হজ: আল্লাহপ্রেমিকদের মিলনমেলা

, ইসলাম

ড. মুফতি মুহাম্মদ গোলাম রব্বানী, অতিথি লেখক, ইসলাম | 2023-08-27 13:49:01

১৪ জুলাই শুরু হবে হজ ফ্লাইট। বাংলাদেশ থেকে এবার প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলামান হজপালনের জন্যে সৌদি আরব গমন করবেন।এবার যারা হজে যাচ্ছেন, তাদের প্রস্তুতি নিতে হবে এখনই। হজ পালনেচ্ছুদের সুবিধার্থে বার্তা২৪.কম ধারাবাহিকভাবে হজের নিয়ম-কানুন, মাসয়ালা, আমল ও প্রয়োজনীয় দোয়া প্রকাশ করবে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ থাকছে প্রথম পর্ব।


হজ পরিচিতি
আল্লাহতায়ালা মানুষকে অনেক ভালোবেসে তৈরি করেছেন। মানুষ আল্লাহকে ভালোবেসে আল্লাহর আনুগত্য করবে, ইবাদত করবে এ উদ্দেশে মানবজাতিকে পাঠানো হয়েছে পৃথিবীর বুকে। আল্লাহর ইবাদত করতে যেয়ে কোনো কোনো ইবাদত শুধুমাত্র কায়িক শ্রমের মাধ্যমে করতে হয়- যেমন নামাজ, রোজা ইত্যাদি। আবার কিছু ইবাদত আছে যাতে টাকা-পয়সা সম্পদের ব্যবহার করতে হয়- যেমন জাকাত, সদকা ইত্যাদি। আর কিছু ইবাদত আছে যাতে শারীরিক পরিশ্রম ও সম্পদের ব্যবহার দু’টোই করতে হয়। এ ধরণের ইবাদতের অন্যতম হলো- হজ। যাতে বান্দা তার কষ্টের উপার্জিত টাকা খরচ করে দীর্ঘ সময়ের জন্য বাড়িঘর ছেড়ে আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসায় সাড়া দেয়। উপস্থিত হয় মক্কা ও মদিনায়। আল্লাহর ঘর কাবা শরিফকে কেন্দ্র করে মহান রবের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ঘুরতে থাকে। আল্লাহর বন্ধু হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও তার পরিবার পরিজনদের কিছু স্মৃতির স্মরণে, তাদের অনুকরণ করে মক্কার স্থানে স্থানে।

এক কথায়, বছরের নির্দিষ্ট সময়ে আল্লাহর ঘর কাবা জিয়ারত করার ইচ্ছায় ইহরাম বেঁধে মক্কায় উপস্থিত হয়ে নির্ধারিত নিয়মে তাওয়াফ, সাঈ, জামারায় পাথর নিক্ষেপ, আরাফা ও মুজদালিফায় অবস্থান করা ও মাথার চুল কাটা, একইসঙ্গে কিছু নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকাই হলো- হজ।

কোরআনে কারিমের ভাষায় হজ হলো- নির্ধারিত মাসে কাবা জিয়ারতের ইচ্ছা করা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হজ হলো নির্ধারিত (শাওয়াল, জিলকদ, জিলহজ) মাসে।’ -সূরা আল বাকারা: ১৯৭

আরও পড়ুন: কাবা প্রাঙ্গণের অমলিন ভালোবাসা

হজ যেভাবে এলো
সর্বপ্রথম হজরত আদম আলাইহিস সালাম ভারতবর্ষ থেকে মক্কায় পৌঁছে হজ করেন। ফেরেশতারা তাকে কাবা দেখিয়ে দেন যা তারা তৈরি করেছিল।

পরবর্তীতে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম কাবাঘর পুন:নির্মাণ করার পর আল্লাহর হুকুমে কাবা ঘর জিয়ারত করার জন্য পাহাড়ের ওপর থেকে ঘোষণা দেন। এ আওয়াজ আল্লাহর কুদরতে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তখন থেকে আবার নতুন উদ্যোমে হজ পালন চলতে থাকে।

পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষ হজ করার জন্য মক্কায় সমবেত হতো। সকল ধর্মেই, সকল নবী-রাসূলদের কাছে এ স্থানটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি মক্কার পাথর পূজারীরাও কাবা ঘরে তাওয়াফ করা, হজ করাকে পূণ্যের কাজ মনে করতো। এর দ্বারা তাদের সকল অপরাধ ক্ষমার আশা করতো।

আল্লাহতায়ালা তার শেষ নবীকে মক্কার কাবা ঘরের পাশেই জন্ম দিলেন। কাবা ঘরের সেবা করতে করতে বেড়ে উঠেন তিনি। কাবা ঘরের হাজরে আসওয়াদ প্রতিস্থাপন নিয়ে বিরোধের অবসান ঘটিয়ে আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ।

ইসলামে হজের নির্দেশ আসে নবম হিজরিতে। কোরআনে কারিমে জানিয়ে দেওয়া হয়, ‘আল্লাহর ঘরে পৌঁছা যাদের সামর্থ্য আছে তাদের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে হজ করা ফরজ।’ -সূরা আলে ইমরান: ৯৭

এ নির্দেশের পর হজরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে নবম হিজরিতে সর্বপ্রথম হজ পালন করা হয়। দশম হিজরিতে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ পালন করেন। এটিই তার জীবনের প্রথম ও শেষ হজ। এ হজই আমাদের জন্য নমুনা।

হজের গুরুত্ব
আল্লাহ প্রেমিক বিশ্ব মানবতার মিলনমেলা হলো- হজ। হজের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষ একই সময়ে এক আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে মক্কায় উপস্থিত হয়ে আল্লাহর আনুগত্যের শিক্ষা হাতে কলমে লাভ করে। আল্লাহর আনুগত্যে আল্লাহর বন্ধু হজরত ইবরাহিম আলাইহিম তার নবজাতক হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম ও হজরত হাজেরাকে মক্কায় রেখে চলে যান। আবার বালক ইসমাঈলকে আল্লাহর হুকুমের সামনে কোরবানি দিতে যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদন করেন। এ সব আনুগত্যের স্মৃতি স্মরণে পালিত হয় হজ।

হজের মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্য শেখা যায়। নবী-রাসূলদের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলোতে চলাফেরা করার কারণে তাদের জীবনের চেষ্টা-সাধনা, ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা, চারিত্রিক ও আত্মিক উৎকর্ষতার বিষয়গুলো আমাদের সামনে চলে আসে। ব্যক্তিজীবনে এর প্রভাব দৃঢ়ভাবে পড়ে। বিশেষত কাবা ঘরকে যখন নিজের হাতে ছুঁয়ে দেখা হয় তখনকার অনুভূতি অন্যতম। সরাসরি কাবাকে সামনে রেখে নামাজ পড়া, কাবার হাতিমে নামাজ পড়ার অনুভূতিই আলাদা। আল্লাহ, আল্লাহর কুদরত ও মুহাব্বত এতো নিবিড়ভাবে আর কোনো ইবাদতে পাওয়া সম্ভব হয় না। তাই মুসলিম জীবনে হজের গুরুত্ব অপরিসীম।

কেউ যদি এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে না পারে, হজ ফরজ হওয়া সত্ত্বেও অবহেলা করে হজ আদায় না করে তাহলে আল্লাহর নবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, হজ পরিত্যাগ করে মারা গেলে আর দেখার বিষয় থাকে না সে কি মুসলিম? না কি ইহুদি? না কি খ্রিস্টান?

অারও পড়ুন: জেনেভার মসজিদে জুমার খুতবা দিলেন কাবার ইমাম

হজরত আবু উমামা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, গ্রহণযোগ্য জরুরি প্রয়োজন বা অত্যাচারী শাসক কিংবা মারাত্মক অসুস্থতা যার হজ করায় বাঁধা হয়নি আর সে হজ আদায় না করে মারা যায়। তাহলে সে ইহুদি কিংবা খ্রিস্টান হয়ে মারা যাক। (কিংবা মুসলিম হয়ে এতে কোনো পার্থক্য হবে না)। -আদদারামি

যার ওপর হজ ফরজ হয়েছে সে যদি হজ অস্বীকার করে তা এড়িয়ে যায় তাহলে সে অমুসলিম হিসেবে গণ্য হয়। হজ আদায় করার ব্যাপারে আপত্তি নেই তবে অলসতা কিংবা পার্থিব প্রয়োজনগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে যদি হজ করতে দেরি করে তা-ও অমুসলিমদের মতো কাজ করার শামিল বলে গণ্য হবে।

অনেকে হজ করার ক্ষেত্রে এ অজুহাতে দেরি করে, হজ করে একবারে তওবা করে নিব, তাই আগে আগে হজ করলে তো তওবা ঠিক রাখতে পারব না, তা-ই শেষ বয়সেই হজ করব। এ ধরণের মানসিকতা নানা ধরণের ক্ষতি করে।

প্রথমত: আমরা কতদিন বাঁচব তা জানি না। দেরি করতে যেয়ে হজ করা নাও হতে পারে। দ্বিতীয়ত: সত্তর বছর বয়সে হজ করার পরই কী মারা যাওয়া নিশ্চিত? এমনও তো হতে পারে আরও ১০/২০ বছর বাঁচিয়ে রাখবেন আল্লাহ। এ সময়ে শয়তান কী গোনাহ করিয়ে নিতে পারবে না? বস্তুত গোনাহ হয়ে যেতেই পারে, তওবার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা তো প্রতিদিন চাইতে হবে। হজ করায় কোনো দেরি করতে নেই। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ তো তা-ই। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে হজ করার ইচ্ছা রাখে সে যেন তাড়াতাড়ি করে।’ -আবু দাউদ

হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজকে ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

হজরত ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি- ১. আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল এ সাক্ষ্য দেওয়া (ঈমান আনা), ২. নামাজ কায়েম করা, ৩. জাকাত প্রদান করা, ৪. বাইতুল্লাহর হজ, ৫. রমজানে রোজা রাখা।

লেখক: অধ্যাপক, উর্দু বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এ সম্পর্কিত আরও খবর