‘এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা’

, কলকাতা

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 21:42:40

‘এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা।’ আশ্চয শহর কলকাতা প্রসঙ্গে বলেছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। সেই কোনকালে সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতা নামে তিনটি গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠা একটি শহর কলকাতার ভেতরে লুকিয়ে আছে অনেকগুলো শহর। এক কলকাতাকে দেখতে গেলে ভেসে ওঠে আরও অনেক কলকাতার মুখচ্ছবি। ইতিহাসের কলকাতা যেন অনেকগুলো মুখের কোলাজে পূর্ণ একটি বড় ক্যানভাস।

কলকাতা সপ্তদশ শতকের শেষভাগ অবধি ছিল বাংলার নবাবদের শাসনে। ১৬৯০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাবদের কাছ থেকে বাণিজ্য-সনদ পেয়ে কলকাতায় স্থাপন করে বাণিজ্যকুঠি। ঘটতে থাকে কলকাতার সমৃদ্ধি। ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ কলকাতা দখল করলেও তা ধরে রাখতে পারেন নি। পরের বছরই ইংরেজ কোম্পানি ফের দখল করে নেয় কলকাতা।

তারপর আস্তে আস্তে বাংলায় প্রতিপত্তি বাড়িয়ে ১৭৯৩ সালে কোম্পানি বাংলার যাবতীয় ‘নিজামৎ’ বা স্বায়ত্তশাসনের অবলুপ্তি ঘটিয়ে কায়েম করে তাদের মৌরসি পাট্টা। কোম্পানির শাসন এবং ব্রিটিশ রাজশক্তির প্রত্যক্ষ শাসনের প্রথমার্ধে কলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী। ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে কলকাতা অবিভক্ত বাংলা প্রদেশের রাজধানী ছিল।

কলকাতা যখন সমগ্র ভারতের রাজধানী, তখন ভারতবর্ষের ইংরেজ গর্ভনর জেনারেল-ভাইসরয় রাজধানী কলকাতাতেই বছরের আংশিক সময় থাকতেন। শীতকালের পাঁচ মাস ছিল তাঁর কলকাতা উপস্থিতি। তারপর উষ্ণকালটুকু তিনি থাকতেন ব্রিটিশ-ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী সিমলায়। এক অর্থে ভারতবর্ষের রাজধানী ছিল কলকাতা ও সিমলা। রাজপুরুষদের সিমলা-কলকাতা যাতায়াত ছিল। সাধারণত অক্টোবর মাসের শেষের দিকে বা নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে সিমলা নামক হিল টাউন থেকে সরকারি কর্তারা সকলেই নেমে আসতেন। সিমলা থেকে কলকাতা আসাকে সাধারণ মানুষ বলতেন ‘নেমে আসা’।

ভারতবর্ষের রাজধানীর পাশাপাশি অবিভক্ত বাংলা প্রদেশের রাজধানীও ছিল কলকাতা। তবে সেটা মূল কলকাতায় নয়, আলিপুরে। চিড়িয়াখানার কাছে বেলভিডিয়ার নামের যে জায়গাটিতে বাংলার শাসক লেফটেন্যান্ট গর্ভনর থাকতেন, সে প্রাসাদের শুদ্ধ উচ্চারণ হলো বেলভেডেরে। বেলভিডিয়ার নয়। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার একটি প্রাসাদের অনুকরণে নির্মিত বাড়িটির নাম রাখা হয়েছিল বেলভেডেরে।    

প্রাচীন ও অভিজাত ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের জন্য কলকাতাকে ‘প্রাসাদ নগরী’ও বলা হতো। বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ১৩৮ কিলোমিটার উত্তর দিকে হুগলি (ভাগীরথী) নদীর বাম (পূর্ব) তীরে অবস্থিত শহরটি অন্য তিন দিকে অখণ্ড চব্বিশ পরগণা জেলা দ্বারা স্থলবেষ্টিত, যে জেলাটি বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন। এখন অবশ্য চব্বিশ পরগণা উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত করে দুটি জেলায় পরিণত করা হয়েছে।

কলকাতার ঘটনাপ্রবাহ বড়ই বিচিত্র, প্রাণবন্ত, নস্টালজিক। কঠিনে-কোমলে মেশানো এমন সজীব ও উপভোগ্য ইতিহাস খুব বেশি শহরের নেই। সেই কলকাতা তার সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিল্পকলা, জনসমাজ, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য ইত্যাদি সব দিকেই লাভ করেছিল নিজস্ব উৎকর্ষ আর আশ্চয বিস্তৃতি। যেন একটা কলকাতার মধ্যেই পরতে পরতে বিন্যস্ত হয়েছিল অনেকগুলো কলকাতা।

নর্থ, সেন্ট্রাল ও সাউথ কলকাতা আলাদা আলাদা অস্তিত্ব নিয়ে সমগ্র কলকাতার অংশ হয়ে আছে। যদিও আদিতে নর্থ বা উত্তর কলকাতা বলে কোনও এলাকা ছিল না। দক্ষিণ কলকাতার লোকেরা এখন যাকে নর্থ কলকাতা বলেন, সেটাই একমাত্র কলকাতা ছিল। বাকীটা ছিল শহরতলী। ঢাকুরিয়া, যাদবপুর, গড়িয়া, বৈষ্ণবঘাটা দূরে থাকুক, তখন ভবানীপুর, কালীঘাট, টালিগঞ্জ, আলিপুর, খিদিরপুর, বালিগঞ্জ প্রভৃতি এলাকাকে কলকাতার অংশ বলা হতো না। এগুলো ছিল দক্ষিণের উপকণ্ঠ। আবার শিঁথি, বরাহনগর, বেলঘরিয়া, দমদম, নাগের গাঁও, ব্যারাকপুর প্রভৃতি এলাকা আজকাল উত্তর কলকাতার অংশ বলে বিবেচিত হলেও সেগুলো ছিল উত্তর প্রান্তীয় উপশহর। 

কলকাতা আসলে ছিল লোয়ার সার্কুলার রোড এবং আপার সার্কুলার রোডের মধ্যকার জায়গাটুকুতে। সে কলকাতার আবার তিনটি ভাগ ছিল। একটি হলো ধর্মতলা আর চৌরঙ্গীর মোড় হতে লোয়ার সার্কুলার পযন্ত। এ অঞ্চলকে বলা হতো সাহেব পাড়া। এর পূর্ব দিকে পার্ক স্ট্রিট, পার্ক সার্কাস অঞ্চলে ছিল মুসলমানদের অধিবাস। ধর্মতলার উত্তরে শ্যামবাজার-বাগবাজার পযন্ত ছিল হিন্দু অধিবাসীদের বসবাস। শুধু মানুষ বা সমাজ নয়, তিনটি অংশই কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক বিন্যাসের দিক থেকে পৃথক ছিল। ব্রিটিশ শাসিত কলকাতার মূল চৌহদ্দি বলতে এগুলোকেই চিহ্নিত করা হতো।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ঔপনিবেশিক কলকাতায় এসে আশ্রয় নেন ইংরেজের শক্তি ও ষড়যন্ত্রে রাজ্যহারা তিনটি নবাবের পরিবার। শহরের উত্তর অংশের চিৎপুরে বসতি গড়েন একদা বাংলার প্রশাসক রেজা খানের বংশধরবৃন্দ। যে রেজা খান পলাশী-পরবর্তী বাংলার শাসনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দক্ষিণ অংশের টালিগঞ্জে মহিশূরের বীর টিপু সুলতানের বংশধরবৃন্দ বাস করেন। এবং দক্ষিণ-পশ্চিম কলকাতার নদী তীরবর্তী মেটিয়াবুরুজে বসতি স্থাপন করেন অযোধ্যার রাজ্যহারা নবাব আবুল মনসুর মির্জা মহম্মদ ওয়াজিদ আলী শাহ’র পরিবারবর্গ। 

মাত্র নয় বছর স্বদেশ লক্ষ্ণৌ শাসনের পর রাজ্য হারিয়ে নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ (১৮২২-১৮৮৭) তিরিশ বছর ছিলেন কলকাতায়। তখন আর তিনি রাজনীতির কেউ নন। তবু তিনি কলকাতায় নবাবের মতোই বেঁচে ছিলেন স্বনির্মিত শিল্প-সংস্কৃতির বলয়ে। বিরিয়ানি থেকে সরোদ শিখিয়েছিলেন তিনি কলকাতাকে। দিল্লির পর যে লক্ষ্ণৌ হয়েছিল ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী, সেখান থেকে এসেছিলেন নবাব। রাজ্যহারা নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ জীবনের শেষটুকু নবাবি হালেই কাটিয়েছিলেন কলকাতাতে। মেটিয়াবুরুজে বানিয়েছিলেন মিনি লক্ষ্ণৌ। সময় যত এগোচ্ছে, কলকাতা শহরের ওপর তাঁর সাংস্কৃতিক প্রভাব তত ফুটে উঠছে।

একদা শ্রীপান্থ ‘মেটিয়াবুরুজের নবাব’ নামে ওয়াজিদ আলী শাহ’কে নিয়ে প্রথম বই লিখেছিলেন। এখন আরও অনেকেই লিখছেন— ইংরেজি-বাংলা, দুই ভাষাতেই। ‘দ্য লাস্ট কিং ইন ইন্ডিয়া: ওয়াজিদ আলি শাহ’ নামে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন রোজি লিউলিন জোনস। শামীম আহমেদ লিখেছেন ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘আখতারনামা’। সুদীপ্ত মিত্র রচনা করেছেন ‘পার্ল বাই দ্য রিভার: নবাব ওয়াজিদ আলি শাহজ কিংডম ইন একজাইল’। উর্দুতে রচিত আবদুল হালিম শরর-এর ‘গুযিশতা লখনউ’ (পুরনো লখনউ) গ্রন্থটিও ঐতিহাসিক হয়ে আছে লক্ষ্ণৌ ও কলকাতার সাংস্কৃতিক ভাব-বিনিময়ের মূল্যবান ইতিবৃত্তের কারণে।

গবেষণা ও লেখালেখির সুবাদে স্পষ্ট হয়েছে যে, বাঙালির কাছে, বিশেষত কলকাতাবাসীর কাছে নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ’র গুরুত্ব অনেকটাই। কলকাতার সংস্কৃতি, সাহিত্য, খাদ্যাভ্যাস, এমন কি ব্যক্তিগত যাপিতজীবনেও অযোধ্যার রাজা এবং তাঁর অনুচররা দীর্ঘ ছাপ ফেলেছেন এবং দিল্লি-লক্ষ্ণৌ-কলকাতার মধ্যে নির্মাণ করেছেন একটি সাংস্কৃতিক ত্রিভূজ। কলকাতার সাংস্কৃতিক জাগরণের শৈল্পিক নবাব ছিলেন তিনি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর