নেলসন ম্যান্ডেলা : সংগ্রামই যার জীবন

, ফিচার

তানিম কায়সার, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 21:48:04

সংগ্রামী জীবন বলে যদি কোনো জীবনকে আখ্যায়িত করা যায় তবে সেখানে একজন ব্যক্তি অনায়াসেই জায়গা করে নেবেন। তিনি নেলসন ম্যান্ডেলা। যিনি নিজের জীবনের ২৭টি বসন্ত কাটিয়ে দিয়েছেন চার দেওয়ালের ভেতর। অপরাধ ছিল একটাই, মানুষের ন্যায্য অধিকার নিয়ে কথা বলা। আর এই অপরাধের কারণেই তাকে বরণ করে নিতে হয়েছিল এক বন্দী জীবন। তিনি চাইলেই অবশ্য এরচেয়ে ভালো জীবন বেছে নিতে পারতেন। আপোস করে, একটু অন্যায়ের কাছে অনুগত হলে তাকে এমন জীবন কাটাতে হতো না। কিন্তু যার শরীরে ছিল ঐতিহ্যবাহী থেম্বু রাজবংশের রক্ত, সে মানুষ কেমন করে এমন সাধারণ জীবন যাপন করবেন।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ম্যান্ডেলা পরিচিত মাদিবা নামে। সেখানকার মানুষেরা তাকে আদর করে, সম্মান করে মাদিবা বলে ডাকে। মাদিবা শব্দের বাংলা হলো জাতির জনক। শুনলে হয়তো অবাক হবেন, ম্যান্ডেলার হাতের ছাপ অবিকল আফ্রিকান মহাদেশের আকৃতির মতো! হ্যাঁ এটা একেবারে সত্যি ঘটনা কিন্তু! সুতরাং চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় এ লোকের জন্মই হয়েছিল মাদিবা হওয়ার জন্য, জাতির জনক হওয়ার জন্য।

একজন সাধারণ ম্যান্ডেলা থেকে মাদিবা হয়ে যাওয়ার এই পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। এর জন্য তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ পথ। যেই পথের প্রতিটা বাঁকে বাঁকেই ছিল কাঁটা বিছানো। এই পথ চলতে গিয়ে কোনো কাঁটা বিঁধেছে পায়ে, কোনোটা হাতে, আবার কোনোটা একদম হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে। কিন্তু নেতৃত্বের গুণাবলি যার রক্তে, সংগ্রাম করে নিজের জাতিকে রক্ষার ইতিহাস যার বংশে, সেই মানুষকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে বাধা দেবে, এমন কাঁটা তখনও সৃষ্টি হয়নি। মেন্ডেলা তাই এসব কাঁটা একে একে সরিয়ে, ক্ষত বিক্ষত শরীর নিয়ে অনেক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে পিছিয়ে পড়া একটা জাতিকে নিয়ে আসেন আলোর মশালের তলে।

জন্মগতভাবে কালো হওয়ার কারণে যাদেরকে সহ্য করতে হতো সীমাহীন অত্যাচার, মানুষ হয়েও যাদের কাটাতে হতো পশুর চেয়েও হীন জীবন, তাদের জন্য বিলিয়ে দিলিয়েছিলেন নিজের টগবগে যৌবন। এই ম্যান্ডেলাকে আদর করে, ভালোবেসে মাদিবা ডাকবে না তো কাকে ডাকবে বলুন?

১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ প্রদেশের একটি সম্ভ্রান্ত গোত্র প্রধানের পরিবারে তার জন্ম। মা তার ডাক নাম রেখেছিলেন রোলিহলাহা, যার অর্থ যে ডাল ভেঙে ফেলে, অর্থাৎ দুষ্টু। এই দুষ্টু ছেলে বড় হয়ে একদিন একটা সমাজকে ভেঙে দেবে, তা হয়তো তার মাও ভাবেননি। বলতে গেলে সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্ম হয় তার। কিন্তু যার কপালে লেপা আছে সংগ্রামের তিলক, তার মুখে সোনার চামচ কি মানায়?

মাত্র নয় বছর বয়সে বাবা হারান ম্যান্ডেলা। নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করতে হয় তৎকালীন ঔপনিবেশিক সরকারের চক্ষুশূল হওয়ার কারণে। শুরু হয় সংগ্রামের জীবন। কিন্তু সেই জীবনকেও ম্যান্ডেলা জয় করতে থাকেন সাহস এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে। স্কুলে তাই এক শিক্ষিকা তার নামের আগে জুড়ে দেন নেলসন শব্দটি। সেই থেকে রোলিহলাহলা ডালিভুঙ্গা ম্যান্ডেলা হয়ে ওঠেন নেলসন ম্যান্ডেলা।

তরুণ ম্যান্ডেলা ◢

 

পড়াশোনায় তুমুল মেধাবী ম্যান্ডেলা সারা বিশ্বের কাছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আজন্ম প্রতিবাদী ও সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে আজকে পরিচিতি লাভ করেছেন। তার সেই প্রতিবাদী স্বভাবের শুরুটা শেশব কৈশোর থেকেই। ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সংগ্রামী জীবনের সঙ্গী টাম্বোর সাথে পরিচয় ঘটে তার। যার সাথে ম্যান্ডেলা সারা জীবন খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীনই ম্যান্ডেলা জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। প্রথম বর্ষেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ছাত্র সংসদের ডাকা আন্দোলনে অংশ নেন। ফলস্বরূপ বেরিয়ে যেতে হয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেখান থেকে চলে যান জোহানসবার্গ। একটি খনিতে প্রহরীর কাজ নেন। পরবর্তীতে একটি আইনি সেবাদান প্রতিষ্ঠানের কেরানি হিসেবে চাকরি শুরু করেন। এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সময়েই তিনি তার স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এখানে তার সাথে পরিচয় হয় জো স্লাভো, হ্যারি শোয়ার্জ এবং রুথ ফাস্টের। পরবর্তী সময়ে এদেরকে নিয়েই তিনি তার বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন।

যুবক বয়সে ম্যান্ডেলা ◢

 

আন্দোলনের শুরুতে ভারতের মহাত্মা গান্ধির 'অহিংস' মতকে গ্রহণ করেছিলেন ম্যান্ডেলা এবং তার সহযোগীরা। তাই তারা কাউকেই আঘাতের পক্ষপাতি ছিলেন না। এরই মাঝে ১৯৪৮ সালে ক্ষমতায় আসে আফ্রিকানদের দল ন্যাশনাল পার্টি। এই দলটি বর্ণবাদে বিশ্বাসী ছিল। আর ম্যান্ডেলাও একই সময়ে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন এগিয়ে যায়। সংলাপ, শান্তি আলোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে জনমত তৈরির কাজ চলে। ১৯৫২ সালে তিনি অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু সেই শান্তি বেশি দিন স্থায়ী হয় না। বর্ণবাদী সরকার তাদের প্রতি মারমুখী আচরণ শুরু করে। বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকার ১৯৫৬ সালের ৫ ডিসেম্বর ম্যান্ডেলাসহ ১৫০ জন বর্ণবাদবিরোধী নেতাকে দেশদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু পরবর্তীতে তারা নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্তি পান।

মুক্তি পাবার পর আন্দোলন আরো বেগবান হয়। মানুষ তাদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হতে শুরু করে। ১৯৬০ সালে শার্পভিলে কৃষ্ণাঙ্গ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ গুলি ছুড়তে থাকে। ৬৯ জন নিহত হলে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। শান্তিপূর্ণ অহিংস আন্দোলন রূপ নেয় সহিংস আন্দোলনে।

এসময় এক বক্তৃতায় নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, সরকার যখন নিরস্ত্র এবং প্রতিরোধবিহীন মানুষের ওপর পাশবিক আক্রমণ চালাচ্ছে, তখন সরকারের সঙ্গে শান্তি এবং আলোচনার কথা বলা নিস্ফল। ফলস্বরূপ সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। তারা অহিংস আন্দোলনের পথ থেকে সরে এসে ‘যেমন কুকুর তেমন মুগুর’ পদ্ধতি অবলম্বন করেন। ম্যান্ডেলা পরবর্তীতে স্বীকার করেন যে এই আন্দোলন করতে গিয়ে অনেক সময় অনেক নিরীহ লোককে প্রাণ হারাতে হয়েছে। আর এটিকে কারণ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ম্যান্ডেলা ও তার দল এএনসিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে তারা ম্যান্ডেলার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।

সহিংস আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ১৯৬২ সনের ৫ আগস্ট ৪০ বছর বয়সী ম্যান্ডেলাকে গ্রেফতার করা হয়। যার ফলে তার জীবন থেকে হারিয়ে যায় ২৭ টি বছর। তবে জেলে থেকেও ম্যান্ডেলা দমে যাননি। জেলে বসেই তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় পড়াশোনা শুরু করেন এবং আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। 

জেলে থাকাকালীন তিনি প্রায় নানা সময়ে তার প্রিয়জনদের কাছে চিঠি লিখতেন। স্ত্রী, পুত্র, কন্যাসহ অনেকের কাছেই চিঠি পাঠাতেন। জেলে থাকাকালীনই তার মা মারা যান। কিন্তু তাকে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেওয়া হয়নি। নির্জন কারাগারে বসে তিনি লেখেন, “তোমাকে আর কোনোদিন দেখতে পাব না! ভাবতেই পারছি না।” এই ক্ষত মুছতে না মুছতেই তার এক ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তিনি ম্যান্ডেলার একটি প্যান্ট পরেছিলেন। ম্যান্ডেলা লেখেন, “মৃত্যুর সময় আমার একটি প্যান্ট পরে ছিল সে। সেটা তার বড়ই হওয়ার কথা। তার যথেষ্ট কাপড়চোপড় থাকা সত্ত্বেও আমার কাপড় পরার কোনো কারণ ছিল না। তবু সে পরেছিল। এই যে আবেগ, এটাই আমাকে গভীরভাবে ছুঁয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে আমার অনুপস্থিতি, আমার কারাগারে থাকা, সন্তানদের ওপর কী মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলেছিল; তা আমার মনকে উত্তাল করে দিল।” এমনি দুঃখ কষ্টে তার জীবন কাটতে থাকে নির্জন অন্ধকারে। কিন্তু তবুও তার এ নিয়ে কোন অভিযোগ ছিল না। তিনি বলতেন, “যদি জেলে না যেতাম, তাহলে অনেক কিছু শেখা বাকি থাকত।”

কথায় আছে, আপনি হয়তো একজনকে মেরে ফেলতে পারবেন, কিন্তু তার আদর্শকে কখনো মেরে ফেলতে পারবেন না। এই কথাই যেন প্রতিফলিত ম্যান্ডলার জীবনে। ম্যান্ডেলা জেলে থাকাকালীনই ম্যান্ডেলার পক্ষে সারা বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি হতে থাকে। দীর্ঘ জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মুক্তি দেওয়া হয় তাকে। এরপরে তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস তথা এএনসির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৯৪ সালে ক্ষমতায় আসীন হন। যা ১৯৯৯ পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল। সেই সময় তিনি সারা বিশ্বের কাছে হয়েছিলেন সমাদৃত, সিক্ত হয়েছিলেন ভালোবাসায়। 

 

 

বাংলাদেশে ম্যান্ডেলা ◢

 

আমরা অনেকেই জানিনা নেলসন ম্যান্ডেলা একবার আমাদের বাংলাদেশেই এসেছিলেন। সময়টা ১৯৯৭ সাল। মার্চের ২৬ তারিখ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী দিবস। আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা বাংলাদেশে এসেছেন। একই সময়ে এসেছেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত ও তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধান সুলেমান ডেমিরেলের মতো বিশ্বনেতা। বাংলাদেশে এসে তিনি এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে নিজের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনকে তুলনা করে দুটি আন্দোলনকেই মানুষের মুক্তির আন্দোলন হিসেবে আখ্যা দেন। বাংলাদেশের অনেক সম্ভাবনার কথা বলছিলেন তিনি। বলেছিলেন, কিছু আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করলেই কিন্তু দেশটি পাল্টে যেতে পারে। এজন্য দরকার স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। নইলে দেশ মুখ থুবড়ে পড়বে। কারণ, স্বচ্ছতা না থাকলে দায়বদ্ধতাও থাকবে না। তখন দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়বে। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন শিক্ষা-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার কথাও।

আজকেও আমরা ম্যান্ডেলার কথাগুলোর যৌক্তিকতা গভীরভাবে উপলব্ধি করি। তার এই সামান্য কয়টি কথা থেকেই বোঝা যায় তিনি আসলে কত গভীর এবং কত বিচক্ষণ মাপের রাজনীতিবিদ ছিলেন।

বর্ণিল জীবনে তিনি দুইশ’র বেশি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার মধ্যে রয়েছেন নোবেল পুরস্কার ও ভারতরত্ন পুরস্কারের মতো বড় বড় সব অর্জন।

শেষ জীবনে এসে রোগ ব্যাধি বাসা বাঁধে শরীরে। ২০১৩ সালের ৮ জুন তিনি ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে প্রায় দুই মাস হাসপাতালে কাটান। ২১ সেপ্টেম্বর তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহান সংগ্রামী।

নেলসন ম্যান্ডেলাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয় তিনি কিভাবে মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকতে চান? উত্তরে বলেন তিনি বলেন, “আমি চাই আমার সম্পর্কে লোকে এমন কথাই বলুক যে, এখানে এমন এক ব্যক্তি ঘুমিয়ে আছেন, যিনি পৃথিবীতে তার কর্তব্য সম্পাদন করেছেন।”

ম্যান্ডেলার এই ইচ্ছেটাও হয়তো পূরণ হয়েছে আজ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর