আত্মসমালোচনা মানুষকে সংশোধনের সুযোগ দেয়

বিশেষ নিবন্ধ, ইসলাম

মো. আবদুর রহমান, অতিথি লেখক, ইসলাম | 2024-01-11 21:09:02

আত্মসমালোচনা হলো- নিজের ভালো-মন্দ কাজের জন্য নিজের কাছে নিজে জবাবদিহি করা। মন্দ কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে তওবা করা এবং সে কাজটি পরিত্যাগ করে ভবিষ্যতে তা না করার অঙ্গীকার করা। আর ভালো কাজের জন্য আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করা এবং তা আগামীতে অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।

আল্লামা সাওয়ারদি (রহ.) বলেছেন, ‘মানুষ রাতের কোনো এক সময়ে তার দিনের কাজগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখবে। যদি সেগুলো ভালো ও প্রশংসনীয় হয় তাহলে তা যথারীতি বহাল রাখবে এবং ভবিষ্যতে অনুরূপ কাজ সামনে এলে তা করে যাবে। আর যদি তার কাজগুলো নিন্দনীয় হয় তাহলে অনুশোচনা করা, লজ্জিত হওয়া এবং ভবিষ্যতে আর কোনোভাবেই এসব কাজ করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করা।’-আদবুদ্দুনিয়া ওয়াদ্দি : ৪৫৩-৪৫৪

আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এবং তা সংশোধন করে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘আত্মসমালোচনার অর্থ হচ্ছে, নিজের করণীয় ও বর্জনীয় পৃথক করে ফেলা। এর পর সর্বদা ফরজ ও নফল কর্তব্যগুলো আদায়ের জন্য প্রস্তুত থাকা এবং হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করার ওপর সুদৃঢ় থাকা। তিনি আরও বলেন, আত্মসমালোচনার অর্থ হলো, প্রতিটি কাজে সর্বপ্রথম আল্লাহর হকসমূহের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া; পরে সেই হকগুলো যথাযথভাবে আদায় করা হচ্ছে কি-না, সেদিকে লক্ষ্য রাখা।’-আল ফাওয়ায়েদ

আত্মসমালোচনা মুমিনের জন্য একান্ত অপরিহার্য। এর প্রতি উৎসাহিত করে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত আগামীকালের জন্য (আখেরাতের জন্য) সে কী প্রেরণ করেছে, তা চিন্তা করা। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; তোমরা যা করো আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত। আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মভোলা করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তারা পাপাচারী।’-সুরা হাশর : ১৮-১৯

বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ প্রত্যেক মুমিনের জন্য আত্মসমালোচনা ওয়াজিব করে দিয়েছেন। এই আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, তোমাদের অবশ্যই চিন্তা করা কর্তব্য যে, আখেরাতের জন্য তুমি যা প্রেরণ করেছ তা তোমার জান্নাতের পথ সুগম করছে, না-কি তোমাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে?’ -মাদারিজুস সালেকিন : ১/১৮৭

অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা আত্মসমালোচনাকারীদের প্রশংসা করে বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহকে ভয় করে, শয়তানের কুমন্ত্রণা স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং তাদের জ্ঞানচক্ষু খুলে যায়।’-সুরা আরাফ : ২০১

হাদিস থেকেও আত্মসমালোচনার ধারণা পাওয়া যায়। শাদ্দাদ বিন আওস (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বুদ্ধিমান ওই ব্যক্তি, যে নিজের নফসের সমালোচনা করে এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের জন্য আমল করে। আর নির্বোধ ও অক্ষম সেই ব্যক্তি, যে নিজের নফসের কামনা-বাসনার অনুসরণ করে চলে এবং আল্লাহর কাছে বড় বড় আশা পোষণ করে।’ -সুনানে তিরমিজি : ২৪৫৯

আত্মসমালোচনার গুরুত্ব সম্পর্কে হজরত ওমর (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের আমলনামার হিসাব নিজেরাই গ্রহণ করো, চূড়ান্ত হিসাব দিবসে তোমাদের কাছ থেকে হিসাব গৃহীত হওয়ার পূর্বেই। আর তোমরা তোমাদের আমলনামা ওজন করে নাও চূড়ান্ত দিনে ওজন নেওয়ার আগেই। কেননা আজকের দিনে নিজের হিসাব নিজেই গ্রহণ করতে পারলে আগামী দিনের চূড়ান্ত মুহূর্তে তা তোমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই সেই মহাপ্রদর্শনীর দিনের জন্য তোমরা নিজেদের সুসজ্জিত করে নাও, যেদিন তোমরা (তোমাদের আমলসহ) উপস্থিত হবে এবং তোমাদের কোনো কিছুই সেদিন গোপন থাকবে না।’-জামে তিরমিজি : ২৪৫৯

হজরত হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘মুমিন ব্যক্তিকে স্বীয় আত্মার পরিচালক হিসেবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আত্মসমালোচনা করতে হবে। যারা দুনিয়াতে আত্মসমালোচনা করে, কেয়ামতের দিন অবশ্যই তাদের আমলের হিসাব সহজ হবে। আর যারা এ থেকে বিরত থাকবে, কেয়ামতের দিন তাদের হিসাব কঠিন ও কষ্টদায়ক হবে।’-আয-যুহদ : ৩০৮

মানুষ আত্মসমালোচনার প্রেরণা আল্লাহর ভয় থেকে লাভ করে থাকে। কাজেই যে ব্যক্তি আল্লাহকে যতবেশি ভয় করে, তার মধ্যে আত্মসমালোচনার মনোবৃত্তি ততবেশি পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়। এ আত্মসমালোচনা দিনে-রাতে যতো বেশি করা যায়, ততোই ভালো। অন্তত প্রতিদিন শেষে রাতে শোয়ার সময় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যে কাজগুলো করা হয়েছে তার পর্যালোচনা করা যেতে পারে। এ সময় চিন্তা করা উচিত, দিনে যে কাজগুলো করা হয়েছে- তা যথার্থ ও সঠিক হয়েছে কি-না, যদি যথার্থ ও সঠিক হয়, তাহলে তার জন্য আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করা উচিত। আর যদি কোনো ভুল হয়, তাহলে সে জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে।

সর্বোপরি আত্মসমালোচনা মানুষের আত্মসংশোধনের পথকে সুগম করে। ফলশ্রুতিতে যেকোনো মানুষ তার ভুল-ত্রুটিগুলো শুধরে একজন আদর্শ মানুষ হওয়ার কল্যাণময় পাথেয় লাভ করে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর