রোমান পোলান্‌স্কি : সেলিব্রেটি স্ক্যান্ডালের মোক্ষম উদাহরণ

, ফিচার

মরিয়ম সুলতানা, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 00:19:31

মার্কিন চলচ্চিত্র শিল্পের প্রাণভোমরা হলিউডের জন্য হলেও বিশ্বের অন্যতম রোমাঞ্চকর গল্পের নগরী হিসেবে লস এঞ্জেলসকে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু ’৭০-এর দশকের এই শহর ছিল সেলিব্রেটি স্ক্যান্ডাল দ্বারা অন্ধকারাচ্ছন্ন। যৌন বিকারগ্রস্ততা, মাদকাসক্তি প্রভৃতি ছিল হলিউড পাড়ার পরতে পরতে।

রোমান পোলান্‌স্কি তেমনই একজন সেলিব্রেটি যার ঝুলি নানাবিধ স্ক্যান্ডালে পরিপূর্ণ। তিনি একাধারে সফল একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা, এমনকি লেখক। তবে আজ তিনি পৃথিবীবাসির কাছে একজন চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেই সমধিক পরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত। বহুমুখী প্রতিভাধর এই প্রথিতযশা চলচ্চিত্র পরিচালক তার এই এক জীবনে কুড়িয়েছেন অসংখ্য সুখ্যাতি, জীবন তাকে দু হাত ভরে দিয়েছে এবং তিনিও দু হাত পেতে সেসব গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তার জীবনের এই আলোয় ঝলমলে অধ্যায়ের ঠিক বিপরীতেই রয়েছে এক ভয়ংকর কালো অধ্যায়। আর সেই কালো অধ্যায়ের সূত্র ধরেই বলায় যায়, রোমান পোলান্‌স্কির জীবনই হলো ‘সেলিব্রেটি স্ক্যান্ডাল’-এর মোক্ষম উদাহরণ।

এই বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ১৯৩৩ সালের ১৮ আগস্ট ফ্রান্সের প্যারিস শহরে জন্মগ্রহণ করেন কিন্তু তার বেড়ে ওঠা পোল্যান্ডে। মা বুলা (জন্মনাম কাৎজ-প্রৎজেবর্স্কা) এবং বাবা রিসজার্ড পোলান্‌স্কি ছিলেন যথাক্রমে চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর্য নির্মাতা। পোলান্‌স্কির বাবা ইহুদি এবং পোল্যান্ডের অধিবাসী ছিলেন। পোলান্‌স্কির মা রাশিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং রোমান ক্যাথলিক হিসেবে বেড়ে ওঠেন, তিনি মূলত অর্ধ-ইহুদি বংশধর ছিলেন। 

◤ পোলান্‌স্কির বিখ্যাত চলচ্চিত্র দ্য পিয়ানিস্ট ◢


পোলান্‌স্কি পোল্যান্ডের তৃতীয় বৃহত্তম শহর উচের ন্যাশনাল ফিল্ম স্কুলে পড়াশোনা করেন। তাঁর চলচ্চিত্রে পদার্পণ একজন অভিনেতা হিসেবে। ১৯৫০-এর দশকে আন্দ্রজেয় ভায়দার ‘পোকোলনি’ (প্রজন্ম, ১৯৫৪) এবং একই বছর সিলিক স্টার্নফেল্ডের ‘জাকজারোয়ানি রোভার’ (জাদুকরী বাইসাইকেল) চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্যদিয়ে অভিনেতা পোলান্‌স্কির অভিষেক ঘটে।

চলচ্চিত্র পরিচালনায় পোলান্‌স্কির অভিষেক হয় ১৯৫৫ সালে, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘রোভার’ (সাইকেল) নির্মাণের মধ্যদিয়ে। রোভার একটি আধা-আত্মজীবনীমূলক চলচ্চিত্র এবং এখানেও পোলান্‌স্কি অভিনয় করেন।

রোভারে তিনি তার বাস্তব জীবনের একটি সহিংস চক্রের কথা উল্লেখ করেছেন। যেখানে দেখানো হয়েছে এক কুখ্যাত ক্রাকো ফেলোন ইয়ানুশ ডিজুবা, পোলান্‌স্কির সাইকেল বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল; কিন্তু পরিবর্তে ডিজুবা তাকে মারধর করে এবং তার টাকা চুরি করে পালিয়ে যায়। বাস্তব জীবনে পোলান্স্কির মাথার খুলি ফাটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় সে গ্রেফতার হয় এবং আরো আটটি অপরাধের মধ্যে তিনটি হত্যার জন্য তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। উচে পড়াশোনার সময় আরো বেশ কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছায়াছবি তাকে স্বীকৃতি এনে দেয়, বিশেষ করে ‘ডভায় লুডজি জ শাফাঁ’ (১৯৫৮) এবং ‘গডাই স্পাডায়া আনিওউ’ (১৯৫৯)। তিনি ১৯৫৯ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন।

ক্যারিয়ারের সোপানগুলি অবলীলায়, অত্যন্ত সফলতার সাথে ছুঁতে পারলেও তার দাম্পত্য জীবনের যাত্রাটা খুব একটা মসৃণ ছিল না। অভিনেত্রী বারবারা ল্যাস ছিলেন এই পোলিশ চলচ্চিত্র পরিচালকের প্রথম স্ত্রী। যিনি পোলান্‌স্কির ‘হোয়েন অ্যাঞ্জেলস ফল’ (১৯৫৯) চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তারপর এই জুটি ১৯৫৯ সালেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন কিন্তু ১৯৬১ সালে মাত্র দু বছরের ব্যবধানে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। তারপর তিনি আবারও ১৯৬৮ সালের ২০ জানুয়ারি অভিনেত্রী শ্যারন টেইটকে (২৪ জানুয়ারি ১৯৪৩-৯ আগস্ট ১৯৬৯) বিবাহ করেন। শ্যারন টেইটও ছিলেন একজন সুঅভিনেত্রী।

◤ অভিনেত্রী ও প্রথম স্ত্রী বারবারা ল্যাসের সঙ্গে পোলান্‌স্কি ◢


কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! রোমান পোলান্‌স্কির ক্যারিয়ার যখন খ্যাতির তুঙ্গে, ১৯৬৯ সালে সাড়ে ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী অভিনেত্রী শ্যারন টেইটকে মাত্র ২৬ বছর বয়সে চার্লস ম্যানসনের অনুসারীরা হত্যা করে। স্ত্রীকে হারিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েন এই উঠতি চলচ্চিত্র পরিচালক। পরবর্তীকালে দীর্ঘ এক বিরতির পর ১৯৮৯ সালে ইম্যানুয়েল সিনার সাথে তৃতীয়বারের মতো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, যিনি একজন ফরাসি অভিনেত্রী।

◤ অভিনেত্রী ও দ্বিতীয় স্ত্রী শ্যারন টেইটের সাথে পোলান্‌স্কি ◢


১৯৭৭ সালে রোমান পোলান্স্কি মাত্র ১৩ বছর বয়সী কিশোরী সামান্থা গেইমে’র সাথে যৌন সংসর্গে জড়িয়ে পড়েন, যখন তার বয়স ৪৩ বছর। ১০ মার্চ সামান্থার মা সুসানের তৎপরতায় পোলান্স্কিকে পুলিশ গ্রেফতার করে। পোলান্স্কি জনসম্মুখে অপরাধ স্বীকার করেন এবং ইউরোপে পালিয়ে যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরলে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে, এজন্য তিনি আর ফেরত আসেননি এবং ইউরোপ থেকেই চলচ্চিত্র পরিচালনা অব্যাহত রাখেন।

তবে শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সত্য যে, সামান্থার সাথে আজও রোমান পোলান্‌স্কির যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ আছে। জানা যায়, পোলান্‌স্কি ইউরোপে পালিয়ে যাওয়ায় সামান্থা খুশিই হয়েছেন এবং তিনি তাকে ক্ষমাও করে দিয়েছেন। কারণ তিনি চান না পোলান্‌স্কির বাকি জীবন জেলে কাটুক। এদিকে রহস্যজনকভাবে সামান্থা পোলান্‌স্কিকে ধর্ষক কিংবা যৌননিপীড়ক কিংবা শিশুকামী হিসেবে চিহ্নিত করতে নারাজ। সামান্থার ভাষ্যমতে, “আমি কখনোই তাকে পেডোফাইল বলব না। আমি যেটা বলতে পারি তা হলো, তিনি নিতান্তই ভুলবশত চরমতম খারাপ একটা কাজ করে ফেলেছেন। এবং, আমি তাকে তখনই পেডোফাইল হিসেবে চিহ্নিত করতে পারতাম, যদি তিনি তার পরবর্তী জীবনেও এই একই ধরনের কাজ অব্যাহত রাখতেন।”

◤ সামান্থা গেইম ◢


তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ২০০৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধেই সুইজারল্যান্ডে থাকাকালীন রোমান পোলান্‌স্কিকে গ্রেফতার করা হয় এবং এই গ্রেফতার নিয়ে তুমুল বিতর্কের জন্ম হয়। রোমান পোলান্‌স্কির পক্ষে হলিউডের অসংখ্য নামজাদা সেলিব্রেটি, ইউরোপের শিল্পীগোষ্ঠী, এমনকি রাজনীতিকরা সমবেত হয়। তারা এই গ্রেফতারি পরোয়ানার বিরুদ্ধে কথা বলে। এদিকে তার গ্রেফতারের ঘটনার পর আমেরিকার জনমত পোলান্‌স্কির বিপক্ষে গেলেও ইউরোপ এবং পোল্যান্ডের অগনিত মানুষ ছিল তার পক্ষে। আর এভাবেই এ-যাত্রায়ও আইনের বেড়াজাল থেকে পার পেয়ে যান রোমান পোলান্‌স্কি।

রোমান পোলানস্কি পরিচালিত চলচ্চিত্রসমূহ
• জ উ ভজি (১৯৬২)
• রিপালসন (১৯৬৫)
• কুল-দে-সাক (১৯৬৬)
• দ্য ফিয়ারলেস ভ্যাম্পায়ার কিলার্স (১৯৬৭)
• রোজামারিস বেবি (১৯৬৮)
• ম্যাকবেথ (১৯৭১)
• হোয়াট? (১৯৭২)
• চায়নাটাউন (১৯৭৪)
• লা লোকাতায়ার (১৯৭৬)
• তেস (১৯৭৬)
• পাইরেটস (১৯৮৬)
• ফ্র্যান্টিক (১৯৮৬)
• বিটার মুন (১৯৯২)
• ডেথ অ্যান্ড দ্য মেইডেন (১৯৯৪)
• দ্য নাইন্থ গেট (১৯৯২)
• দ্য পিয়ানিস্ট (২০০২)
• অলিভার টুইস্ট (২০০৫)
• দ্য ঘোস্ট রাইটার (২০১০)
• কার্নেজ (২০১১)
• লা ভেনাস অ লা ফরুর (২০১৩)
• দাপ্রেস উন হিস্তোয়ার ভ্রাই (২০১৭)

পোলান্‌স্কি পরিচালিত ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ চলচ্চিত্রটিই সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং এটিই কেবল একাডেমি পুরস্কার অর্জন করে। পোল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেনের যৌথ প্রযোজনায় নির্মীত এই দ্য পিয়ানিস্ট ২০০২ সালে মুক্তি পেয়েছিল।

পোল্যান্ডের এক ইহুদি পিয়ানো বাদকের ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ নামের আত্মজীবনী গ্রন্থ থেকে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। দ্য পিয়ানিস্ট কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির পুরস্কার অর্জন করে। এছাড়া তিনটি ক্ষেত্রে একাডেমি পুরস্কার অর্জন করে : সেরা অভিনেতা, সেরা পরিচালক এবং সেরা অভিযোজিত চিত্রনাট্য। এছাড়া ফ্রান্সের সেজার পুরস্কার লাভ করে তিনটি ক্ষেত্রে : সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা ও সেরা চলচ্চিত্র। এই ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন অ্যাড্রিয়েন ব্রডি। অ্যাড্রিয়েন ব্রডিই একমাত্র মার্কিন চলচ্চিত্র অভিনেতা যিনি ফ্রান্সের সেজার পুরস্কার জিতেছেন।

রোমান পোলান্‌স্কি শৈশবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিজ চোখে অবলোকন করেছিলেন, হয়তো সেজন্যই তার দ্য পিয়ানিস্টের নির্মাণশৈলি ছিল এত বেশি জীবন্ত। কাল পরিক্রমায় বিশ্ব রোমান পোলান্‌স্কিকে ভুলে যেতে পারে, কিন্তু দ্য পিয়ানিস্টকে কখনো ভুলতে পারবে না।

এ সম্পর্কিত আরও খবর