শিবনারায়ণ চন্দরপল : আনসাং হিরো

, ফিচার

সাফাত জামিল, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-30 11:12:04

প্রায় ২৫ বছর আগের কথা। জর্জটাউনে মার্চের এক সকালে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি তৎকালীন বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ওপেনিংয়ে ১১৩তম টেস্ট খেলতে নামা ডেসমন্ড হেইন্সের সাথে রয়েছেন ৭৩ টেস্ট খেলে ফেলা রিচি রিচার্ডসন। ওপেনিং বোলার—কার্টলি অ্যামব্রোস আর কোর্টনি ওয়ালশ। মিডল অর্ডারে মাত্র ২০ টেস্ট খেলে সত্তরোর্ধ্ব ব্যাটিং গড়ের জিমি অ্যাডামসের সাথে আছেন কিংবদন্তি ব্রায়ান লারা—গ্যারি সোবার্সের রেকর্ড টেস্ট স্কোর যার হাতছোঁয়া দূরত্বে।

এত এত ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট গডের মাঝে আর আছেন অভিষেক ম্যাচে নামা ১৯ বছর বয়সী শিবনারায়ণ চন্দরপল—লিকলিকে গড়নের মধ্যে বেশ বেমানান যার জার্সি ও প্যাড। দলে তাঁর অন্তর্ভুক্তি ২০১৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতানো কোচ ফিল সিমন্সের বদলি হিসেবে। কারো কারো মতে, গায়ানিজদের সন্তুষ্ট করতেই নাকি নেওয়া হয়েছিল অমন ‘রাজনৈতিক’ সিদ্ধান্ত।

অভিষেক টেস্টেই চন্দরপল পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি


মজার ব্যাপার হলো, ব্যাটিং স্কিলের চেয়ে তাঁর লেগ-ব্রেক বোলিংই প্রাধান্য পেয়েছিল নির্বাচকদের কাছে। প্রথম ইনিংসে ১৬ ওভার বল করে উইকেটশূন্য চন্দরপল পরবর্তীতে ছয় নম্বরে নেমে অ্যালান ইগলসডেনের বলে পয়েন্টের পেছনে দুর্দান্ত এক কাটে হাঁকান প্রথম বাউন্ডারি। সেদিন ইংল্যান্ডের শক্ত বোলিং অ্যাটাক দুমড়ে-মুচড়ে তরুণ চন্দরপল তুলে নেন নিজের ৬৬ টেস্ট ফিফটির প্রথমটি।

টেন্ডুলকার ও জয়সুরিয়ার পর তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দুই দশকেরও বেশি সময় কাটিয়ে অবসরের পথে পা দেওয়া চন্দরপল গড়ে গেছেন রেকর্ডের পর রেকর্ড। ইন্দো-ক্যারিবিয়ান হিসেবে ১০০ টেস্ট খেলা একমাত্র উইন্ডিজ ক্রিকেটার শিবনারায়ণ এই ফরম্যাটে করেছেন এগারো হাজারেরও বেশি রান, সর্বকালের সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারীর তালিকায় রয়েছেন আট নম্বরে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২০ হাজারেরও বেশি রানের মালিক শিবনারায়ণ


ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় ব্রায়ান লারার ছায়ায় কাটানো চন্দরপল নিজের ১৯তম টেস্টে ভারতের বিপক্ষে দেখা পান প্রথম সেঞ্চুরির। এর ঠিক এক মাস পর সেই ভারতের বিপক্ষেই পেয়ে যান প্রতীক্ষিত ওয়ানডে সেঞ্চুরিটিও।

ধীরগতির ব্যাটিংই ছিল তাঁর মূল স্টাইল। তাই টেস্টের চতুর্থ দ্রুততম সেঞ্চুরির মালিক যে চন্দরপল, তা জেনে যে কেউই অবাক হবেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৬৭ বলের সেই বিস্ফোরক ইনিংসের পরপরই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৪১৮ রানের রেকর্ড চেজে করেছিলেন ১০৪। ২০০৫ সালে সফরকারী দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে মাত্র দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে অধিনায়কত্বের অভিষেকে পান ডবল সেঞ্চুরির স্বাদ। যদিও সেনাপতির গুরুভার ঠিকঠাক বহন করতে না পেরে পরের বছরই ইস্তফা দেন শিবনারায়ণ। তাতে ফলও মিলল হাতেনাতে—ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অপরাজিত দুই সেঞ্চুরিতে স্বরূপে ফেরেন এই বাঁহাতি গ্রেট।

জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় টেস্ট ক্রিকেট খেলেই কাটিয়ে দেওয়া চন্দরপল নিজের জাত চিনিয়েছেন সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও। তাঁর অনবদ্য পারফরমেন্সে ভর করে ২০০৪ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতে উইন্ডিজ দল। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হয়েও এ টুর্নামেন্টের ২০০৬ সালের আসরে ওপেনিংয়ে নামেন চন্দরপল, দলকে টেনে নেন ফাইনাল পর্যন্ত।

তবে ক্রিকেটের আদি সংস্করণের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যানকে দুহাত ভরে সাফল্য এনে দিয়েছে ২০০৮ সাল। সেবার ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩ টেস্টে চন্দরপল তোলেন ৪৪২ রান, অর্জন করেন উইজডেন বর্ষসেরা এবং আইসিসি বর্ষসেরা ক্রিকেটারের মুকুট।

ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই উইন্ডিজ ক্রিকেটের ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি চন্দরপলকে পরিণত করেছে হাল না ছাড়া এক নাবিকে। একই কথা প্রযোজ্য ব্রায়ান লারার ক্ষেত্রেও, তবে একক আধিপত্য সবসময়ই তাঁকে রেখেছে অন্যদের থেকে এক ধাপ উপরে। কিন্তু শিব তাঁর প্রতিভা দিয়ে অন্যান্যদের গড়ে তুলেছেন প্রায় পুরোটা সময়। লারা অবসরে যান ২০০৬ সালে, ওয়ালশ ২০০১, অ্যামব্রোস ২০০০, রিচার্ডসন ১৯৯৫ আর হেইন্স ১৯৯৪ সালে। অন্যদিকে চন্দরপল তাঁর অভিষেকের পর থেকে খেলেছেন প্রায় ১০০ ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানের সাথে। এমনকি তাঁদের মধ্য থেকে সেরাদের সেরা ক্রিস গেইল, রামনারেশ সারওয়ানরা এসে চলেও গেছেন। অন্যদেরও সঙ্গ পেয়েছেন খুব কম সময়ের জন্য, যাদের মধ্যে ৪২ জন খেলেছেন মাত্র পাঁচ বা তার চেয়েও কম টেস্ট।

২০০৪ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের উচ্ছ্বাস


চন্দরপল নিজেকে রীতিমতো এক সৈনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। হার মেনে নেওয়ার ব্যাপারটি ছিল তার ডিকশনারির বাইরে। বলা বাহুল্য, ইতিহাসের অন্য যে কোনো ব্যাটসম্যানের থেকে সবচেয়ে বেশিবার অপরাজিত থাকার রেকর্ডটা তাঁরই দখলে। অনেকের মতে, তাঁর ঘুমপাড়ানি ব্যাটিং বড়ই নিস্প্রভ, নিস্তেজ। কেউ কেউ তাঁকে স্বার্থপর ভাবতেও দ্বিধা করেন না। তবে চন্দরপল ক্যারিয়ারজুড়ে করে গেছেন তাঁর কাজটিই। দিগভ্রান্ত ব্যাটিংয়ের দিনে ক্রিজে তাঁর উপস্থিতি সবসময় ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বশেষ ভরসা আর ম্যাচ বাঁচানোর সর্বশ্রেষ্ঠ সুযোগ। হেরে যাওয়া ম্যাচে তাঁর থেকে বেশি রান নেই অন্য আর কোনো ব্যাটসম্যানের।

খেলোয়াড়দের কারো শরীরজুড়ে থাকে ট্যাটুর পসরা, কান ফুটিয়ে দুলও পরেন কেউ কেউ। আর শিবের ক্যারিয়ারজুড়ে আলোচনায় ছিল তার দুই চোখের নিচের কালো দাগ। হোক পুরো কালো বর্ণ অথবা নিজ দেশের পতাকা—শুরু থেকেই প্রতিটি ম্যাচে তাঁকে দেখা গেছে এই রূপেই। বিশেষ কোনো স্টাইল নয়, বরং রোদের প্রতিফলন থেকে বাঁচতেই এমন ‘প্যাচ’ ব্যবহার করতেন চন্দরপল। তবে এই প্যাচ ঠিক কতটুকু কার্যকরী, সেটির সপক্ষে এখনো কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

রোদের প্রতিফলন থেকে বাঁচতে চোখের নিচে ‘প্যাচ’ ব্যবহার করতেন চন্দরপল


দৃষ্টিনন্দন শটের আহামরি কোনো প্রদর্শনী তেমন দেখা যায়নি তাঁর সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারে। উল্টো দর্শনীয় ছিল ক্রিজে তাঁর বিচিত্র এক কাঁকড়ারূপী ব্যাটিং স্ট্যান্স, যা নিকট অতীতে দেখা যায়নি অন্য কোনো ব্যাটসম্যানের মধ্যে। চন্দরপলের ভাষ্যমতে, বোলারের মুখোমুখি প্রায় ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে দাঁড়িয়ে তিনি পেতেন দুই চোখের পূর্ণ দর্শন, সাথে দারুণ ভারসাম্য। বন্ধু আর প্রতিবেশিদের বোলিং মোকাবেলায় গায়ানার ছোট্ট গ্রামে কৈশোরেই শিবনারায়ণ আয়ত্ত করেন এই টেকনিক।

তা ঠিক কতটা কার্যকরী ছিল এই স্ট্যান্স? শুরুর দিকে ব্রেট লি’র মতো ফাস্ট বোলাররা ধন্দে পড়ে যেতেন যে ব্যাটসম্যান চন্দরপল আদৌ বল মোকাবেলায় প্রস্তুত ছিলেন কিনা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে শিব দেখিয়ে দিয়েছেন যে প্রথাগত মডেল বা ধরন অনুসরণ না করেও কিভাবে সর্বোচ্চ স্তরের সফলতা অর্জন করা সম্ভব। কখনো মারমুখী, কখনো কচ্ছপগতি—ক্যারিয়ারের প্রারম্ভে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে ব্যাটিং স্টাইলের ভিন্নতা তাঁকে সবসময়ই আলাদা রেখেছে অন্যদের থেকে। তিন-তিনবার ১০০০ মিনিটেরও বেশি সময় অপরাজিত থাকার এবং সবচেয়ে বেশি ১৭টি অপরাজিত টেস্ট সেঞ্চুরির রেকর্ড তো আর এমনি এমনি গড়েননি!

চন্দরপলের ট্রেডমার্ক স্ট্যান্স


উইন্ডিজ ক্রিকেটের ধৈর্যের প্রতিমূর্তি শিবনারায়ণ চন্দরপলের ত্রিশ টেস্ট সেঞ্চুরির শেষটি আসে বাংলাদেশের বিপক্ষে, ২০১৪ সালে। তার ঠিক দুই বছর পরই ৪১ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান আগেই উইন্ডিজ বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে বাদ পড়া চন্দরপল।

৭৭ ফার্স্ট-ক্লাস সেঞ্চুরির মালিক চন্দরপল পরবর্তীতে তিন মৌসুম সফলতার সাথে কলপ্যাক চুক্তিতে খেলেছেন ইংলিশ কাউন্টি ক্লাব ল্যাঙ্কাশায়ারে। আর নিজ শহর গায়ানার হয়ে ছেলে ত্যাগনারায়ণ চন্দরপলের সঙ্গে এখনো খেলে যাচ্ছেন ফার্স্ট-ক্লাস ক্রিকেট। বল-ব্যাটের লড়াইয়ে আন্তর্জাতিক আঙিনায় বিশ বছরেরও বেশি সময় কাটানো শিবের ধার যে এতটুকুও কমেনি, তার প্রমাণ আরো একবার পাওয়া গেছে চলতি বছরের এপ্রিলেই। সংক্ষিপ্ততম সংস্করণে ২০০ রানের দলীয় স্কোরই যেখানে বিশাল ব্যাপার, সেখানে ২৫টি চার আর ১৩ ছক্কায় আইসিসির স্বীকৃতিহীন ঘরোয়া এক টি-টুয়েন্টি লীগে চন্দরপল একাই খেলেছেন ২১০ রানের বিস্ফোরক ইনিংস!

ছেলে ত্যাগনারায়ণের সাথে শিব


চটকদার চার-ছক্কার পসরা যদি হয়ে থাকে উইন্ডিজ ক্রিকেট সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, তবে শিবনারায়ণ চন্দরপল সেখানে এমন এক যুগের ধারক ও বাহক—সংকটের সময় যেখানে দলীয় মনোবলে নিহিত ছিল সফলতা। এমন একজন ব্যাটসম্যানের গুণগান গাওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট শব্দমালা খুঁজতে তাই হিমশিম খেতে হয় ক্রিকেটবোদ্ধাদের। ক্যারিয়ারের সোনালি সময়ে শিবনারায়ণ যদি পেতেন চলমান বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের মতো কোনো আসর, নিজের শৈল্পিক তুলিতে নিশ্চিতভাবেই রাঙাতেন দলীয় অর্জনের পাল্লা। কেননা ব্যক্তিগত রেকর্ড বা স্বতন্ত্র উজ্জ্বলতা নয়, বরং গোটা ক্যারিয়ারে দলীয় সাফল্যকেই সবকিছুর উপরে স্থান দিয়েছেন কদিন আগেই ৪৫-এ পা রাখা এই ব্যাটিং জিনিয়াস।

অভিবাদন, হে আনসাং হিরো!

এ সম্পর্কিত আরও খবর