নেটফ্লিক্সের আদ্যোপান্ত

, ফিচার

তৌহিদ শরীফ, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-12-31 17:35:07

বিমানবন্দরে এলিজাবেথ চলে যাচ্ছে হয়তো কোনো কারণে অভিমান করে। চেক পোস্ট পেরিয়ে তার পিছু পিছু ছুটে আসতে দেখা যায় স্টিফেনকে। সে যখন এলিজাবেথের সামনে এসে দাঁড়ায় তখনই এলিজাবেথ অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে চমকে ওঠে, আবার আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে ওঠে—“আমি জানতাম তুমি আসবে।”
তখনই স্টিফেন বলে, “আমি আসছি একটা প্রশ্ন করতে।”
এলিজাবেথ বলে, “তুমি আমাকে যে কোনো প্রশ্ন করতে পারো।”
স্টিফেন বলে, “নেটফ্লিক্সের পাসওয়ার্ড কী বলো।”


২০১৫ সালের দিকে এরকম একটা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সারা বিশ্বে নেটফ্লিক্সের প্রয়োজনীয়তা, ক্রেইজ ও প্রায়োরিটি মুভি লাভারদের কাছে তুলে ধরে হয়—যা ধীরে ধীরে এখন মোটামুটি সবারই বোধগম্য।

নেটফ্লিক্স সম্পর্কে বলার আগে অনলাইন স্ট্রিমিং কী জিনিস সেটা একটু ক্লিয়ার থাকা ভালো। অনলাইন স্ট্রিমিং বলতে মূলত সে সার্ভিসকে বোঝায় যেটা ক্যাবল এবং স্যাটেলাইটের বদলে শুধুমাত্র অনলাইনে দেখার ব্যবস্থা আছে। যেখানে গ্রাহক কিছু অর্থের বিনিময়ে বা অর্থ ছাড়া সার্ভিসটি উপভোগ করতে পারে। পেমেন্টের ধরন একেক দেশে একেক রকমের হয়ে থাকে। অনলাইন স্ট্রিমিংয়ে যত ধরনের এন্টারটেইনমেইন্ট আছে যেমন ফিল্ম, ডকুমেন্টারি, টিভি শো, ওয়েবসিরিজ ইত্যাদি সব দেখতে পারবে গ্রাহক তার ইচ্ছে মতো যে কোনো সময় যে কোনো মুহূর্তে। এই সার্ভিস প্রভাইড করা হয় ক্লাউড বেইজ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে।

নেটফ্লিক্সের নাম কিন্তু শুরুতে নেটফ্লিক্স ছিল না। এর নাম ছিল “কিবল”, শুরুতে তারা ডিভিডি ভাড়া দিত। কোম্পানিটি ভিডিও স্ট্রিমিং সার্ভিস শুরু করে নেটফ্লিক্স নাম জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পর থেকে।

১৯৯৭ সালের ২৯ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে যাত্রা শুরু করে নেটফ্লিক্স। ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের লোশ গ্যাটস শহরে নেটফ্লিক্সের সদর দপ্তর। তারা তাদের ডিভিডি রেন্টালের কাজ শুরু করে ১৪ এপ্রিল, ১৯৯৮ সালে। মাত্র ৩০ জন কর্মচারী দিয়ে কার্যক্রম শুরু করে ২০০০ সালের দিকে প্রায় ৩ লাখ গ্রাহক হয়ে যায় নেটফ্লিক্সের। ১০ বছর পরে অর্থাৎ ২০০৭ সাল থেকে নিবন্ধনকৃত গ্রাহকদের জন্য ভিডিও অন ডিম্যান্ড অনলাইন স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে কাজ শুরু করে নেটফ্লিক্স। এই সেবা পাওয়ার জন্য গ্রাহককে নেটফ্লিক্স সাইটে ক্রেডিট কার্ডের তথ্য দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। ওই ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমেই এর সেবার ফি পরিশোধ করতে হয়। নেটফ্লিক্স ছাড়া আর কারো এর থেকে আয় করার কোনো সুযোগ নেই। 

বর্তমানে বাংলাদেশসহ মোট ১৯০টি দেশে জনপ্রিয় অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং সেবা চালু করেছে নেটফ্লিক্স। এই দেশগুলোতে নিবন্ধিত গ্রাহকেরা যে কোনো স্থান থেকে খুব সহজে টিভি শো, মুভি অথবা সিরিজ উপভোগ করতে পারছেন। মাসিক ৮ থেকে ১২ ডলার সাবস্ক্রিপশন চার্জ হলেও বাংলাদেশে এটি কম জনপ্রিয় নয় বরং বিনোদনের যে বিশাল সাম্রাজ্য আপনার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে সেই তুলনায় অনেকের বিবেচনায় এ খরচ কমই। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অনুষ্ঠান দেখার মাঝখানে অযথা বিজ্ঞাপন হজম করতে হবে না কাউকে। চীন, উত্তর কোরিয়া, ক্রিমিয়া, সিরিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে নেটফ্লিক্সের সেবা নিষিদ্ধ থাকলেও নিষেধাজ্ঞা যে কেউ ভাঙছে না ব্যাপারটা এরকম নয়। এগুলো ডিজিটাল দুনিয়ার দৈনন্দিন ঘটনা।

২০১৬ সালে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নেটফ্লিক্স বাংলাদেশসহ আরো বিভিন্ন দেশে তাদের বিজনেস ছড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশে বিগত দুই বছরের অধিক সময় ধরে ব্যবসা করে যাচ্ছে নেটফ্লিক্স যার গ্রাহক সংখ্যা ইতোমধ্যে দুই লক্ষাধিক। এই দুই লক্ষ গ্রাহকের কাছ থেকে প্রতি মাসে অন্তত ১৮ কোটি টাকা যা এক বছরের হিসাব করলে দাঁড়ায় প্রায় ২৫০ কোটি টাকা, দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং আটকানোর কোনো উপায়ও নেই।
সারা বিশ্বে তাদের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ১৫৮ মিলিয়ন। যার মধ্যে ৬১.৯৭ মিলিয়ন গ্রাহকের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রে। ২১টি দেশে অনুষ্ঠান নির্মাণের সাথে জড়িত নেটফ্লিক্স। সারা বিশ্বে নেটফ্লিক্সের গ্রাহকরা প্রতি সেকেন্ডে বিশ্বের ১৫ ভাগ ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ নেটফ্লিক্সের জন্য ব্যবহার করে থাকে।

অনেকে মনে করেন নেটফ্লিক্সের প্রযোজিত প্রথম প্রোগ্রাম “হাউজ অব কার্ডস”, আসলে কিন্তু তা নয়, এটি তাদের প্রথম বাণিজ্যিক প্রোগ্রাম হলেও তাদের অরিজিনিয়াল প্রথম প্রোগ্রাম ছিল “এক্সাম্পল শো”। ২০১০ সালে নেটফ্লিক্স “এক্সাম্পল শো” নামে একটা প্রোগ্রাম করে। এটি তাদের প্রথম প্রযোজিত প্রোগ্রাম। এগার মিনিটের এই প্রোগ্রাম ছিল অনেকটা কমেডি ঘরানার। 

নেটফ্লিক্স কিভাবে সিনেমা হল বা টেলিভিশন বিজনেস কেড়ে নিচ্ছে? একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে নেটফ্লিক্স গ্রাহকেরা প্রতি বছরে গড়ে ৮২টি করে ফিচার ফিল্ম দেখতে পান। আর হলিওডের ওয়ারনার ব্রাদারস একই সময়সীমার মধ্যে মুক্তি দিতে পারে মোট ২৩টি সিনেমা। সবচেয়ে ব্যবসাসফল স্টুডিও হিসেবে পরিচিত ডিজনি সিনেমা হলে দেয় আরো কমসংখ্যক সিনেমা, মাত্র ১০টি।

গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ—এই তিন মাসে নেটফ্লিক্সের বিশ্বব্যাপী গ্রাহক বেড়েছে ৭৪ লক্ষ। নতুন গ্রাহকরা এই সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে দিচ্ছে ১২ কোটি ডলার। বিখ্যাত ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাক্স-এর ভাষ্যমতে, ২০২২ সালের মধ্যে নেটফ্লিক্স অনুষ্ঠান বাবদ খরচ করতে পারে বছরে ২ হাজার ২৫০ কোটি ডলার। তবে দিনে দিনে তাদের প্রোগ্রামের সংখ্যা বেশ বেড়ে যাচ্ছে তাছাড়া বাড়ছে গ্রাহক, তাতে করে চাহিদার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করতে হচ্ছে নতুন নতুন সব প্রোগ্রাম।

তবে নেটফ্লিক্সের সুদিনের জোয়ারে দিন দিন ভাটার টানও দেখা দিচ্ছে। কারণ এতদিন ধরে খালি মাঠে গোল দিয়ে আসছিল নেটফ্লিক্স, ছিল না কোনো জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বী। এবার মাঠে আসছে অ্যামাজন, অ্যাপল, ফেসবুক, ইউটিউব, ডিজনিসহ সব বড় বড় রথী-মহারথী ও টেক জায়ান্টরা। এরই মধ্যে নেটফ্লিক্সের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা করার মতো সক্ষমতায় পৌঁছে গিয়েছে অ্যামাজন। অন্তত যেসব জায়গায় নেটফ্লিক্স দেখা যায় সেসব জায়গায় অ্যামাজনও তার উপস্থিতি মোটামুটি নিশ্চিত করছে। অনুষ্ঠান নির্মাণের পেছনে গত বছর ৪০০ কোটি ডলার খরচ করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। হুট করে প্রতিদ্বন্দ্বী পাওয়ায় কিছুটা বিপাকে পড়ে যায় নেটফ্লিক্স। যেসব সৃজনশীল প্রতিষ্ঠান নেটফ্লিক্সের জন্য ভিডিও নির্মাণ করত, তারাই এখন প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে দেখা দিয়েছে। হলিউডের কিছু স্টুডিও গ্রুপ নেটফ্লিক্স থেকে তাদের সিরিজ বা সিনেমা সরিয়ে নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। এরা যদি আরো আক্রমণাত্মক আচরণ করে তবে তা সামাল দেওয়া নেটফ্লিক্সের জন্য কঠিন হয়ে যেতে পারে। 

স্বাভাবিকভাবেই এই বাজার-প্রতিযোগিতায় খুশি অনুষ্ঠান নির্মাতারা কারণ আগে যেখানে একটি মাত্র প্ল্যাটফর্ম ছিল এখন সেখানে দর কষাকষির সুযোগ রয়েছে। নেটফ্লিক্সের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দাঁড়িয়েছে অ্যামাজন কারণ এই প্রতিষ্ঠানের বাজার মূল্য নেটফ্লিক্সের তুলনায় ৬ গুণ বেশি। ধারণা করা হচ্ছে ২০১৯ সালের মধ্যেই বাজারে নামবে টেক জায়ান্ট অ্যাপল, যা চলতি প্রতিযোগিতায় যোগ করবে অন্য মাত্রা।

এমন অবস্থায় মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার জিতে গ্রাহকদের ধরে রাখতে চাইছে নেটফ্লিক্স। একই সঙ্গে নতুন নতুন গ্রাহক টেনে আনতে এসব পুরস্কারকে ব্যবহার করতে চাইছে প্রতিষ্ঠানটি।

২০১৮ সালে কান উৎসবে নেটফ্লিক্সের ফিল্ম নিয়ে ঝামেলা সৃষ্টি হয়। কান কর্তৃপক্ষ মনে করছে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি ছাড়া কোনো সিনেমা তারা গ্রহণ করবে না। ফলে ওই উৎসবে নেটফ্লিক্সের কোনো সিনেমা কানে যেতে পারেনি। অথচ বড় বড় পরিচালকেরা এখন নেটফ্লিক্সের অর্থায়নে ফিল্ম বানাচ্ছে। পরবর্তীতে কান কর্তৃপক্ষ নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। ফলে আলফানসো কোয়ারনের মতো ডিরেক্টদের নেটফ্লিক্সের মুক্তি দেওয়া সিনেমা “রোমা” কানে পুরস্কৃত হয় এবং অস্কারও পায়। শুধু তাই নয় মার্টিন স্করসিসের মতো ডিরেক্টররা পর্যন্ত এখন নেটফ্লিক্সে তাদের সিনেমা মুক্তি দিচ্ছে। 


২০১৭ সালের এপ্রিলে নেটফ্লিক্স মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর “পিঁপড়াবিদ্যা” ও “টেলিভিশন” সিনেমা দুটি কিনে নেয়। ২০১৭ সালের ১৫ মে সিনেমা দুটি প্রকাশ করে নেটফ্লিক্স। সিনেমা দুটি কিনে নেওয়ার সময় মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তার মতামত দেন এইভাবে—“শুধু প্রদর্শনই নয়, চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করছে নেটফ্লিক্স। দুনিয়াজোড়া এন্টারটেইনমেন্ট ওয়ার্ল্ডের মোঘল হয়ে উঠছে তারা। তাদের সর্বশেষ বিগ বাজেট প্রোডাকশন হচ্ছে মার্টিন স্করসেসি’র পরবর্তী ছবি এবং এবারের কান উৎসবে প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত বং জুন হো’র ‘ওকজা’! তো এই নেটফ্লিক্স ভারতের ছবি কিনছে বেশ কিছুদিন ধরে। ভারতে প্রযোজনাও করছে। আমি ভাবতাম, তারা বাংলাদেশের কনটেন্ট নেবে কবে। অবশেষে বলতে পারছি, নেটফ্লিক্স বাংলাদেশের দুইটা ছবি নিয়েছে। ছবি দুটি এই অধমের বানানো ‘টেলিভিশন’ এবং ‘পিঁপড়াবিদ্যা’।”

এই বছর নেটফ্লিক্স কিনে নেয় নূর ইমরান মিঠুর “কমলার রকেট”।

একটা মজার ঘটনা দিয়ে শেষ করতে পারি। ডিভিডি ও ভিডিও রেন্টাল সার্ভিস ব্লকবাস্টারকে ৫০ মিলিয়ন ডলারে নেটফ্লিক্স কিনে নেওয়ার অনুরোধ করেছিল কো-ফাউন্ডার রিড হ্যাসটিংস। কিন্তু ব্লকবাস্টারের কাছে এটাকে তেমন সম্ভাবনাময় মনে হয়নি। তখন আসলে সম্ভাবনাময় মনে না হওয়ারই কথা কিন্তু পরবর্তীতে এই নেটফ্লিক্স যখন ব্লকবাস্টার থেকে অনেকগুণ এগিয়ে আছে তখন ব্লকবাস্টার অনেকটাই ডুবন্ত অবস্থায়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর