ব্র্যান্ডেড স্টোরিটেলিং : ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের ভবিষ্যৎ

, ফিচার

তৌহিদ শরীফ, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-12-17 20:48:50

“Future of Future Advertising”
প্রথমে খুব সংক্ষেপে বলে নেব কেন ডিজিটাল মার্কেটিং এখন আর কোনো অপশন বা ফিউচার নয় বরং বর্তমানের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এবং ইফেক্টিভ মার্কেটিং প্লাটফর্ম। তারপর আসব মূল টপিক্স, “ব্র্যান্ডেড স্টোরিটেলিং—ফিউচার অব অ্যাডভার্টাইজিং”-এ।

বিশ্বজুড়ে চলছে ইন্টারনেটের জোয়ার। দেশে শুধুমাত্র গেল এক বছরে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে ১ কোটি। তাহলে ভাবুন দেশের মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা কত?


জ্বি, প্রায় ১০ কোটির কাছাকাছি। কিভাবে হলো এই বিস্ফোরণ? সহজ চোখে দেখলে— 


আর আরেকটু ঘেঁটে দেখলে হয়তো দেখতে পাবেন এই ইন্টারনেট জোয়ার আর অনুকূল স্রোতের হাওয়া আসছে কোন দিক থেকে।

১। বাংলাদেশকে ডিজিটালি ক্ষমতায়িত সমাজ ও অর্থনীতিতে রূপান্তর করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে “ডিজিটাল বাংলাদেশ” হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দেয়।
২। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, সাবমেরিন কেবল, হাই টেক পার্ক ইত্যাদি অবকাঠামো দুনিয়াটাকে আক্ষরিক অর্থে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসছে। ছোট শহর ও প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা। ভিডিওটি দেখলে অবাক হবেন মাস্ট—

৩। সরকার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে নতুন স্টার্টআপ-আইডিয়া, উদ্ভাবক ও উদ্যোক্তাদের ওপর। এরাই তৈরি হচ্ছে ফিউচার বিগ জায়ান্ট কোম্পানি হিসেবে। সেখানে দেখা দিচ্ছে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের প্রয়োজনীয়তা। তারা এমন লোকদের সন্ধান করছেন যারা তাদের প্রয়োজন অনুসারে ডজিটিাল মার্কেটিং কৌশল তৈরি করতে এবং প্রয়োগ করতে পারেন।

৪। ইন্টারনেট অব থিংস—ব্যক্তিগত ব্যবহারযোগ্য ডিভাইস যেমন স্মার্ট গাড়ি, স্মার্ট গৃহস্থালি সরঞ্জামাদি, স্মার্ট হোম ইত্যাদি বাংলাদেশের জন্য তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও খুব শীঘ্রই তা প্রচলিত হবে। এ জাতীয় ডিভাইসগুলোর উত্থান ডিজিটাল মার্কেটিংকে আরো আকর্ষণীয় ও চ্যালেঞ্জিং করবে সাথে তৈরি করবে নতুন অনেক সম্ভাবনাময় পথ।

সব মিলিয়ে যদি এক কথায় বলতে চাই— “Digital Bangladesh—Smart Ecosystem for Smart Marketplace”

মানে যেখানে সরকার নিজেই তার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সেই সুযোগ কেন হাতছাড়া করব?

এবার বলি ডিজিটাল মার্কেটিং কেন সবচেয়ে বেশি ইফেক্টিভ ও প্রফিটেবল :
১। প্রেস অ্যাড অথবা টেলিভিশনে মার্কেটিংয়ে খরচের তুলনায় ডিজিটাল মার্কেটিং আরো কম ব্যয়বহুল ও সর্বোচ্চ রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট এবং কনভার্সন রেট।
২। এখানে সবকিছুর ওপর নজরদারি করা যায়। যেসব চ্যানেল বা কৌশল অকার্যকর বা কম কার্যকর দেখা দেবে সেখানে বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়ে ফলপ্রসূ স্ট্রাটেজিতে বেশি বিনিয়োগ করা সম্ভব একমাত্র ডিজিটালেই।
৩। বিভিন্ন ওয়েবসাইট এনালাইসিস ও নানান ধরনের টেকনোলজির সুবাদে গ্রাহকের কেনাকাটার অভ্যাসগত ধরন অনুযায়ী তাকে তার কাঙ্ক্ষিত পণ্যটি ক্রয়ের ব্যাপারে মানসিকভাবে খুব সহজে ঠেলে দেওয়া যায়।
৪। গ্রাহকের ধরন অনুযায়ী মাল্টি লেয়ার স্ট্রাটেজি করে এবং ভৌগোলিক অবস্থান ধরে মার্কেটিং সম্ভব।

সহজ কথায় আরেকবার বলি। ডিজিটাল মার্কেটিং খুব কম খরচেই করা সম্ভব ব্যাপারটা এরকম না। বরং যে কোনো বাজেট দিয়ে, আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী যে কোনো অংকের টাকা দিয়ে আপনি মার্কেটিং করতে পারবেন। মার্কেটিং শুধু বড় বড় দৈত্যদের জন্য নয়, সবার জন্য উন্মুক্ত।

জ্বি, সবকিছু যদি নতুন করে ভাববার প্রয়োজন হয় তবে তাই করেন কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশের এই জোয়ারে ব্যবসার অস্তিত্বকে হারিয়ে না ফেলতে চাইলে ট্রেডিশনাল মার্কেটিংয়ের পাশাপাশি ডিজিটাল মার্কেটিংকে সিরিয়াসলি নিন।

এবার আসি মূল টপিক্স “ব্র্যান্ডেড স্টোরিটেলিং—ফিউচার অব অ্যাডভার্টাইজিং”-এ।

এখানে মার্কেটে দুটি ঘটনা পাশাপাশি ঘটেছে। একদিকে রেডিও, প্রিন্ট ও টেলিভিশন মিডিয়ার অভিজ্ঞতা, এর সংস্কৃতি, বিনোদন ধরন ও ট্র্যাডিশনাল মার্কেটিং এই সবকিছুর ওপর অবিশ্বাস, অভক্তি ও বিরক্তিকর মনোভাব তৈরি হয়েছে আর এই সুযোগেরই হাত ধরে অপরদিকে ওয়েবসিরিজ, স্ট্রিমিং চ্যানেল, ভিডিও অন ডিমান্ড, ইউটিউব চ্যানেল ও ব্র্যান্ডেড কনটেন্টের মতো নতুন বিনোদন মাধ্যম মার্কেটে জায়গা করে নিয়েছে।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে ৮৪% মিলেনিয়াল স্বীকার করেছে তারা ট্র্যাডিশনাল মার্কেটিং পছন্দও করেন না বিশ্বাসও করেন না। এমনকি তারা আর এসব দেখেনও না শোনেনও না। বদলে তারা লাইভ স্ট্রিমিং, নেটফ্লিক্স, অ্যানিমে, ইউটিউব এসবে সময় কাটায়। এমনকি ৮৫% মিলেনিয়াল স্বীকার করেছেন যে তারা নিয়মিত ইউটিউব দেখেন। মিলেনিয়াল বলতে বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যার কথা বলছি যারা মূলত জেনারেশন এক্স ও জেনারেশন ওয়াই হিসেবেও পরিচিত। এক কথায় ইয়াং জেনারেশন। [সোর্স: জনপ্রিয় পত্রিকা ফোর্বস এর তথ্য অনুযায়ী।]

তাই বলে অ্যাডভারটাইজিংয়ের স্কোপ কমে যাচ্ছে না বরং প্রয়োজন শুধুমাত্র এই পরিবর্তনশীল অভ্যাসের জন্য বিজ্ঞাপনের কৌশলগত পরিবর্তন।

৮৭% ইয়াং জেনারেশনই মনে করে প্রোডাক্ট প্লেসমেন্ট এমন এক স্ট্রাটেজি যেটায় তাদের কোনো আপত্তি নেই।

প্রোডাক্ট প্লেসমেন্টের কিছু উদাহরণ দিই—

এগুলো কিছু স্বনামধন্য ব্র্যান্ডের অনলাইন ওয়েবসিরিজ থেকে নেওয়া স্ক্রিনশট। পুরো সিরিজের লিংক দেওয়া আছে যা আপনি ইউটিউবে বিনামূল্যেই দেখতে পারবেন।

দেখুন আরো সহজ করে বলি, প্রি-রোল অ্যাড, স্কিপ অ্যাড বা অন্যান্য হাজারও কৌশল যেখানে বন্ধ করে দেওয়া যায়, স্কিপ করা যায় বা শব্দ বন্ধ করে দেওয়া যায় সেখানে একমাত্র প্রোডাক্ট প্লেসমেন্ট হচ্ছে বেস্ট সমাধান। যেখানে ব্র্যান্ড গল্পের অংশ হয়ে উপস্থাপিত হয় এবং দর্শকের মনে জায়গা করে নেয়।

একটা সুন্দর স্টোরিলাইন যেখানে গল্প বলার ছলে খুবই আলতোভাবে ও তুলনামূলক অনেক কম আক্রমণাত্মকভাবে প্রচারণা করা হয়, এবং ব্র্যান্ডের নৈতিক মূল্যবোধ গল্পে সংযুক্ত করা হয়, এরকম স্টোরিলাইন বা গল্প গ্রাহকের সাথে ব্র্যান্ডের একধরনের সূক্ষ্ম সম্পর্ক তৈরি করে। ওই ব্র্যান্ডের প্রতি নিজের অজান্তেই গ্রাহকের ভালোলাগা তৈরি হতে থাকে। যেটা ধীরে ধীরে সেলস্-এ রূপ নেয়।

একটা ভালো ওয়েব সিরিজ আপনার পণ্যের নতুন ও পুরাতন গ্রাহকের সাথে সম্পর্ক ভালো করবে। একবার গ্রাহক আপনার ওয়েব সিরিজের মজা পেয়ে গেলে, তারা আঠার মতো আপনার ব্র্যান্ডের সাথে লেগে থাকবে পরবর্তীতে কী হবে তা দেখার জন্য। ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল, বিহাইন্ড দ্য সিন ইত্যাদি ঘাটিয়ে ওই ব্র্যান্ডেড কনটেন্টের পার্ট হবে। সেই সুবাদে গ্রাহকের ব্র্যান্ডটিকে আরো কাছে থেকে দেখার সুযোগ হবে এবং ধীরে ধীরে তৈরি হতে পারে ভালোলাগা যা আল্টিমেটলি নিয়ে যাবে ক্রমবর্ধমান সেলস্-এর দিকেই।

এভাবেই স্টোরিটেলিং আরো ইন্টারেক্টিভ হবে, দর্শক ব্র্যান্ডের সাথে নিজেকে আরো কাছ থেকে সম্পৃক্ত করতে পারবে। ব্র্যান্ডের প্রতি তৈরি হবে বিশ্বাস, ভালোবাসা ও আস্থা। ভালো মানের গল্প ও বিনোদনের মাধ্যমে জায়গা করে নেবে গ্রাহকের হৃদয়ে।

মাঝে মাঝে কোনো ওয়েব সিরিজ এতটা জনপ্রিয় ও সফল হয় যে এটা ব্র্যান্ডের ফিউচার এসেট হয়ে যায়। এবং চাহিদা তৈরি হয় আরো নতুন সিজনের।

তাছাড়া সবচেয়ে যেটা মজার বিষয় সেটা হচ্ছে মিডিয়া বায়িং বাজেট। ট্র্যাডিশনাল মার্কেটিংয়ে যেখানে বিজ্ঞাপন প্রচারে লক্ষ কোটি টাকা ঢালা লাগে সেখানে বিনা খরচে সম্প্রচার করছেন আপনার প্রোগ্রাম আর সেটা অনলাইনে থেকে যাবে আজীবন। যুগের পর যুগ, দিন দিন নতুন নতুন গ্রাহক সাক্ষী হবে এই কনটেন্টের। জীবিত থাকবে গল্প সবসময়।

ফিউচার মার্কেটিংয়ের দিকে তাকালে একটা জিনিসই দেখা যায়, সেটা হচ্ছে পরিবর্তন। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে ডিজিটাল এই পরিবর্তনের সাথে অবশ্যই মানিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য নিয়ে চলতে হবে।

টেলিভিশন যেখানে ট্র্যাডিশনের কথা বলে ওয়েব সিরিজ সেখানে পরিবর্তনের কথা বলে। সবাই আজকাল অনলাইনে। সবাই টেলিভিশনের চেয়ে অনলাইনে বেশি সময় কাটায়। টেলিভিশন থেকে দিন দিন চোখ সরে চলে যাচ্ছে অনলাইনে। বিজ্ঞাপন প্রণেতারা প্রতিটি মানুষকে একজোড়া আইবল হিসেবে গণনা করে। এবং আইবল ধরে রাখার জন্য প্রয়াজন নিত্য নতুন কৌশল।

মিলেনিয়ালদের ধরে রাখার জন্য ব্র্যান্ডিং খুবই জরুরি। যদিও বেশি দাম কিছুটা তারতম্য তৈরি করে তবে ব্র্যান্ডের প্রতি আস্থা ও বিশ্বস্ততা থাকলে অতিরিক্ত দাম খুব বেশি ব্যবধান তৈরি করতে পারে না।

সর্বশেষ কথা টাইটেল স্পনসরশিপের মাধ্যমে আপনি হয়তো প্রত্যক্ষভাবে ওয়েব সিরিজের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারেন কিন্তু আসল সম্পৃক্ততা তৈরি হয় যখন গল্পে বা স্ক্রিপ্টে সরাসরি ব্র্যান্ডকে সম্পৃক্ত করা যায়। অন্যথা সব জোরপূর্বক প্রোডাক্ট প্লেসমেন্টের মতোই দেখাবে। আরেকটি জিনিস, আপনার গল্পের ধরন যেই ধরণারই হোক না কেন, দর্শক বা মিলেনিয়ালদের জীবনে সেটার ইতিবাচক ভূমিকা থাকতে হবে। এমন গল্প, মতাদর্শ বা ট্রিটমেন্ট থাকতে হবে যা সচরাচর টেলিভিশনে দেখা যায় না।

অনেক লেখা হয়েছে কিন্তু মূল আকর্ষণ এখনো রয়ে গেছে। কথা বলব ব্র্যান্ডেড স্টোরিটেলিং-এর আপাদমস্তক নিয়ে। এর সফলতার মূলমন্ত্র, কেইস স্টাডি, এক্সপার্টদের মতামত ইত্যাদি নিয়ে। বলব আরেকদিন আরেকটি পর্বে। সেই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন, বার্তা২৪-এর সাথেই থাকুন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর