কিচ্ছু হয়ে ওঠা হলো না এখনো

, প্রবাসী

মিতু কর্মকার | 2023-09-01 06:32:34

এখন রাত দুটো বেজে ৪০ মিনিট। আমি দাঁড়িয়ে আছি আমার হোস্টেলের বারান্দাতে। বাইরে প্রচণ্ড রকম বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির শব্দে কেন জানি ঘুম আসছিল না। তাই বাইরে এসে দাঁড়ালাম। হোস্টেলের নিচতলাতে নতুন মেয়েদের রুম থেকে কেউ অনবরত উকুলেলে বাজিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির শব্দ আর উকুলেলে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। অনেক লাইট জ্বালানো থাকার কারণে বৃষ্টির যে জল গাছের পাতার ওপর পড়ছে তা চিকচিক করছে। বৃষ্টির জলের ফোঁটাগুলোকে ছোট ছোট হীরের দানার মতো মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে জীবন কত সুন্দর আর প্রচণ্ড সুন্দর কিছু দেখলে কেন জানি মরে যেতে ইচ্ছা হয় আজকাল।

আজ থেকে দু বছর আগেও আমি ভাবিনি আমি আমার সেই চিরচেনা ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও এসে থাকব। এই যে জীবন নিয়ে এত ভাবনা এত উৎকণ্ঠা কোনো কিছুর কি আদৌ মূল্য আছে? ঠিক একঘণ্টা পর যে আমি বেঁচে থাকব তার নিশ্চয়তা কি আমি আপনি দিতে পারি? পারি না। আমি খুব ভালোবাসা কাতুরে মানুষ। আমার কাছে পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু হলো ভালোবাসা। (অনেকের কাছে বস্তাপচা মূল্যহীন কথা মনে হতে পারে বা আমাকে অবাস্তবিক চিন্তা ভাবনার মানুষও মনে হতে পারে। তাতে যদিও আমার তেমন কিচ্ছু আসে যায় না।) কখনো না চাইতে একহাত ভরা ভালোবাসা নিয়ে দাঁড়িয়েছে কেউ, আবার কখনো আমি কাঙ্গালিনীর মতো এক টুকরো ভালোবাসার জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি। ভালোবাসাগুলো আমি যত্ন করে মনের কুটিরে রেখে দিই।

কেউ যদি এক সিকি ভালোবাসাও দিয়ে থাকে তা আমি সযতনে তুলে রেখেছি আমার মনের কুটিরে। অধিকাংশ মানুষ তার অতীতের কথা ভুলে যায় কিন্তু আমি ভুলি না, যদিও ভোলার চেষ্টাও করি না। প্রতিটা মানুষ যারা আমাকে ভালোবেসেছে, সাহায্য করেছে তাদের যেমন ভুলিনি তেমনি যারা আমার চলার পথকে আরো কঠিন করেছে তাদেরকেও ভুলিনি। আমি জীবন থেকে শিখেও বারবার ভুল করেছি, ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েছি আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি। হার মানিনি কখনো। হতাশ হয়ে দুমড়ে-মুচড়ে গেছি কিন্তু হাল ছেড়ে ঘরে বসে যাইনি। এই সাহস আমি আমার চারপাশের মানুষ থেকে পেয়েছি, ভালো একটা চলচ্চিত্র থেকে পেয়েছি, ভালো একটা বই পড়েও পেয়েছি। আমি সুন্দর একজন মানুষ হতে চেয়েছি, একজন শিল্পী হতে চেয়েছি। আমার গুরু পণ্ডিত সঞ্জীব দে একটা কথা খুব বলতেন, “একজন শিল্পী শুধু ভালো গান গাইবে তা কিন্তু না, একজন শিল্পী হবে যখন হাঁটবে, কথা বলবে এমনকি ভাত খাবে তখনও তাঁর শিল্পীসত্তা দেখা দেবে।”

গুজরাটের বন্যায় পানিবন্দী তিনদিন

আমি প্রকৃত শিল্পী হিসেবে যাদের দেখেছি তারা প্রত্যেকে সবকিছুতে শিল্পীসত্তাকে ধারণ করেছেন। এই যে আমি শাড়ি পরে দৌড়ে বাসে বা ট্রেনে উঠি সেটা আমার গুরু আমাকে বলে বলে শিখিয়েছে। একজন গুরু শুধু গান গাওয়া শেখান না। জীবনবোধ শেখান। আমার আরেক গুরু ড. রেজওয়ান আলী (লাভলু স্যার) আমাকে প্রথম দিন বলেছিলেন “কে কত ভালো বা খারাপ গায় তা পরিমাপ করো না শুধু নিজে কী করছো তা পরিমাপ করে যাও।” আমার গুজরাটের গুরু ড. জানকি মিঠাইওয়ালা বলেন, “তোমরা এত অন্যদের নিয়ে ভাবার সময় কোথায় পাও, আমার তো একেক রাগের তান আর পাল্টা করে দিন চলে যায়।” এত এত ভালো মানুষের আর্শীবাদ পেয়েও আমার যেন কিচ্ছু করা হলো না। এখনো ঠিকঠাক গেয়ে ওঠা হলো না। এই মাঝরাতে বারান্দার গ্রিল ধরে শুধু একটা কথাই বারবার মনে বেজে যাচ্ছে—“কিচ্ছু হয়ে ওঠা হলো না এখনো।”

এ সম্পর্কিত আরও খবর