তাবলিগের কাজ যুগে যুগে, দেশে দেশে

ইজতেমা, ইসলাম

ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম | 2024-02-01 19:30:50

তাবলিগ শব্দের আভিধানিক অর্থ পৌঁছানো। পারিভাষায় ইসলামের বাণী, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধসহ শরিয়তের বিধি-বিধান মানুষের কাছে পৌঁছানোকে তাবলিগ বলা হয়।

ইসলামে তাবলিগের গুরুত্ব অপরিসীম। যুগে যুগে, কালে কালে তাবলিগের দায়িত্ব পালন করেছেন পূর্ববর্তী সব নবী-রাসুল। সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এ দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘ ২৩ বছর। তাবলিগের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘হে জনগণ! তোমরা যারা উপস্থিত আছো, তাদের দায়িত্ব হচ্ছে- অনুপস্থিতদের নিকট আমার বাণীগুলো পৌঁছে দেওয়া।’

তাবলিগ তথা দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব প্রতিটি যুগে প্রতিটি আদর্শবান মুসলমানের ওপর অর্পিত। আদর্শ যতটা উন্নত ও কল্যাণধর্মী হোক তা আপনা আপনি প্রসার লাভ করে না। অপরদিকে, প্রচারিত ও প্রসারিত আদর্শকে ধরে রাখার উদ্যোগ না নিলে সত্যের বিকৃতি ঘটার সমূহ আশঙ্কা থেকে যায়। আদর্শের ধারণ ও পুনরুজ্জীবনের জন্য তাবলিগ ও দাওয়াতি কাজ অপরিহার্য। ইসলাম প্রচারধর্মী দ্বীন। দাওয়াত ও তাবলিগ ইসলামের রক্ষাকবচ।

মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) ১৯১০ সালে ভারতে তাবলিগি কার্যক্রম শুরু করেন। দিল্লির পার্শ্ববর্তী এলাকা মেওয়াত থেকে তিনি এ কাজ শুরু করেন। ওই এলাকায় তাবলিগি কাজ চালুর ফলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সৎ ও আল্লাহওয়ালা মানুষে পরিণত হয়। পুরো অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়। এ অবস্থা দেখে হজরত ইলিয়াস (রহ.) উপলব্ধি করেন যে, ব্যক্তি চরিত্র সংশোধন করা না গেলে সামষ্টিক জীবন অপূর্ণ থেকে যাবে। ব্যক্তিসত্তায় ইখলাস (একনিষ্ঠতা), তাকওয়া (আল্লাহভীতি) ও পরকালীন জবাবদিহি সঞ্চার করা গেলে তা জীবনের সবক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ব্যক্তিজীবনে যদি কেউ আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, তা হলে সমাজ ও রাষ্ট্র্রের যেকোনো গুরুদায়িত্ব তার ওপর নির্দ্বিধায় ন্যস্ত করা যায়। এ লক্ষ্য সামনে রেখে চলতে থাকে দাওয়াতে তাবলিগের কাজ।

উপমহাদেশের বুজুর্গ উলামা ও পীর-মাশায়েখদের সহযোগিতায় ক্রমান্বয়ে তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকাসহ প্রসারিত হয়েছে গোটা দুনিয়ায়। মাওলানা আবদুল আজিজ (রহ.)-এর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে তাবলিগের কাজ শুরু হয়। পরে নানা জায়গা ঘুরে তাবলিগ জামাতের উদ্যোগে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে শুরু হয়- বিশ্ব ইজতেমা।

বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ এতে ধর্মীয় উদ্দীপনা ও হৃদয়ের পবিত্র আবেগ নিয়ে যোগ দেন। ইসলামের আলোকে ব্যক্তি চরিত্র গঠন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তার রহমত কামনা হচ্ছে- তাদের উদ্দেশ্য। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে পরিচালিত এ বিশাল আন্তর্জাতিক সম্মেলনের কোনো বাজেট নেই, পোস্টার-ফেস্টুন নেই, বিজ্ঞাপন নেই। বিভিন্ন সংস্থা মুসল্লিদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চিত করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যাতে কোনো অপরাধ সংঘটিত না হয়। তালিম, আম-খাস বয়ান, ছয় উসুলের বর্ণনা, দরসে কোরআন, দরসে হাদিস, চিল্লার জন্য জামাত গঠন, জামাত প্রেরণে তাশকিল ও যৌতুকবিহীন বিয়ে ইজতেমার উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রায় ৪০ লাখ মুসলমান ইজতেমায় যোগ দেন এবং ইজতেমা শেষে নিঃস্বার্থ তাবলিগের জামাত (ছোট ছোট দল) এক বছর, ছয় মাস, তিন মাস ও ৪০ দিনের দাওয়াতি কার্যক্রম নিয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে।

বিশ্ব ইজতেমার ময়দানে উপস্থিত তাবলিগি সাথীদের একাংশ, ছবি : সংগৃহীত

 

সাম্প্রতিক সময়ে তাবলিগ জামাতের বৃহত্তর অংশ উলামা-মাশায়েখদের পরামর্শে পরিচালিত হচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দিক। এ পদক্ষেপ আরও আগে নেওয়া উচিত ছিল। কারণ তৃণমূল পর্যায়ে এমন মুরব্বিদের তত্ত্বাবধানে তাবলিগ জামাত চলত, যাদের প্রাতিষ্ঠানিক দ্বীনি তালিমের পটভূমি নেই। ফলে তাদের আম বয়ান ও খাস নসিহতে এমন কিছু বিষয় ফুটে ওঠে, যা বিপজ্জনক। যেমন ইসলামকে ছয় উসুলের মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করা, বিজ্ঞ মুফতি-মুহাদ্দিসের সামনে সাধারণ একজন মুরব্বির বয়ান করা, মাদ্রাসার প্রয়োজনীয়তাকে গৌণ মনে করা, তাবলিগকে দ্বীনের একমাত্র কাজ মনে করা, অন্যায়, অসত্য ও জুলুমের বিরুদ্ধে কোনো শব্দ (নাহি আনিল মুনকার) না করা ইত্যাদি।

অথচ ইসলাম আল্লাহর মনোনীত দ্বীন। ইসলামের পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। এক কথায় পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন। নবী কারিম (সা.)-এর ২৩ বছরের নবুওয়তি জীবন এবং সাহাবায়ে কেরামের কর্ম ও জীবনাদর্শ উম্মতের জন্য আদর্শ। একজন মুমিনের পক্ষে হয়ত দ্বীনের সব শাখায় কাজ করা অসম্ভব। কিন্তু এক শাখায় কাজ করে সেটাকে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন মনে করা এবং অন্য শাখাগুলোকে অস্বীকার করা রীতিমতো ভ্রান্তি ও বিচ্যুতি। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় প্রতিবছর বড় পরিসরে, তিন দিনব্যাপী ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া বিশ্বের প্রায় দেশেই তাবলিগি কাজ ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে ক্রমেই। দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠছে নতুন মসজিদ ও তাবলিগি মারকাজ। এভাবে চলতে থাকবে তাবলিগি কার্যক্রম কিয়ামত পর্যন্ত- ইনশাআল্লাহ। বিশ্ব ইজতেমা শুরুর প্রাক্কালে এটাই মাবুদের দরবারে বিনীত প্রার্থনা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর