ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড এবং ইউরোপিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের সদর দপ্তর অবস্থিত এই লর্ডসেই। ২০০৫ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) সদর দপ্তরও ছিল এখানে। ঐতিহ্যবাহী এই স্টেডিয়ামের বয়স কম হলো না! দেখতে দেখতে হয়ে গিয়েছে ২০৫ বছর। ১৮১৪ সালে লন্ডনের সেন্ট জন উডে প্রতিষ্ঠিত হয় স্টেডিয়ামটি, এর প্রতিষ্ঠাতা থমাস লর্ডের নামে। মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) মালিকানায় থাকা স্টেডিয়ামটি মিডলসেক্স কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের বাড়ির মাঠ। তবে আজকের লর্ডস স্টেডিয়ামটি প্রতিষ্ঠাকালীন সময়কার অবস্থানে নেই। ১৭৮৭ থেকে ১৮১৪’র মধ্যকার সময়ে লর্ডের প্রতিষ্ঠা করা তিনটি ক্রিকেট মাঠের সর্বশেষটিই হলো বর্তমান জগদ্বিখ্যাত লর্ডস স্টেডিয়াম। লর্ড থমাসের বানানো দ্বিতীয় মাঠ লর্ডস মিডল গ্রাউন্ড খেলার জন্য ব্যবহার করা হতো ১৮১১ থেকে ১৮১৩’র মধ্যে, যা পরে রিজেন্ট খালের পাশে বানানো মাঠের বহিরাংশের ভেতরে নির্মাণ কাজের কারণে পরিত্যক্ত করা হয়েছিল। বর্তমান লর্ডস মাঠটি অবস্থিত এই মিডল গ্রাউন্ডের ২৫০ গজ উত্তর-পশ্চিমে। এর ধারণক্ষমতা প্রায় ৩০,০০০। তবে এর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব বিবেচনাধীন রয়েছে।
লর্ডসে রয়েছে আটটি স্ট্যান্ড। প্যাভিলিয়ন থেকে ঘড়ির কাঁটার অবস্থান বিবেচনা করলে এর বাকি সাতটি স্ট্যান্ড হলো—ওয়ার্নার স্ট্যান্ড, গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড, কম্পটন স্ট্যান্ড, মিডিয়া সেন্টার, এডরিচ স্ট্যান্ড, মাউন্ড স্ট্যান্ড, ট্যাভার্ন স্ট্যান্ড, অ্যালেন স্ট্যান্ড। বেশিরভাগ স্ট্যান্ডই অবশ্য তৈরি করা হয়েছে বিশ শতকেই। ১৯৮৭ সালে নতুন মাউন্ড স্ট্যান্ড স্যার মাইকেল হপকিন্সের নকশায় তৈরি করা হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে নিকোলাস গ্রিমশয়ের নকশায় নির্মাণ করা হয় গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড। ফ্লাইং সসারের মতো দেখতে মিডিয়া সেন্টারটি তৈরি হয়েছে ১৯৯৮-তে। পিচের দুই প্রান্তের একটি হলো প্যাভিলিয়ন (দক্ষিণ-পশ্চিম) এন্ড, অপরটি হলো নার্সারি এন্ড (উত্তর-পূর্ব)।
লর্ডসের অন্যতম আকর্ষণ হলো বিখ্যাত লংরুমযুক্ত এর ভিক্টোরিয়ান যুগের প্যাভিলিয়ন। ১৮৮৯-৯০ সালের দিকে এটি নির্মিত হয় স্থপতি থমাস ভেরিটির নকশায়। অবশ্য ২০০৪-০৫-এ ৮ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করে একে নতুনরূপে সাজানো হয়েছে। প্যাভিলিয়নটি মূলত এমসিসির সদস্যদের জন্য, যারা এর সুযোগ-সুবিধাগুলো ব্যবহার করতে পারবে। এই সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে বসে ক্রিকেট খেলা দেখা এবং লংরুম ও বার ব্যবহার করা। প্যাভিলিয়নের ভেতরে ড্রেসিংরুমও আছে। আর আছে একটা ব্যালকনি, যেখানে দাঁড়িয়ে খেলোয়াড়রা খেলা দেখতে পারে। প্রধান দুটো ড্রেসিংরুমে অবস্থিত ‘অনার্স বোর্ড’, যেখানে লেখা থাকে লর্ডসের মাঠে সেঞ্চুরি পাওয়া বা পাঁচ উইকেট নেওয়া ক্রিকেটারদের নাম। বাংলাদেশের তিনজন ক্রিকেটারও এই সম্মানের অধিকারী হয়েছেন—তামিম ইকবাল, শাহাদত হোসেন ও মুস্তাফিজুর রহমান।
২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে লর্ডসের ২০৫ বছরের ইতিহাসে টেস্ট ম্যাচে সবচেয়ে দ্রুত সেঞ্চুরি হাঁকান বাংলাদেশের বাঁ-হাতি ওপেনার তামিম ইকবাল। ক্রিকেটের মক্কায় অনন্য এক রেকর্ড আছে বাংলাদেশ দলের পেসার শাহাদাত হোসেন রাজীবেরও। ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে লর্ডসে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। ১৫৮তম বোলার হিসেবে এই কীর্তি গড়েন টাইগার পেসার। আর সম্প্রতি চলমান বিশ্বকাপ ক্রিকেটেই পাকিস্তানের বিপক্ষে লর্ডসে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে ম্যাচে ৫উইকেট নিয়ে অনার্স বোর্ডে নাম ওঠান কাটার মাস্টার মুস্তাফিজ।
লর্ডসের অন্যতম আকর্ষণ এর সুদৃশ্য মিডিয়া সেন্টারটি। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আগে নির্মিত এই স্থাপনাটি বিশ্বের সর্বপ্রথম পুরো অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি, সেমি মনোকক ভবন। মাটির ওপর থেকে এটি ১৫ মিটার (৪৯ ফুট) উঁচু। স্থাপনাটির একমাত্র সাপোর্ট আসে এর দুটো লিফট শ্যাফটের চারপাশের কাঠামো থেকে। সেন্টারের নিচের অংশে ১০০ সাংবাদিকের পাশাপাশি বসে কাজ করার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। এর উপরের অংশে আছে টেলিভিশন ও রেডিও কমেন্ট্রি বক্স।
লর্ডসের অন্যতম মজাদার বিষয় হলো এর সামান্য ঢালু মাঠ। মাঠের উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তের চেয়ে ২.৫ মিটার উঁচু। এই ঢালের কারণে পিচের উপর পড়ার পর বলের বাউন্সে বেশ তারতম্য হয়। এই কারণে ব্যাটসম্যানদের এখানে ব্যাট করতে একটু ভিন্ন কৌশলেরই দরকার পড়ে।
লর্ডসে সাধারণত দিনের আলোতেই ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়, তবে ২০০৯ থেকে লর্ডসে ব্যবস্থা করা হয়েছে ফ্লাডলাইটেরও। লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে প্রথম খেলা হয় ২২ জুন, ১৮১৪-তে বর্তমান মেরিলেবোন ক্রিকেট ক্লাব এবং হার্টফোর্ডশায়ারের মধ্যে। ২০১৪ সালে ক্রিকেটের মক্কা ২০০ বছরে পদার্পণ করে। আর এই দুশো বছরে লর্ডসের বুকে অনুষ্ঠিত হয়েছে ক্রিকেটের সবচেয়ে পুরনো সংস্করণ টেস্টের ১০৫টি ম্যাচ। ১৮৮৪ সালের ২১ জুলাই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ইংল্যান্ডের ম্যাচ দিয়ে এ মাঠের আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়। এরপর একে একে ১০৫টি টেস্ট ক্রিকেটের সাক্ষী হয়েছে হোম অব ক্রিকেট ভেন্যুটি। যার শেষটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৮ সালের ১০ আগস্ট। ওই ম্যাচে পরস্পর মুখোমুখি হয়েছিল ইংল্যান্ড এবং ভারত। লর্ডসের মাঠের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচটিতে ১৯৭২ সালে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয় স্বাগতিক ইংলিশরা। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত ৫৬টি একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে, যা টেস্ট ম্যাচের তুলনায় অনেক কম। মূলত টেস্ট ক্রিকেটের ঐতিহ্য ধারণে মহাকালের সাক্ষী এই লর্ডস।
প্রথম ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৫’র ২১ জুন। এই ফাইনালটি ভাস্বর হয়ে আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েডের অসাধারণ সেঞ্চুরির ইনিংসে। ফাইনালটিতে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া। ৫০ রানে তিন উইকেট পড়ার পর ব্যাটিংয়ে নেমে তিনি দলকে ওই অবস্থা থেকে তুলে আনেন ১০২ রানের ইনিংসের মাধ্যমে। রোহান কানহাইয়ের সাথে মিলে গড়েন ১৪৯ রানের চতুর্থ উইকেট জুটি। এর মাধ্যমেই নির্ধারিত ৬০ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পায় ২৯১ রানের ভালো একটা সংগ্রহ। জবাবে ব্যাট করতে নেমে উইন্ডিজ বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের মুখে ২৭৫ রানের বেশি করতে পারে না প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। ম্যাচটি উইন্ডিজ জিতে নেয় ১৭ রানে।
দ্বিতীয় বিশ্বকাপটিও অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইংল্যান্ডে এবং ফাইনালটি যথারীতি অনুষ্ঠিত হয় লর্ডসেই। সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান স্যার ভিভ রিচার্ডসের কাব্যিক ১৩৮ রানের ইনিংসে ভর করে উইন্ডিজ প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডকে টার্গেট দেয় ২৮৭ রানের। পঞ্চম উইকেটে কলিস কিংয়ের সাথে গড়ে ওঠা ১৩৯ রানের জুটির কারণেই মূলত ভালো একটা টার্গেট দিতে পারে উইন্ডিজ। জবাবে মাইক ব্রিয়ারলি ও জেফ্রি বয়কটের শ্লথগতির ওপেনিং পার্টনারশিপ ইংলিশদের নিয়ে যায় বিনা উইকেটে ১২৯ রানে, তবে বাড়িয়ে দেয় রানরেটের চাপ। এই চাপে এবং পরে জোয়েল গার্নারের আগুন ঝড়া বোলিংয়ে ইংল্যান্ড যেতে পারে মাত্র ১৯৫ রান পর্যন্ত। ম্যাচটা ৯২ রানে জিতে টানা দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় ‘বিগ ক্যাট’ ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
১৯৮৩’র জুনে টানা তৃতীয়বার ইংল্যান্ডেই অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপ ক্রিকেট। যথারীতি টানা তৃতীয়বারের মতো ফাইনালে ওঠে তৎকালীন পরাশক্তি উইন্ডিজ। প্রতিপক্ষ হয় অনেককেই চমকে দিয়ে ফাইনালে ওঠা ভারত। সবাই ওয়েস্ট ইণ্ডিজকেই হ্যাট্রিক চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দেখতে পাচ্ছিলেন। কেউই ভাবতে পারেনি ভারত ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দেবে। ভারত প্রথমে ব্যাট করে ১৮৩ রানে অলআউট হওয়ার পর তো সবাই মনে করেছিল, হেসেখেলে জিতে যাবে উইন্ডিজ। কিন্তু ক্রিকেট তো ‘গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা।’ কপিল দেবের ক্ষুরধার মস্তিষ্কের অধিনায়কত্ব ও ভারতীয় বোলারদের সুনিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ওই রান তাড়া করতে গিয়েই ঘাম ছুটে যায় উইন্ডিজের। আর ৪০ গজ দৌঁড়ে কপিল দেবের নেওয়া ভিভ রিচার্ডের ক্যাচ ঘুরিয়ে দেয় ম্যাচের মোড়। কপিলের এই অবিশ্বাস্য ক্যাচ দলের সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয় অসাধারণ প্রাণশক্তি। একের পর এক উইকেট পড়তে থাকে উইন্ডিজের। তারা অলআউট হয়ে যায় ১৪০ রানেই। প্রথমবারের মতো কাপ ওঠে ভারতীয়দের হাতে।
লর্ডসের সর্বশেষ বিশ্বকাপের ফাইনাল ছিল ১৯৯৯ সালে। ১৬ বছর পরে আবার ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত এই বিশ্বকাপে ফাইনালে ওঠে অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তান। একপেশে এই ফাইনালে লেগ স্পিন জাদুকর শেন ওয়ার্নের ঘূর্ণিজালে আটকা পড়ে মাত্র ১৩২ রানে অলআউট হয়ে যায় পাকিস্তান। ২৩ রানে ৪ উইকেট দখল করেন ওয়ার্ন। জবাবে, মাত্র ২ উইকেট হারিয়ে টার্গেট টপকে দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় অস্ট্রেলিয়া। বর্তমান ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া যে ‘মাইটি অস্ট্রেলিয়া’ হিসেবে পরিচিত, সেটার যাত্রাশুরু ধরা হয় এই বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাধ্যমেই।
এই লর্ডসেই আগামীকাল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ২০১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনাল। নিশ্চয়ই, স্মরণীয় আরো কিছু ক্রিকেট মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছে লর্ডস!