বসনিয়া গণহত্যার ২৪ বছর

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-09-01 16:41:06

সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত সমাজতন্ত্রপন্থী দেশগুলোতেও পালাবদল দেখা দেয়। শুরু হয় নতুন রাষ্ট্রগঠন ও জাতিগত অধিকারের আন্দোলন। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় যুগোস্লাভিয়া। সে দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মতো বসনিয়ান মুসলমানরাও স্বাধীকারের দাবি তোলেন।

কিন্তু সংখ্যাগুরু সার্বিয়ানরা সে দাবি না মেনে সংখ্যালঘু বসনিয়ান মুসলমানদের ব্যাপকভাবে হত্যা ও নির্যাতন করে। গত ১১ জুলাই নৃশংস গণহত্যার চব্বিশ বছর পূর্ণ হলো।

ইতিহাসের নৃশসংতম এ হত্যাকাণ্ড জাতিসংঘের নীরব সর্মথনে পরিচালিত হয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। উগ্র খ্রিস্টান সার্বিয়ান কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যায় নির্মম নির্যাতন, গণহারে ধর্ষণ আর দেশ থেকে বিতাড়নের ভয়াবহতম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল বসনিয়ার মুসলমানদের।

পরিসংখ্যান মতে, ৪০ হাজার মুসলিম আদিবাসীকে উৎখাত করা হয় বসনিয়ার স্রেব্রেনিচা থেকে। জবাই করা হয় আট হাজার মুসলমানকে। হত্যার পর তড়িঘড়ি করে মৃতদের গণকবর দেওয়া হয়। হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা গোপন করতে পরে গণকবর থেকে মৃতদেহগুলো তুলে আলাদা ৭০টি স্থানে পুঁতে ফেলে সার্ব সেনারা। বসনিয়ার গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে নিষ্ঠুরতম জাতিগত নিধন ও চরম নৃশংসতার ঘৃণিত দৃষ্টান্ত হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

ঘটনার প্রাথমিক সূত্রপাত ১৯৯০ এর দশকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর। চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে যুগোস্লোভিয়ার রাষ্ট্রনায়ক মার্শাল টিটোর মৃত্যুর পর। তখন দেশটি বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যেগুলো হলো, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মেসিডোনিয়া, বসনিয়া প্রভৃতি। কিন্তু ভিন্ন ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধ দিলে আঞ্চলিক নেতারা সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি নৃশংস গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। সেটি ছিল ১৯৯১ সালের ঘটনা। গৃহযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি নৃশংসতা আর নিপীড়নের শিকার হয় মুসলিম জনগোষ্ঠী।

উল্লেখ্য, সাবেক যুগোস্লাভ প্রজাতন্ত্রে কয়েকটি জাতির বাস ছিল। এদের মধ্যে সার্ব (গোঁড়া খ্রিস্টান) ৩৬.৫%, ক্রোট (রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান) ১৯.৭% এবং মুসলমান ৮.৯%। বাকিরা অন্যান্য জাতি। জনসংখ্যার দিক থেকে সার্ব ও ক্রোটদের সংখ্যাই বেশি। এই দুটি জাতির প্রধান আবাসস্থল সার্বিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থিত মুসলমানদের অঞ্চল বসনিয়া।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, পূর্ব ইউরোপের বলকান অঞ্চলের বসনিয়া জায়গাটি তুরস্কের উসমানিয়া খেলাফতের অধীনে শত শত বছর শাসনাধীন থেকে শক্তিশালী মুসলিম জনপদে পরিণত হয়। ১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত বসনিয়ায় মুসলমানরা একক বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করত। পরবর্তী দুই দশকে, অসংখ্য সার্ব আর ক্রোয়াট বসনিয়ায় অভিবাসিত হন। এর ফলে ১৯৯১ এর এক আদমশুমারিতে দেখা যায়, বসনিয়ার ৪০ লাখ বাসিন্দার ৪৪ শতাংশ বসনিয়ান, ৩১ শতাংশ সার্ব, আর ১৭ শতাংশ ক্রোয়াট। তথাপি বসনিয়ার মুসলিম প্রাধান্য অব্যাহত থাকে।

গণহত্যা ও গৃহযুদ্ধ শুরু হলে পূর্ব বসনিয়ার তিনটি শহর–স্রেব্রেনিচা, জেপা, ও গোরাজদেকে ১৯৯৩-এ জাতিসংঘ ‘মুক্তাঞ্চল’ ঘোষণা করেছিল, যা নিরস্ত্রীকৃত ও রক্ষিত হওয়ার কথা ছিল আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীদের দ্বারা। জাতিসংঘ কর্তৃক এলাকাগুলো মুক্তাঞ্চল ঘোষণার পর অন্যান্য এলাকার মুসলমানরাও নিরাপত্তার জন্য এ এলাকাগুলোতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল সার্বদের নৃশংসতার কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।

কিন্তু এখানকার আশ্রয় গ্রহণকারীরা সার্ব উগ্র খ্রিস্টানদের হামলা থেকে নিজেদের নিরাপদ মনে করতে পারছিলেন না। যে কোনো সময় সার্বরা আক্রমণ করে বসতে পারে, এমন আশঙ্কায় ছিলেন। কিন্তু জাতিসংঘের নিরাপত্তারক্ষীদের ওপরও ভরসা করা যাচ্ছিল না। যদিও মুক্তাঞ্চল ঘোষণার পর কোনো ধরনের সশস্ত্র তৎপরতা চালাতে নিষেধ করা হয়েছিল আন্তর্জাতিকভাবে এবং মুসলমানদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্যেও আত্মরক্ষামূলক প্রস্তুতি নিতে দেওয়া হয়নি। মুসলমানদের আত্মরক্ষার আবেদন জাতিসংঘ বারবার খারিজ করে দেয়।

ফলে মারাত্মক সংঘাত কবলিত অঞ্চলের মুসলমানদের আত্মরক্ষার কোনো প্রস্তুতি ছিল না। অথচ সার্ব ও ক্রোয়াটরা ছিল মারণাস্ত্র সজ্জিত। এমতাবস্থায় জাতিসংঘের মোতায়েনকৃত নিরাপত্তারক্ষীদের উপস্থিতিতেই ১৯৯৫-এর ১১ জুলাই সার্ব সেনারা রণসাজে স্রেব্রেনিচা এলাকায় আসে। আক্রমণকারীদের এলাকায় নিয়োজিত জাতিসংঘের নিরাপত্তারক্ষীরা সামান্যতমও বাধা দেয়নি। তাদের চোখের সামনেই হিংস্র খ্রিস্টান সার্ব সেনারা প্রথমে মুসলিম নারী ও শিশুদের আলাদা করে নেয়। তারপর পুরুষদেরকে গণহারে হত্যা করতে থাকে। শিশুরাও নিস্তার পায়নি এ নৃশংসতা থেকে। তবে নারীদেরকে বন্দী করে নিয়ে যায়। সার্বিয়ান বিশেষ শিবিরে নিয়ে চলানো হয় গণহারে ধর্ষণ।

২৪ বছর আগের সেই কলঙ্কিত জাতিগত নিধন ও গণহত্যায় স্রেব্রেনিচায় সেদিন আট হাজারেরও অধিক মুসলমানকে হত্যা করে সার্ব বাহিনী। জাতিসংঘ এ অঞ্চলকে নিরাপদ বলে ঘোষণা করেছিল, সেখানেই মারা হয় মুসলমানদের। পাশেই দাঁড়ানো ছিল জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী। শান্তিরক্ষী সৈন্যরা ছিল হল্যান্ডের অধিবাসী। তারা যখন বসনিয়ায় শান্তি মিশনে এলো, তখন জঙ্গি সার্বরা ১৪ জন সেনাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। শান্তিরক্ষীরা স্বদেশি ওই ১৪ শান্তিরক্ষীকে মুক্ত করার জন্য বসনিয়ায় তাদের ঘাঁটিতে আশ্রয় নেওয়া এবং প্রায় ৫ হাজার বসনিয় মুসলমানকে জঙ্গি সার্বদের হাতে তুলে দেয়। সার্ব সেনারা শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তা বিধানের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে তাদের ওপর হামলা না করার ও তাদের নিরাপদে সার্বিয়া প্রত্যাবর্তনের সুযোগও লাভ করে।

ফলে নিষ্ক্রিয় শান্তিরক্ষী বাহিনীর চোখের সামনে আস্ত একটি শহরকে ধূলিস্মাৎ করে সার্বরা সে শহরের প্রায়-সকল স্থাপনা ধ্বংস ও নাগরিকদের বিনা বাধায় হত্যা করে। স্রেব্রেনিচার গণহত্যায় নিহত ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজন ওই গণহত্যা প্রতিরোধে নিস্ক্রিয়তা ও গণহত্যায় সহায়তার জন্য দায়ী শান্তিরক্ষীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার উদ্যোগ নিলেও হেগের আন্তর্জাতিক আদালত ওই মামলা গ্রহণ করেনি। বসনিয়ার গণহত্যা শেষে সেখানকার জাতিগত শুদ্ধি অভিযান সম্পর্কে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে স্রেব্রেনিচায় গণহত্যা ঠেকানোর ব্যাপারে হল্যান্ড সরকার ও জাতিসংঘের অবহেলার কথা স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু ওই মারাত্মক দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য এ পর্যন্ত হল্যান্ড এবং জাতিসংঘের তৎকালীন কোনো কর্মকর্তাকে কখনো বিচারের সম্মুখীন করা হয়নি।

বসনিয়ার গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের নৃশংস ঘটনা ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়। হত্যাকারী সার্ব বাহিনীর পাশাপাশি নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও অভিযুক্ত হয়ে আছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর