ধর্মে-কর্মে কেন পিছিয়ে মুসলিম ঘরের সন্তানরা

প্রবন্ধ, ইসলাম

ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 15:17:56

‘হে আমাদের রব! তুমি আমাদের স্ত্রী (স্বামী) ও সন্তানদেরকে নয়ন শীতলকারী বানাও এবং আমাদের করে দাও মুত্তাকিদের ইমাম।’ - সূরা আল ফুরকান: ৭৪

প্রায় বাবা-মা সন্তানদের জন্য আল্লাহতায়ালার দরবারে কোরআনের এই আয়াত পড়ে দোয়া করেন। তার পরও দেখা যায়, পিতা-মাতা দ্বীনদার; কিন্তু তাদের সন্তান-সন্ততিরা দ্বীন মানে না। ইসলাম বিধানাবলী পালন করে না। একজন মুসলিম পিতা-মাতার কাছে সন্তানের ইসলামের প্রতি উদাসীন কিংবা বিরোধী হওয়া ভীষণ কষ্টের বিষয়।

ঈমান গ্রহণকারী একজন ব্যক্তির প্রথম কাজ হলো তার স্ত্রী কিংবা স্বামী, সন্তান-সন্ততি ও নিকটবর্তী লোকজনকে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা নিজেদের ও পরিবার-পরিজনদের জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও, যার জ্বালানি হবে মানুষ আর পাথর।’ -সূরা আত তাহরিম: ৬

হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহতায়ালার সেই নির্দেশ অনুসারে প্রথমে তার পরিবার-পরিজন ও নিকটতম লোকদের নিকট ইসলামের দাওয়াত প্রদান করেন। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতে প্রথম ঈমান আনেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী হজরত খাদিজা (রা.)। তারপর তার পরিবারের সদস্য কিশোর হজরত আলী (রা.) ও প্রিয় বন্ধু হজরত আবু বকর (রা.)। ঘরে যদি স্বামী কিংবা স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি ইসলামের পক্ষে হয়ে থাকে, তবে সেটি হয় বড় প্রশান্তির; সেটি হয় পিতা-মাতার পরম চাওয়া ও পাওয়ার বিষয়।

আমরা জানি, সন্তান-সন্ততির গড়ে ওঠার ভিত্তি হলো- পরিবার। পারিবারিক শিক্ষা সন্তানকে শিশু অবস্থা থেকে ক্রমান্বয়ে ইসলামের পথে চলার ক্ষেত্রে প্রেরণা যোগায়। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হাদিসে ইরশাদ করেন, ‘প্রত্যেকটি মানব শিশু ইসলামের ওপর জন্মগ্রহণ করে। তারপর তাদের পিতা-মাতা তাদেরকে ইহুদি, খ্রিস্টান কিংবা মুসলিম হিসেবে গড়ে তুলে। এতে বোঝা যায়, সন্তান কেমন হবে তা বহুলাংশে নির্ভর করে তার পিতা-মাতার আচার-আচরণ ও পারিবারিক পরিবেশের ওপর। সন্তানের লালন-পালন, লেখাপড়া, ভালো চাকরি, প্রতিষ্ঠা লাভ, বিয়ে-শাদি ইত্যাদির ক্ষেত্রে বাবা-মা যতখানি আন্তরিক, নৈতিক চরিত্র তথা দ্বীন শিক্ষা দানে ততখানি আন্তরিকতা অনেকের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। অথচ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সন্তানকে নৈতিকতা শিক্ষাদান অপেক্ষা পিতা-মাতার দেওয়ার কিছুই নেই।’

নৈতিক শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে নামাজ অনন্য। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে দূরে রাখে।’ আল্লাহর রাসূল (সা.) সন্তানকে নামাজ শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে জোর তাগিদ দিয়েছেন। কিন্তু এখনতো আমাদের মসজিদগুলো শিশুশূন্য। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) শিশুদের নামাজে অভ্যস্ত করা ও দশ বছর বয়সে উপনীত হলে হালকা মারপিটের কথাও বলেছেন। সন্তান স্কুলে না গেলে কিংবা লেখাপড়ায় গাফিলতি করলে আমরা যতখানি পেরেশানি অনুভব করি, নামাজ না পড়লে মনে হয় না তেমন কষ্ট অনুভব করি। অথচ এই সন্তান জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের পাশাপাশি যদি অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে তখন সে তার দুনিয়া ও আখেরাত দু’টি হারায়। হালসমযের সন্তানদের নৈতিক অধপতন ও ইসলামবৈরী আচরণের অন্যতম কিছু হলো-

ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ না করা
আমাদের সমাজে এমন অনেকেই আছেন যারা আচার-আচরণে অত্যন্ত ধার্মিক। নামাজ-রোজা-হজ ও জাকাতসহ আনুষ্ঠানিক ইবাদত-বন্দেগিতে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। কিন্তু সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ইসলাম মেনে চলার ক্ষেত্রে বেশ দুর্বল। এই শ্রেণির মুসলমানের সন্তানরা সাধারণত সেক্যুলার ধ্যান-ধারণায় অভ্যস্ত হয়ে থাকে।

সন্তানের সামনে নিজেকে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করতে না পারা
সন্তান পিতা-মাতাকে খুব কাছ থেকে দেখে। তাই তাদের আচার-আচরণ, লেন-দেনে যতখানি স্বচ্ছতা থাকা দরকার সন্তানরা সেটি না পেলে পিতা-মাতার প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং এই অনাগ্রহ অনেক সময় ইসলামের ওপর চলে আসে। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘এমন কথা কেন বলো, যা নিজেরা করো না? এটি আল্লাহর কাছে বড়ই ক্রোধ-উদ্রেককারী বিষয়, তোমরা যা বলো তা নিজেরা করো না।’ –সূরা সফ

ঘরে ইসলামের অনুশাসন না মানা
ঘরগুলোকে কবরখানায় পরিণত না করা প্রসঙ্গে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নফল নামাজ ঘরে পড়ার তাগিদ দিয়েছেন। এতে বাচ্চারা বাবা-মার অনুসরণ করে নামাজে অভ্যস্ত হতে পারে। অনেক পর্দানশীন মা ছোট্ট মেয়েকে সখ করে পুরুষের পোশাক পরিধান করায়, আবার অনেক মা নিজে নেকাব পরিধান করে স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে পর্দাহীন অবস্থায় সঙ্গে নিয়ে চলেন। এমন আচরণ কাম্য নয়।

হারাম উপার্জন
আনুষ্ঠানিক ইবাদত পালনে অভ্যস্ত এমন অনেকে আছেন, যাদের রুজি হালাল নয়। এমন লোকের সন্তানরা সাধারণত বাড়তি অর্থ পেয়ে ইসলাম থেকে দূরে সরে যায়।

পরিবারে সময় না দেওয়া
একজন মানুষের ওপর তার নিজের, স্ত্রী কিংবা স্বামী, সন্তান ও পরিবারের হক রয়েছে এবং তাদের হক আদায় দ্বীনেরই অংশ। এই বোধ উপলব্ধি আমরা অনেক সময় হারিয়ে ফেলি। এমতাবস্থায় পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের বন্ধন হালকা হয়ে যায় এবং পিতা-মাতাকে বন্ধু হিসেবে না পেয়ে বাইরে বন্ধু তালাশ করে। ইসলামবৈরী হওয়ার ক্ষেত্রে এটিও একটি কারণ।

রূঢ় আচরণ
শাসন করার নামে সন্তানের সঙ্গে পিতা-মাতার রূঢ় ও কর্কশ ব্যবহার অনেক সময় হিতে বিপরিত হয়।

অবশ্য পিতা-মাতা যথাযথ দায়িত্ব পালনের পরও অনেক সময় সন্তানরা চোখ শীতলকারী না হয়ে চোখের কাঁটা হয়। অনেক নবী-রাসূলের স্ত্রী-সন্তানগণ তাদের কষ্টের কারণ ছিলেন। হজরত নূহ (আ.)-এর ছেলে, হজরত লুত (আ.)-এর স্ত্রী ও হজরত আছিয়া (আ.)-এর স্বামী ফেরাউনের উদাহরণ আমাদের সমানে বিদ্যমান। এ প্রসঙ্গে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের স্ত্রী (স্বামী) ও সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাক।অবশ্য তোমরা যদি তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দাও, তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করো, তাদের মাফ করার নীতি অবলম্বন করো, তাহলে আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি একটি পরীক্ষা। আর কেবলমাত্র আল্লাহর কাছে আছে বিরাট প্রতিদান।’ -সূরা তাগাবুন: ১৪-১৫

বর্ণিত আয়াতে আল্লাহতায়ালা নিজেই স্ত্রী-স্বামী ও সন্তানদের মধ্যে কাউকে শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ তাদের থেকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। অর্থাৎ স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির কারণে আমরা যেন ঈমান ও নীতি-নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত না হই। কিন্তু আল্লাহ তাদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করতে বলেননি বা সন্তানকে ত্যাজ্য বা স্ত্রী-স্বামী থেকে বিচ্ছেদ হতে বলেননি। এমনটি করলে সংশোধনের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। বরং আল্লাহ বলেছেন, তাদেরকে ক্ষমা করতে ও দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করতে এবং বিনিময়ে আল্লাহকে পাওয়া যাকে অতীব ক্ষমাশীল ও দয়ালু হিসেবে।

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক উন্নয়ন ও সন্তানদের সংশোধনের লক্ষ্যে আল্লাহ চান তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করতে ও ক্ষমা করতে। আল্লাহতায়ালা নবী-রাসূলদের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন।

মুমিনদের স্বামী কিংবা স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি সব সময় চোখ শীতলকারী নাও হতে পারে। এজন্য হতাশ হয়ে তাদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ কিংবা সম্পর্কচ্ছেদ নয়। বরং তাদেরকে হেকমত ও দরদের সঙ্গে আল্লাহর পথে ডাকতে হবে এবং আল্লাহর শেখানো পন্থায় তারই কাছে কাতরভাবে দোয়া করতে হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর