যে উপন্যাসগুলো বাড়িয়ে দিয়েছিল অপরাধপ্রবণতা

, ফিচার

আহমেদ দীন রুমি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-26 00:14:21

কিছু উপন্যাস পড়ে ভয় লাগে। কিছু গল্প হাসি আনে আর কিছু আনে কান্না। অনেকের আবার কিছু উপন্যাস পড়লে নাকি ঘুম পায়। সাহিত্য এক বিচিত্র জগত। লেখক তাঁর সম্ভাব্য সমস্তটা দিয়ে জন্ম দেন একটা প্লটের; তার সাথে জন্ম নেয় অনেকগুলো চরিত্র। পাঠক তাতে বুদ হয়ে থাকে; এমনকি পরিবর্তন করে ফেলে ভবিষ্যতের ধ্যান-ধারণা। তাই হত্যার মতো অপরাধও ঘটিয়েছে পাঠকেরা, এমন নজির কম নেই। বিশ্ব সাহিত্যের এমন পাঁচটি বই নিয়ে আজ আমাদের গল্প; দুর্দান্ত সাহিত্যকর্মের তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও যা পাঠককে করে তুলেছে অপরাধপ্রবণ।

ফাউন্ডেশন সিরিজ

বোস্টন ইউনিভার্সিটির বায়োকেমিস্ট্রির প্রফেসর আইজ্যাক আসিমভ। জন্ম ১৯২০ এবং মৃত্যু ১৯৯২ সালে। মূলত তার পরিচিতি আমেরিকান লেখক হিসাবে; যিনি সায়েন্স ফিকশনকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনপ্রিয় করার অন্যতম অগ্রনায়ক। তার রচিত “ফাউন্ডেশন সিরিজ”কে গণ্য করা হয় সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলোর তালিকায়। জিনোম প্রেস, নিউ ইয়র্ক থেকে ১৯৫১ সালে হার্ড কাভারে ২৫৫ পৃষ্ঠার প্রথম বইটি প্রকাশিত হয়। পরবর্তী দু বছরের মধ্যেই ফাউন্ডেশন ত্রয়ী প্রকাশিত হয়; নাম যথাক্রমে—ফাউন্ডেশন, ফাউন্ডেশন এন্ড এম্পায়ার এবং সেকেন্ড ফাউন্ডেশন। পরবর্তীতে জনপ্রিয়তার কারণে সিকুয়েল এবং প্রিকুয়েলও লিখতে হয় আসিমভকে।

সায়েন্স ফিকশনের ক্লাসিকে পরিণত হয় ফাউন্ডেশন সিরিজ


গল্প আবর্তিত হয়েছে বৃহৎ এক গ্যালাক্টিক সাম্রাজ্যের পতন এবং নবজীবনকে কেন্দ্র করে। আর তা থেকে প্রভাবিত হয় জাপানের নতুন এক ধর্মীয় গোষ্ঠী ওমো শিনরিকিয়োর নেতারা। ফলাফল ১৯৯৫ সালে টকিওতে আক্রমণ। ১৩ জন নিহত এবং প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ আহত হয় সেই ভয়াবহ ঘটনায়।

জ্যাক শেপার্ড

আজকাল কেউ আর উইলিয়াম হ্যারিসন আইনসওয়ার্থ-এর উপন্যাসগুলো পড়ে না। হয়তো না পড়াটাই ভালো; অতিমাত্রায় উত্তেজনা কিংবা ক্লান্তিকর হয়ে উঠতে পারে তার সৃষ্টিগুলো। কিন্তু ঊনিশ শতকের প্রথম ভাগে আইনসওয়ার্থ ছিলেন ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের একজন। ১৮০৫ সাল থেকে ১৮৮২ সাল অব্দি দীর্ঘ জীবনে তার অনেক রচনাই পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে বিশেষ স্থান নিয়ে আছে তার রচিত ‘জ্যাক শেপার্ড’।

লেখক আইনসওয়ার্থ ও তার সৃষ্টিকর্ম জ্যাক শেপার্ড


বার্নার্ড নামক জনৈক সুইস ব্যক্তি তার অধীনস্থ চাকুরিজীবীকে হত্যা করে ফেলেন ১৮৪০ সালে। নিহত ব্যক্তির নাম উইলিয়াম রাসেল। বিষয়টা জটিল হয়ে পড়ে যখন হত্যাকারী দাবি করে, আইনসওয়ার্থের উপন্যাস জ্যাক শেপার্ড পাঠান্তেই সে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানোর ব্যাপারে অনুপ্রাণিত হয়েছে। বার্নার্ড আদতেই উপন্যাসটি পড়েছে নাকি এমনি বলেছে; তা স্পষ্ট না। কিন্তু লেখক আইনসওয়ার্থ এই ঘটনায় দারুণভাবে ভীত হয়ে পড়েন। ভীতি এতটাই চরমমাত্রায় পৌঁছে গিয়েছিল যে, এরপর থেকে তিনি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেই দিন গুজরান করতে লাগলেন।

দ্য সিক্রেট এজেন্ট

পোলিশ-ব্রিটিশ লেখক জোসেফ কনরাডের জন্ম ১৮৫৭ সালে। ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসের মাইলফলক হয়ে বিরাজ করা এই সাহিত্যিকের একটা উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯০৭ সালে, নাম “দ্য সিক্রেট এজেন্ট : এ সিম্পল টেইল”। জনৈক মি. এডলফ ভারলোক এবং তার স্পাইজীবনের নানা কীর্তি নিয়ে গল্পের অবয়ব গড়ে উঠেছে। প্লট আবর্তিত হয়েছে ডিনামাইট ব্যবহারের মতো ধ্বংসাত্মক নানা ক্রিয়াকলাপ নিয়েও।

দ্য সিক্রেট এজেন্ট বইয়ের ফ্ল্যাপ


দ্য সিক্রেট এজেন্ট-এর এক ডাই হার্ড ভক্ত টেড ক্যাজিনস্কি নিজের বিছানার পাশে বইটির এককপি প্রায়ই রাখতেন। নৈরাজ্যবাদী আর বোমাহামলাকারী হিসাবে তার কুখ্যাতি ছিল। ‘দ্য সিক্রেট এজেন্ট’-এর প্রফেসর চরিত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। গ্রেফতারের পর এফবিআইয়ের কাছে স্বীকারও করেছিলেন, “কনরাডের বই না পড়লে তাকে বুঝতে পারা যাবে না।”

স্ট্রেঞ্জার ইন এ স্ট্রেঞ্জ ল্যান্ড

আমেরিকান সাহিত্যিক রবার্ট এনসন হাইনলেইনের জীবনকাল ১৯০৭ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন “স্ট্রেঞ্জার ইন এ স্ট্রেঞ্জ ল্যান্ড”। গল্পের নায়ক ভ্যালেন্টাইন মাইকেল স্মিথ পৃথিবীতে আগমন করে; যার জন্ম ও শৈশব কেটেছে মঙ্গল গ্রহের অধিবাসীদের কাছে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং ক্ষমতার টানাপোড়েনকেই মূলত তুলে আনা হয়েছিল এখানে। কিন্তু ঘটনা সেদিকে থাকেনি।

সেই বিখ্যাত বই আর ‘ফ্যামিলি’র প্রতিষ্ঠাতা চার্লস ম্যানসন


চার্লস ম্যানসন এবং তার ম্যানসন ফ্যামিলির নাম মোটামুটি সবার জানা। এই গোষ্ঠী কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসের বদল ঘটায়নি; সেই সাথে গঠন করেছে সশস্ত্র আক্রমণাত্মক সেল। তাদের হাতে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা বিখ্যাত অভিনেত্রী শ্যারন টেটকে হত্যা। দাবি করা হয়, চার্লস ম্যানসন হাইনলেইনের এই বইটি থেকে প্রভাবিত ছিলেন। সান ফ্রান্সিসকোর পত্রিকা এবং ১৯৭০ সালের টাইম ম্যাগাজিন পর্যন্ত দাবি করে বসে ম্যানসন ফ্যামিলির ওপর স্ট্রেঞ্জার ইন এ স্ট্রেঞ্জ ল্যান্ড-এর প্রভাব আছে। যদিও সার্বিকভাবে এই মতকে প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।

দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই

জে ডি সেলিঞ্জার প্রকৃতপক্ষে তার “দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই”-এর জন্যই বিখ্যাত। তার জন্ম ১৯১৯ সাল; মৃত্যু ২০১০ সালের জানুয়ারিতে। উপন্যাস হিসাবে বইটা প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালের ১৬ জুলাই। মেরুন রঙের ফ্ল্যাপে সোনালি হাতের লেখা। দুর্ভাগ্যক্রমে বইটি দুর্ধর্ষ খুনে প্ররোচনা দেবার দায়ে অভিযুক্ত।

জন লেননের হত্যাকারী প্রভাবিত ছিল এই বই দ্বারা


বিষয়টা গোচরে আসে বিখ্যাত গায়ক জন লেনন মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ হবার পর। ১৯৮০ সালের কথা। মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তল্লাশি চালিয়ে তার কাছ থেকে জে ডি সেলিঞ্জারের বইটি পাওয়া যায়। পরবর্তীতে তিনি নিউ ইয়র্ক টাইমসের কাছে স্বীকার করেন, “আসলে যা ঘটেছে তা বুঝতে হলে ক্যাচার ইন দ্য রাই বইটা সাহয্য করতে পারে।” ২০০০ সালে এসে চ্যাপম্যান দাবি করেন, উপন্যাসটি তাকে জন লেননকে হত্যা করতে প্ররোচিত করেনি। বরং তিনি নিজেকে উপন্যাসের নায়ক হোল্ডেন কলফিল্ড-এর চরিত্রে ডুবিয়ে ফেলেছিলেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর