্তের যোগ্য এবং সদস্য হবেন যিনি বিচার কর্মবিভাগের কর্মকর্তা অথবা অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ বা অন্যজন হবেন আইসিটি বিষয়ে নির্ধারিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ। তাদের মেয়াদ হবে অন্যূন তিন বছর এবং অনুর্ধ্ব পাঁচ বছর।

এখতিয়ার ও পদ্ধতি রয়েছে ৮৩ ধারায়। এ ধারার (১) দফায় বলা হয়েছে সাইবার ট্রাইব্যুনাল এবং ক্ষেত্রমতে দায়রা আদালতের রায় ও আদেশের বিরুদ্ধে আপিল শোনা ও নিষ্পত্তির এখতিয়ার ট্রাইব্যুনালের থাকবে। আপিল শোনা এবং নিষ্পত্তিতে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করবে আপিল ট্রাইব্যুনাল। বিধি না থাকলে হাইকোর্ট বিভাগের ফৌজদারি আপিল শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য যে পদ্ধতি অনুসৃত হয়ে থাকে তা অনুসরিত হবে। সাইবার ট্রাইব্যুনালের রায় বা আদেশ বহাল, বাতিল, পরিবর্তন বা সংশোধন করার ক্ষমতা থাকবে আপিল ট্রাইব্যুনালের।

আরও পড়ুন: একমাত্র ট্রাইব্যুনালে সারা দেশের চাপ

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, আইসিটি আইন ও ডিজিটাল আইনের অপপ্রয়োগ হয়ে আসছে। এ জন্য বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি কমাতে আইনের বিধান অনুসরণ করে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত। তাহলে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে সেখানে ন্যায়বিচারের আশায় যেতে পারবেন।

সাইবার আপিল ট্রাইব্যুনালের অনুপস্থিতিতে হাইকোর্টে আপিল করতে হচ্ছে সংক্ষুব্ধদের। আইনের ৮৪ ধারায় বলা হয়েছে ‘এই অংশের অধীন কোন সাইবার আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠিত না হলে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, দায়রা আদালত বা ক্ষেত্রমত, সাইবার ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত রায় ও আদেশের বিরুদ্ধে আপিল হাইকোর্ট বিভাগে করতে হবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাইকোর্টে ফৌজদারি আপিল বা রিভিশনের তিনটি বেঞ্চ রয়েছে। সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিষয়ে বেঞ্চের পক্ষ থেকে শুনানি গ্রহণে অপরাগতা প্রকাশ করা হয়েছে শুধুমাত্র ডিজিটাল মাধ্যমের সক্ষমতা না থাকায়। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ সাইবার ট্রাইব্যুনালের রায় বা আদেশে বিরুদ্ধে আপিল বা দরখাস্তের শুনানি গ্রহণ করেন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার জ্যেতির্ময় বড়ুয়া বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেছেন, সাইবার ট্র্ইাব্যুনাল যে আইনে কাজ করছে সে আইনেই আপিল ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। একটি গঠন করা হলেও অপরটি করা হয়নি। অথচ আপিল ট্রাইব্যুনাল না থাকা নিয়ে কোন কথা হচ্ছে না।

তিনি বলেন, কেউ ট্রাইব্যুনালের আদেশ বা রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে তারা যাবেন কোথায়? উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে বলছি অনেক বেঞ্চ এ বিষয়ে অভিজ্ঞ নয় বলে আগ্রহী হন না। অনেক আগেই আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত ছিল। এটা না করা প্রতারণার শামিল।

এ সম্পর্কিত আরও খবর