রিফাত হত্যা: হাইকোর্টে মিন্নির জামিন

, আইন-আদালত

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-08-30 16:24:05

বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে স্থায়ী জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। জামিনে থাকা অবস্থায় মিন্নি তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের জিম্মায় থাকবে। তবে এ সময়ে মিন্নি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারবে না। গণমাধ্যমের সামনে কথা বললে তার জামিন বাতিল হবে।

মামলার তদন্ত পর্যায়ে গণমাধ্যমে কতটুকু প্রচার বা প্রকাশ করা যাবে সে বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) কেন জামিন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ স্থায়ী জামিনের এ রায় দেন। রায়ের সময় মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

আদালতে মিন্নির পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন। বিশেষজ্ঞ হিসেবে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী মিন্নির শুনানিতে অংশ নেন। মিন্নির আইনজীবীকে সহায়তা করেন আইনজীবী জেসমিন সুলতানা ও জামিউল হক ফয়সাল। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারোয়ার হোসাইন বাপ্পী।

রায়ে আদালত জামিন অংশে বলেছেন, এজাহারে আসামির নাম উল্লেখ না থাকা, গ্রেফতার পূর্ব অব্দি দীর্ঘ সময়ে স্থানীয় পুলিশ লাইনসে আটক এবং গ্রেফতারের প্রক্রিয়া, আদালতে হাজির করে রিমান্ড শুনানির সময়ে আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ না পাওয়া, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আসামির দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক লিপিবদ্ধ করার পূর্বেই আসামির দোষ স্বীকার সম্পর্কিত জেলা পুলিশ সুপারের বক্তব্য, তদন্তকারী কর্মকর্তার মতে মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। সুতরাং আসামিকে কর্তৃক তদন্ত প্রভাবিত করার কোনো সুযোগ না থাকায় সর্বোপরি ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৭ ধারার ব্যতিক্রম অর্থাৎ আসামি একজন মহিলা। এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে আমরা তাকে জামিন দেওয়া ন্যায়সঙ্গত মনে করছি।  জারি করা রুলটি আমরা যথাযথ ঘোষণা করলাম রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন,  আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি রিমান্ডে থাকা অবস্থায় বরগুনা জেলা পুলিশ সুপার  মারুফ হোসেন গণমাধ্যমের মুখোমুখী হন। মিন্নি দোষ স্বীকার করেছেন মর্মে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা শুধু অযাচিত অনাকাঙ্খিত নয় বরং ন্যায় নীতি সুষ্ঠ এবং নিরপেক্ষ তদন্তের পরিপন্থী।

আদালত বলেন, পরিস্থিতি ও বাস্তবতা যাই হোক না কেন কোন পুলিশ সুপারের মত দায়িত্বশীল পদে থেকে এ ধরনের বক্তব্য জনমনে নানান প্রশ্ন জন্ম দিয়েছে। একদিকে যেমন জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন তেমনি তিনি তার দায়ীত্বশালতা ও পেশাদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, তা দুঃখজনক এবং হতাশাজনক। উচ্চ পর্যায়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তার নিকট হতে এ ধরনের কাজ প্রত্যাশিত এবং কাম্য নয়। ভবিষ্যতে দায়িত্ব পালনে আরও সতর্কতা ও পেশাদারিত্বের পরিচায় দেবেন আদালতের এটাই কাম্য।

মামলাটি তদন্ত কাজ যেহেতু এখনও চলমান সে কারণে এই মুহূর্তে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে আদালত বিরত থাকছে। তবে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক সময়মত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।

প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা সঙ্গত হবে যে, ইদানিং প্রায়শ লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, সংগঠিত আলোচিত ঘটনার তদন্তকালীন সময়ে পুলিশ, র‌্যাবসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতারকৃত অভিযুক্তদের বিষয়ে এবং তদন্ত সম্পর্কে প্রেস ব্রিফিং করা হয়ে থাকে। গ্রেফারকৃত সন্দেহভাজন বা অভিযুক্তদের কোনো নিয়মনীতি ছাড়াই গণমাধ্যমে সামনে হাজির করা হয়, যা অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে। যদিও বা এ বিষয়ে অত্র আদালত একটি রায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।

পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়, অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে তদন্ত বিষয়ে অতি উৎসাহ নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য দিতে দেখা যায়। একথা আমাদের সকলেকেই মনে রাখতে হবে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে অভিযোগ প্রমাণিত না হচ্ছে, ততক্ষণ বলা যাবে না সে অপরাধী বা অপরাধ করেছে। তদন্ত বা বিচার পর্যায়ে এমনভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করা উচিত নয় যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধী। সে কারণে মামলার তদন্ত পর্যায়ে তদন্তের অগ্রগতি বা গ্রেফতারকৃতদের বিষয়ে গণমাধ্যমে কতটুকু বিষয় প্রচার বা প্রকাশ করা যাবে সে বিষয়ে একটি নীতিমালা করা বাঞ্ছনীয়। এই নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রচারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশ প্রদান করা হলো।

বুধবার (২৮ আগস্ট) মিন্নিকে কেন জামিন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে জারি করা রুলের ওপর শুনানি হয় হাইকোর্টে। শুনানিতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর মামলার নথি নিয়ে হাজির হন। শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার আদেশের দিন ধার্য করা হয়েছিল।

এর আগে ২০ আগস্ট মিন্নিকে কেন জামিন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ২৮ আগস্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে সিডি (কেস ডকেট) নিয়ে হাইকোর্টে হাজির হতে বলা হয়। এছাড়া মিন্নির দোষ স্বীকার নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে পুলিশ সুপারকে (এসপি) লিখিত ব্যাখ্যা দিতেও বলা হয়।

গত ৮ আগস্ট বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের অবকাশকালীন দ্বৈত বেঞ্চ মিন্নির জামিন না দিয়ে রুল জারি করতে চাইলে আইনজীবীরা আবেদন ফেরত নেন। এরপর গত ১৮ আগস্ট হাইকোর্টের রায় প্রদানকারী বেঞ্চে এটি দাখিল করা হয়।

২৬ জুন প্রকাশ্য দিবালোকে বরগুনা সরকারি কলেজ রোডে রিফাত শরীফকে কোপাতে থাকে সন্ত্রাসীরা। স্ত্রী মিন্নি রিফাতকে রক্ষার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। পরে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ২ জুলাই ভোরে প্রধান অভিযুক্ত নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।

১৬ জুলাই সকালে মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বরগুনার পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রিফাত হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ওই দিন রাত ৯টার দিকে মিন্নিকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর