জার্মান বিমান বাহিনীর বিরুদ্ধে এক ভারতীয় বীরের উপাখ্যান

, ফিচার

মরিয়ম সুলতানা, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 17:55:18

১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র চার মাস আগের ঘটনা। ফ্রান্সের আকাশে জার্মান বিমানবাহিনীর সঙ্গে দুঃসাহসিক ‘ডগ ফাইটে’ নিমগ্ন ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর তরুণ ফাইটার পাইলট ইন্দ্রলাল রায়। এসময় তিনি একটি জার্মান জঙ্গী বিমানকে আক্রমণ করে ভূপাতিত করেন, যেটি ছিল তার নবম শিকার। ৯ জুলাই থেকে ১৮ জুলাই, টানা ১০ দিনে নয়টি জার্মান বিমানকে বিধ্বস্ত করেন তিনি। মাত্র ১৩ দিনে, ১৭০ ঘণ্টার লড়াইয়ে এমন সাফল্য পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। তার এই বিরল কৃতিত্বের জন্য তাকে ‘ফ্লাইং এস’ পদকে সম্মানিত করা হয়েছিল। যদিও এই খেতাব পাওয়ার জন্য সাধারণত পাঁচটি শত্রু বিমান ঘায়েল করাই যথেষ্ট, সেখানে তিনি খতম করেছিলেন নয়টি! আজ এই অসামান্য বীরত্বপূর্ণ অকুতোভয় বীর সেনানীর প্রয়াণ দিবস।

ইন্দ্রলালের ডাক নাম ছিল ল্যাডি, এ নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। ১৮৯৮ সালের ২ ডিসেম্বর কলকাতায় ল্যাডির জন্ম। ল্যাডি হলেন সেই সময়ের নামকরা ব্যারিস্টার, কলকাতার পাবলিক প্রসিকিউশন্স-এর ডিরেক্টর প্যারীলাল রায় ও ললিতা রায়ের সন্তান। প্যারী আবার ছিলেন বরিশাল জেলার লাকুটিয়া অঞ্চলের জমিদার। তিনি বিশ্বাস করতেন, “ভারত যেহেতু ব্রিটিশ অধ্যুষিত এলাকা, সেহেতু ব্রিটিশদের সাথে দ্রুত তাল মিলানোর জন্য ভারতীয়দের উচিত ইংরেজি ভাষা এবং ওদের আচার-ব্যবহার শেখা।” সন্তানদেরকে ইংরেজদের আদব-কায়দা শেখানোর জন্য তিনি তাঁর বাড়িতে একজন ইংরেজ গভর্নেসও নিয়োগ করেছিলেন।

পরবর্তীতে ইংরেজির প্রতি প্রবল আস্থা থেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি ১৯০১ সালে তার ছয় সন্তান ও স্ত্রীকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেন। পরেশ, ইন্দ্র ও ললিত, তিন ছেলেকে ভর্তি করেছিলেন হ্যামারস্মিথে, সেন্ট পল বয়েজ স্কুলে। আর লীলাবতী, মীরাবতী এবং হীরাবতী, তিন মেয়েকে ভর্তি করিয়েছিলেন সেন্ট পল স্কুল অব গার্লস-এ। এদিকে প্যারীলাল ছিলেন যথেষ্ট স্বাস্থ্যসচেতন। তাই কলকাতায় থাকাকালীন তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি তার ছেলেদেরকে সাঁতার কাটা, ঘোড়ায় চড়া এবং সাইকেল চালানো শিখিয়েছিলেন। ঠিক সে কারণেই পড়াশোনার পাশাপাশি রাগবি এবং সাঁতারে ছিল ল্যাডির তুখোড় পারদর্শিতা। ল্যাডির বড় ভাই পরেশও ছিলেন স্কুলে বক্সিং চ্যাম্পিয়ন এবং তাকেই বলা হয়, ইন্ডিয়ান বক্সিংয়ের জনক।

বাবা প্যারীলাল চাইতেন, পড়াশোনা শেষ করে বড় ছেলে পরেশ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে ভারতীয় প্রশাসন বিভাগে চাকরি করবে। কিন্তু ১৯১৪ সাল, পরেশ তখন কেমব্রিজের ইমানুয়েল কলেজ থেকে সদ্য গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছেন এবং আই এস এসে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় তিনি গিয়ে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। পরেশের তখন ১৫ বছর বয়স। বড় ভাইকে দেখে অনুপ্রাণিত হন ল্যাডি। তিনি ঠিক করেন, পড়াশোনার পর্ব শেষ করে তিনিও বড় ভাইয়ের মতো সেনাবাহিনীতে যোগ দিবেন। আর তখন থেকেই সেনাবাহিনীতে যোগদানের প্রস্তুতি গ্রহণসরূপ স্কুলে ক্যাডার ফোর্সে যোগ দেন ল্যাডি।

ল্যাডি ছিলেন দারুণ মেধাবী এবং তার সেই উজ্জ্বল মেধার স্বাক্ষর হিসেবে শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই তিনি লাভ করেন বেশ কয়েকটা বৃত্তি। তিনি সর্বশেষ অর্জন করেন মর্যাদাপূর্ণ ব্যালিওল বৃত্তি এবং ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যাওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু তার চোখে তখন আকাশে উড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন হাতছানি দিচ্ছে। সিদ্ধান্ত নেন, পাইলট হবেন।

স্বপ্নকে ছোঁয়ার জন্য তিনি অক্সফোর্ডে পড়তে না গিয়ে ‘রয়্যাল ফ্লায়িং করপস’-এ যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার কমজোরি দৃষ্টিশক্তির জন্য তিনি বাদ পড়ে যান। তারপর তিনি বিক্রি করে দেন তার প্রিয় মোটর সাইকেলটি, সেটা বিক্রির টাকা দিয়ে তিনি দেশের সবথেকে ভালো চক্ষু বিশেষজ্ঞদের একজনের শরণাপন্ন হন এবং চোখের চিকিৎসা করান। এরপর তিনি আবার রয়্যাল ফ্লায়িং করপস-এ আবেদন করেন এবং এবার তিনি কৃতকার্য হন।

১৯১৭ সালের ৪ এপ্রিল তিনি যোগ দেন তার স্বপ্নের রয়েল ফ্লাইয়িং করপস-এ। এই ফ্লাইং কোর থেকে ১৯১৭ সালের ৫ জুলাই সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন ১৮ বছর বয়সী ল্যাডি। ল্যাডির একমাত্র লক্ষ্য ছিল জার্মান যুদ্ধ বিমানকে ধরাশায়ী করা। ভেন্ড্রোম-এ প্রশিক্ষণ, টার্নবারি-তে বন্দুক চালনা শিক্ষা ইত্যাদি পেশাগত প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করার পর ওই বছরই অক্টোবর মাসের শেষের দিকে মাত্র ১৮ বছর বয়সী ল্যাডি অর্থাৎ ইন্দ্রলাল রায় বিমান বাহিনীর ৫৬ স্কোয়াড্রনে যোগ দেন এবং পোস্টিং হয় ফ্রান্সের ভাদোম-এ। তার সদা হাস্যোজ্জল মুখ এবং বাকপটু স্বভাবের জন্য তিনি ছিলেন সকলের কাছে প্রিয়।

এর কিছুদিন পরই ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর এসই ফাইভ বিমানে করে আকাশে উড়ছিলেন ইন্দ্র। কিন্তু আচমকা তার বিমানকে লক্ষ্য করে এক জার্মান যুদ্ধবিমান অতর্কিতে হামলা চালায়। নো ম্যানস ল্যান্ডে ভেঙে পড়ে তার বিমান। কথিত আছে, স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে মৃত বলে ঘোষণা করা হয় ইন্দ্রলালকে। এমনকি তার দেহ রাখা হয় মর্গে। কিন্তু হঠাৎ মর্গের দরজায় ভেতর থেকে ধাক্কা। মর্গের ভেতর থেকে এমন ধাক্কা উপস্থিত সকলের জন্য ছিল অপ্রত্যাশিত এবং ভীতিপ্রদ। দরজার ভেতর থেকে কোনো অতিপ্রাকৃত আত্মা না, ধাক্কা দিচ্ছিলেন স্বয়ং ইন্দ্র। অলৌকিকভাবে কিংবা নাটকীয়ভাবে হলেও, সেবারের মতো বেঁচে যান ইন্দ্র।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/18/1563457602275.jpg
ভারত সরকার ইন্দ্রলাল রায়ের জন্মশত বার্ষিকীতে তার সম্মানে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করে ◢

 

ইন্দ্রলাল ছবি আঁকতেন চমৎকার। অসুস্থতার সময় অনেকগুলো স্কেচ করেছিলেন তিনি। অদ্ভুতভাবে তার সবগুলোই ছিল যুদ্ধবিমানের ছবি। কিন্তু ইন্দ্রলাল ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেও তৎক্ষণাৎ বিমান চালানোর ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি তাকে। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা ইন্দ্রও তখন নাছোড়বান্দা, তিনি না শুনতে নারাজ। অতঃপর তিনি ক্যাপ্টেন জর্জ ম্যাকরয়-এর তত্ত্বাবধানে নিবিড়ভাবে প্রশিক্ষণ নিলেন, পুরনো ছন্দে নতুন করে ফিরে আসার জন্য কষ্ট-ক্লেশ করতে থাকেন। ফিরেও এলেন, আরো বেশি আত্মপ্রত্যয় নিয়ে। ১৯১৮ সালের ২২ জুন ৪০ নম্বর স্কোয়াড্রনে সাময়িক লেফটেন্যান্ট পদে যোগ দেন এবং তিনি বদ্ধপরিকর।

৬ জুলাই, ১৯১৮। দীর্ঘ সাত মাস পর আবারও বিমান নিয়ে ইন্দ্রলাল উড়ে যান যুদ্ধক্ষেত্রে। প্রথম দিনেই তিনি পরাজিত করেন এক জার্মান বিমান। এই জয়ের ছবি তিনি এঁকে রেখেছিলেন তাঁর আঁকার খাতায়। ছবিটির তলায় লিখে রাখেন “৬ জুলাই, ১৯১৮। ৫.৪৫ এএম এন ই অফ আরাস, হ্যানওভার রানার, ২ সিটার, শট ডাউন বাই আই এল রায়।” তিনদিন ধরে চলা যুদ্ধে তিনি সর্বমোট নয়টি জার্মান বোমারু এবং ফাইটার প্লেন বিধ্বস্ত করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় বিমান চালক, যিনি টানা ১৭০ ঘণ্টা বিমান চালানোর রেকর্ড গড়েছিলেন।

কিন্তু এর তিনদিন পর, ২২ জুলাই ১৯১৮ তারিখে ফ্রান্সের আকাশে জার্মান বিমানবাহিনীর সাথে এক সম্মুখ যুদ্ধে তাঁর এসই-৫এ বিমানটি ফ্রান্সের জার্মান অধিকৃত এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। জার্মান সেনারা তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে সেখানেই সমাহিত করে। কথিত আছে, তাঁর অসাধারণ বীরত্বের কথা মনে রেখে সেই জার্মান শত্রুসেনারাও তিনি যেখানে পতিত হয়েছিলেন, সেখানে ফুলের তোড়া রেখে আসে। ল্যাডির কমান্ডিং অফিসার তার যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে তার মা ললিতা রায়কে একটি চিঠি লিখে জানান, “নয়টা জার্মান বিমানকে ইন্দ্রলাল একা পরাস্ত করেছেন। প্রত্যেক অফিসার তার প্রশংসা করেছেন। সকলের কাছে তিনি খুব জনপ্রিয়ও ছিলেন। আমি নিশ্চিত, তিনি তার এই সাহসিকতার জন্য পুরস্কৃত হবেন।”

এবং ওই বছরই রয়্যাল ফ্লায়িং কর্পস-এর নাম বদলে হয় দ্য রয়্যাল এয়ার ফোর্স। ১৩ দিনে নয়টি জার্মান যুদ্ধবিমান ধ্বংস করার অনন্য সাধারণ কৃতিত্বের জন্য তাকে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর তরফ থেকে মরণোত্তর ‘ডিস্টিংগুইশড ফ্লাইং ক্রস’ (DFC) উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি এই সম্মান পেয়েছিলেন। তার মানপত্রে লেখা হয়েছিল, “(ইন্দ্রলাল রায়) ভীষণ সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক অফিসার, যিনি ১৩ দিনে নয়টি জার্মান বিমানকে পরাস্ত করেছেন। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি অসাধারণ প্রতিভা দেখিয়েছেন।”

ভারত সরকার ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে ইন্দ্রলাল রায়ের জন্মশত বার্ষিকীতে তার সম্মানে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করে। এছাড়া ফ্রান্সে তাঁর সমাধির ওপর বাংলা ও ফরাসি ভাষায় গৌরবগাঁথা লেখা হয়েছে, “মহাবীরের সমাধি সম্ভ্রম দেখাও, স্পর্শ করো না।” কলকাতায় তার নামে একটি সড়ক আছে। ভবানীপুরে ইন্দিরা সিনেমাহলের কাছে যে সড়কটির নাম ‘ইন্দ্র রায় রোড’।

এ সম্পর্কিত আরও খবর