জাতির পিতার যোগ্য সহচর বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব

, ফিচার

শেহজাদ আমান, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 22:10:52

একজন সাধারণ মানুষ থেকে বঙ্গবন্ধু যে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক, সেই পথ পরিক্রমা সম্ভব হয়েছে তাঁর জীবনে কিছু মানুষের সোনালি স্পর্শ ও অবদানের কারণে। আর এক্ষেত্রে যেসব মানুষের নাম করতে হবে, তাঁদের মধ্যে সবার আগে আসবে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নাম। বঙ্গবন্ধুর এই সহধর্মিনী বিয়ের পর বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক প্রতিটি সংগ্রামে তাঁর পাশে থেকে জুগিয়ে গিয়েছেন নিরন্তর সাহস ও অনুপ্রেরণা এবং করে গেছেন সহযোগিতা। আজ ৮ অগাস্ট এই মহান নারীর ৮৯তম জন্মবার্ষিকী।

শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ১৯৩০ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বঙ্গমাতার পিতা শেখ মোহাম্মদ জহুরুল হক যশোরে কো-অপারেটিভ ডিপার্টমেন্টে অডিটর পদে চাকরি করতেন। ৫ বছর বয়সী বড়মেয়ে জিন্নাতুন্নেছা এবং ২ বছর বয়সী ছোট মেয়ে ফজিলাতুন্নেছা, ডাকনাম রেণুকে রেখে বাবা শেখ মোহাম্মদ জহুরুল হক এবং পরে মাতা হোসনে আরা বেগম পরপারে পাড়ি জমান। তখন এই দুই নাবালিকা অনাথ মেয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব এসে বর্তায় ৮০ বছরের বৃদ্ধ দাদা শেখ মো. আবুল কাসেমের ওপর। পিতৃমাতৃহারা হয়ে শিশু ফজিলাতুন্নেছা বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফুর রহমান আর মাতা সায়েরা খাতুনের আদরে বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য ভাইবোনের সঙ্গে খেলার সাথী হয়ে বড় হয়েছেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন শেখ মুজিবের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়—“বিয়ে কী তা তো বুঝলাম না। শুনলাম, রেণুর দাদা আমার আব্বাকে এক রকম হুকুম জারি করেছিলেন। মুরব্বিরা তাঁর কথা অবহেলা করার অবকাশ পাননি। সুতরাং বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হয়ে গেল।’ ফজিলাতুন্নেছা বঙ্গবন্ধুর স্কুল জীবনের সাথী হলেও প্রকৃত জীবন সাথী হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর এন্ট্রান্স পাস করার পর। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, তাঁদের বিয়ের ফুলশয্যা হয়েছিল ১৯৪২ সালে।

◤ জাতির জনক ও বঙ্গমাতার পারিবারিক মুহূর্তগুলো ছিল এমনই সহজ স্বাভাবিক ◢

 

এরপর থেকে বঙ্গমাতাও যেন ধীরে ধীরে হয়ে যান বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সহচর। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের ১২ বছরই কাটাতে হয়েছে কারাগারে। তাঁর অনুপস্থিতিতে নিজের পরিবারের হাল ধরা, দলীয় নেতাকর্মীদের পরামর্শ ও অনুপ্রেরণা দেওয়ার মতো কাজগুলো বঙ্গমাতা করে গিয়েছেন হাসিমুখেই। সুখে-দুঃখে বঙ্গবন্ধুর পাশে তিনি সবসময়ই ছিলেন; এর পাশাপাশি কিছু দারুণ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি সুযোগ্য পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে।

১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জন বাঙালি নৌ ও সেনাবাহিনীর সদস্য এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করে পাকিস্তানি সরকার। বঙ্গবন্ধু এ মামলায় বিচলিত না হয়ে আইনিভাবে মোকাবেলার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য আইনজীবীদের অর্থ জোগানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেন। এ মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলে বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি দাবিতে বাঙালি রাস্তায় নামে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজপথ বিক্ষোভে পরিণত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকেও গ্রেফতারের হুমকি দেয়। আন্দোলনের তীব্রতায় পিছু হটে সরকার। পাকিস্তান সরকার এ সময় লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্যারোলে মুক্তির সিদ্ধান্তে বেঁকে বসেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনি প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে জোরালো আপত্তি জানান। পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে প্যারোলে নয়; নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হবে। তিনি কারাগারে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাত করে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে লাহোর বৈঠকে যেতে নিষেধ করেন। তিনি আরো বুঝতে পেরেছিলেন, শেখ মুজিবের ব্যাপারে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ। পাকিস্তান সরকার বাধ্য হবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে। ফজিলাতুন্নেছার পরামর্শে অনড় থাকেন শেখ মুজিব। প্যারোলে মুক্তির ক্ষেত্রে অসম্মতি প্রকাশ করেন তিনি। ইতোমধ্যে শেখ মুজিবের মুক্তি আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি লাভ করেন। পরদিন অর্থাৎ ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাঙালি তাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়ে বরণ করে নেয়। ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের এই অসামান্য দূরদর্শিতা নিঃসন্দেহে বাংলার রাজনীতির একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হয়ে থাকবে।

বঙ্গমাতার অপর অনন্যসাধারণ সিদ্ধান্ত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। আমরা জেনেছি, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের নেপথ্যে বঙ্গমাতার সঠিক পরামর্শ ছিল। বঙ্গবন্ধুকে সেই সময় তাঁর সহচররা ৭ মার্চের ভাষণের ব্যাপারে নানা পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন। বঙ্গমাতা এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে যা মন থেকে বলতে ইচ্ছে করে, যা বলা উচিত, তা-ই বলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। “এবারের সংগ্রাম—আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম—স্বাধীনতার সংগ্রাম” বলে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের স্বাধীনতার ডাকে বঙ্গমাতার মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন বঙ্গবন্ধুকে সাহস জুগিয়েছিল।

এইভাবে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধুকে সাহায্য করেছেন নতুন ইতিহাস রচনায়। আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন এই মহীয়সী নারী। ১৯৭৫-এর সেই ভয়াল কালরাতে নির্মম, অপরিণামদর্শী ঘাতকের বুলেট বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের অন্যান্যদের সাথে তাঁর জীবনটাও নেয় কেড়ে। কিন্তু, সারাজীবন একজন যোগ্য সহচরের মতো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে তিনি যেন বাস্তবে প্রমাণ করে গিয়েছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই অসাধারণ কবিতার মর্মবাণীকে—“কোনো কালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারী, / প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।”

এ সম্পর্কিত আরও খবর