উপমহাদেশের প্রসিদ্ধ যত ঈদগাহ

, ফিচার

শেহজাদ আমান, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 16:38:53

বিশাল ময়দানে ঈদের নামাজ আদায় করা ইসলামী সংস্কৃতিতে বিশেষ একটি ব্যাপার। অন্তত উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ঈদগাহে ঈদের নামাজ আদায় করার ব্যাপারটি বেশ জনপ্রিয় ও মর্যাদার একটি ব্যাপার। ঈদের নামাজ কেবল জামাতেই আদায় করা যায়। মসজিদে ঈদের জামাত আদায় করা গেলেও ঈদগাহে নামাজ আদায় উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে খুবই পছন্দনীয় একটি রীতি।

বছরের অন্যান্য সময়ে সাধারণত এই জায়গায় নামাজ পড়া হয় না। তবে, ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়ার ব্যাপারটি একটি ‘সুন্নাত’। সে অনুযায়ী, ঈদের দিন সকালে মুসলমানরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে, পারতপক্ষে নতুন পোশাক পরে ঈদগাহে জমায়েত হন।

ঈদগাহ সংস্কৃতি বেশি সুপরিচিত এই ভারতীয় উপমহাদেশে; বেশি হলে তা বিস্তৃত এশিয়ার আরো কিছু দেশে। উপমহাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে এমন কিছু ঈদগাহ, যেগুলো বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কারণে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এগুলোর নাম ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন জায়গায়; দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেখানে নামাজ পড়তে আসেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা।

শুরুতেই বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ কিছু ইদগাহ’র ওপর আলোকপাত করা যাক—

গোর-এ-শহীদ ঈদগাহ, দিনাজপুর

বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ঈদগাহ দিনাজপুরের গোর-এ-শহীদ ময়দান। ২০১৯-এর ঈদ-উল-ফিতরে এখানে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম ঈদের জামাতটি, যেখানে প্রায় ৬,০০,০০০ মানুষ উপস্থিত ছিল বলে অনুমান করা হয়।

গোড়-এ শহীদ বড় ময়দানের আয়তন প্রায় ২২ একর। ৫২ গম্বুজের ঈদগাহ মিনার তৈরিতে খরচ হয়েছে ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/12/1565576104509.jpg
◤ উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ঈদগাহ দিনাজপুরের গোর-এ-শহীদ ময়দান ◢


ঈদগাহ মাঠের মিনারের প্রথম গম্বুজ অর্থাৎ মেহেরাবের (যেখানে ইমাম দাঁড়াবেন) উচ্চতা ৪৭ ফিট। এর সঙ্গে রয়েছে আরো ৪৯টি গম্বুজ। এছাড়া ৫১৬ ফিট লম্বা ৩২টি আর্চ নির্মাণ করা হয়েছে। পুরো মিনার নির্মাণ করা হয়েছে সিরামিক দিয়ে।

শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান, কিশোরগঞ্জ

জেলা শহরের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান। প্রতিবছর এ ময়দানে ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদুল আযহা নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। কালের স্রোতে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানটি পরিণত হয়ে উঠেছে একটি ঐতিহাসিক স্থানে। এ ময়দানের বিশাল জামাত গৌরবান্বিত ও ঐতিহ্যবাহী করেছে কিশোরগঞ্জকে। বর্তমানে এখানে একসঙ্গে তিন লক্ষাধিক মুসল্লি জামাতে নামাজ আদায় করেন। নামাজ শুরুর আগে শর্টগানের ফাঁকা গুলির শব্দে সবাইকে নামাজের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সঙ্কেত দেওয়া হয়। কিশোরগঞ্জ শহরের পূর্বে নরসুন্দা নদীর তীরে এর অবস্থান।

◤ ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে ঈদের জামাতের দৃশ্য ◢


এই ঈদগাহ মাঠটি চারপাশে উঁচু দেয়ালে ঘেরা হলেও মাঝে মাঝেই ফাঁকা রাখা হয়েছে যাতে মানুষ মাঠে প্রবেশ করতে ও বের হতে পারে। এছাড়া এই মাঠের প্রাচীর দেয়ালে কোনো দরজা নেই। শোলাকিয়া মাঠে ২৬৫ সারির প্রতিটিতে ৫০০ করে মুসল্লি দাঁড়াবার ব্যবস্থা আছে। ফলে মাঠের ভেতর সবমিলিয়ে এক লাখ বত্রিশ হাজার ৫০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে ঈদুল ফিতরের সময় দেখা যায়, আশপাশের সড়ক, খোলা জায়গা, এমনকি বাড়ির উঠানেও নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। এভাবে সর্বমোট প্রায় তিন লাখ মুসল্লি ঈদের নামাজ পড়ে থাকেন। 

সিলেট শাহী ঈদগাহ, সিলেট

শহরের উত্তর সীমায় শাহী ঈদগাহ মাঠের অবস্থান। ১৭০০ সালের প্রথম দিকে নির্মিত সিলেটের শাহী ঈদগাহকে বাংলাদেশের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক স্থাপনা সমূহের মধ্যে গণ্য করা হয়। ১৭ শতকের প্রথম দশকে সিলেটের তদানীন্তন ফৌজদার ফরহাদ খাঁ নিজের ব্যক্তিগত উদ্যোগ, তদারকি ও তত্ত্বাবধানে এটি নির্মাণ করেন।

◤ সিলেট শাহী ঈদগাহ'র অভ্যন্তরভাগ ◢


প্রতি বছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা উপলক্ষে এখানে বিশাল দুটি ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ মুসল্লি একসাথে এখানে ঈদের নামাজ আদায় করে থাকেন।

ধানমন্ডি শাহী ঈদগাহ, ঢাকা

ঢাকার ধানমন্ডি থানায় অবস্থিত এই প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনাটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক তালিকাভুক্ত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবাদার সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাসেম ধানমন্ডির শাহী ঈদগাহ প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকায় অবস্থিত মুঘল স্থাপত্য নিদর্শনসমূহের অন্যতম এই ঈদগাহ। ঈদগাহটি বর্তমানেও ঈদের (২০১৬ নাগাদ) নামাজের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ১৯৮১ সাল থেকে ঈদগাহটি সংরক্ষণ করছে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।

◤ মুঘল আমলে নির্মিত ধানমন্ডি শাহী ঈদগাহ, বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রত্নতাত্মিক স্থানও বটে ◢


ধানমন্ডি ঈদগাহ দৈর্ঘ্যে ১৪৫ ফিট ও প্রস্থে ১৩৭ ফিট। ৪ ফিট উঁচু করে ভূমির ওপরে এটি নির্মিত হয় যাতে বন্যার ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এর চারকোণে অষ্টাভূজাকৃতির বুরুজ রয়েছে। তিন ধাপের মিম্বর ঈদগাহের উত্তর পাশে রয়েছে, যেখানে দাঁড়িয়ে ইমামরা নামাজ পড়ান। ঈদগাহটি চারদিকে ১৫ ফিট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। তবে বর্তমানে কেবল পশ্চিম দিকের প্রাচীরটিই মোঘল আমলের। পশ্চিম প্রাচীরের মাঝ বরাবর প্রধান মেহরাব। প্রধান মেহরাবের দুই দিকে আছে বহু খাঁজবিশিষ্ট নকশা করা প্যানেল। এছাড়া ছোট আকারের দুইটি মেহরাব আছে এর দুই পাশে। মেহরাবগুলো দেওয়ালের আয়তাকার ফ্রেমের ভেতরে অবস্থিত।

এছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও রয়েছে বেশ কিছু প্রসিদ্ধ ঈদগাহ—

মোরাদাবাদ ঈদগাহ, উত্তর প্রদেশ, ভারত

ভারতের অন্যতম প্রাচীন ও সুপ্রসিদ্ধ ঈদগাহ এটি। অবস্থিত দেশটির উত্তর প্রদেশে।

◤ ভারতের অন্যতম প্রাচীন ও সুপ্রসিদ্ধ মোদারাবাদ ঈদগাহ ◢


লাখখানেক মুসুল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন এই ঐতিহ্যবাহী ঈদগাহটিতে। 

পুরানি ঈদগাহহায়দারাবাদ, ভারত

এটিও ভারতের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি ঈদগাহ। অবস্থিত তেলেঙ্গানা রাজ্যের হায়দারাবাদে। এটির নির্মাণ কাল ১৭ শতক।

◤ পুরানি ঈগগাহ’র অন্যতম নান্দনিক অংশ হচ্ছে এর সুবিশাল দুটো পিলার ◢


এটি রয়েছে শহরের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার তালিকায়। ঈদগাহটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর দুটো বিশাল পিলার, যেটার সাথে মিল রয়েছে চারমিনারের পিলারগুলোর।

ঈদগাহ মসজিদ, কাবুল, আফগানিস্তান

ঈদগাহ মসজিদ আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ। একে দেশটির ধর্মীয় মর্যাদার ধারক মসজিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেখানে প্রতি বছর দুবার করে ১০ লাখ লোক ঈদের নামাজ আদায় করে থাকে।

◤ পাহাড়ের কোলে সুদৃশ্য ঈদগাহ মসজিদ ◢


কাবুল শহরের পশ্চিম প্রান্তে মাহমুদ খান ব্রিজ ও জাতীয় স্টেডিয়ামের কাছে অবস্থিত এটি। অনেক ঐতিহ্যের ধারক সুপ্রাচীন এই মসজিদ ও ঈদগাহটি। ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, এটির নির্মাণ হয়েছে মুঘল আমলে। 

ঈদ কাহ মসজিদ, ঝিনজিয়ান প্রদেশ, চীন

চীনের ঝিনজিয়ান প্রদেশের কাশগরে অবস্থিত এই মসজিদটি একই সাথে মসজিদ ও ঈদগাহ হিসেবে সুপরিচিত।

◤ সুপ্রাচীন ঈদ কাহ মসজিদ চীনের উইঘুর মুসলিমদের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থাপনা ◢


চীনের উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে এটি একটি পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ১৪৪২ সালে স্থানীয় মুসলিম নেতা সাকসিজ মির্জা মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদ ও ঈদগাহটির মোট আয়তন ১৬,৮০০ বর্গফুট।

খেরি ঈদগাহ, উত্তর প্রদেশ, ভারত

খেরি ঈদগাহ অবস্থিত ভারতের উত্তর প্রদেশের লক্ষিপুর জেলায়। লক্ষিপুর ও খেরির রেলওয়ে লাইনের মাঝখানে এটি অবস্থিত।

◤ নান্দনিক খেরি ঈদগাহ ◢


এই ঐতিহাসিক ঈদগাহের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল খেরি শহরের উত্তর পশ্চিমে। আবাসিক এলাকার বাইরে। মসজিদপ্রাঙ্গণে ঢোকার পথ রয়েছে তিনটি। ঈদের দিন, ঈদগাহের বাইরের দিকগুলো ব্যবহৃত হয় ফুড স্টল, দোকানপাট ও বিনোদনের পসরার কাজে।

আরো পড়ুন ➥ ঈদ-উল আযহা দেশে দেশে

এ সম্পর্কিত আরও খবর