তবে কি বোকা বাক্সের বিদায়!

, ফিচার

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 18:26:10

সময়টা নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। শুধু রাজধানী ঢাকায় কেন! এই দেশের গ্রামগঞ্জ থেকে হারহামেশাই বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার হেরে যাওয়ার দুঃখ আর ক্ষোভে টেলিভিশন ভাঙার খবর আসত। ডিশ এন্টেনা নামে বহুল প্রচারিত স্যাটেলাইটের সংযোগ, শহরের ড্রইং রুমগুলোতে প্রবেশ করার পর এই দেশের টেলিভিশনের সংস্কৃতি আরো ব্যাপক মাত্রা পেল। বিদেশি শতাধিক চ্যানেলের সঙ্গে গত তিন দশকে দেশি চ্যানেলের সংখ্যাও বাড়তে থাকল।

এই যেমন ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবল। ম্যারাডোনা, রোমারিওদের খেলা দেখতে আমাদের বাসাতেও চলে এলো ১৪ ইঞ্চি বাক্স ধরনের টেলিভিশন। সাদাকালো টেলিভিশনকে পেছনে ফেলে তখন রঙিন টিভির জয়জয়কার। সারাদিন মনে হয় সেই বোকা বাক্সটির দিকে তাকিয়ে বসে থাকা যেত।

বাজার দখল করছে স্মার্টটিভি

 

যেমন কুরবানি ঈদের আগে ফ্রিজের বিক্রি বেড়ে যায়, গরমের মৌসুমে ফ্যান বা এয়ারকনের বিক্রি বাড়ে, তেমনি খুব স্বাভাবিক ছিল বিশ্বকাপ ফুটবল বা ক্রিকেটকে ঘিরে টেলিভিশনের বিক্রি বেড়ে যাওয়া। দীর্ঘদিন ধরে বোকা বাক্সটিকে ভালোবেসে গেছে মানুষ।

জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক শুক্রবার বিকেলে শহরের ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিক্রির দোকানগুলোতে ঢুঁ মারলাম। এই ধরনের দোকানে ডিসপ্লেতে রাখা বড় টেলিভিশনে খেলা চলতে থাকে আর মানুষজন শো-রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে খেলা দেখে এটা কিন্তু নগরের পরিচিত দৃশ্য। আর হিসাব অনুযায়ী এই চেয়ে থাকা মানুষদের সংখ্যার মতো টেলিভিশনের বিক্রিও এই সময় ভালো হবার কথা।

তবে রামপুরায় বেস্ট ইলেকট্রনিক্সের একটি আউটলেটের বিপনী কর্মকর্তা কিন্তু জানালেন, এত ছাড়ের অফারের পরেও চলতি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময় বোকা বাক্সের বিক্রি কম।

কেন?

উত্তরে তিনি বললেন, মোবাইলে এত অ্যাপস রয়েছে খেলা দেখার যে, মানুষ আর আলাদা করে টিভি কিনতে চায় না৷ কারণ মানুষের ব্যাস্ততা বেড়েছে। ৭/৮ ঘণ্টা টিভির সামনে বসে থাকার সময় নেই। বরং মোবাইলেই কাজের ফাঁকে বা যাত্রাপথে স্কোরটা দেখে নিতে পারেন।

 মানুষ বায়োস্কোপ বা রেবিটহোলের মতো অ্যাপসে খেলা দেখেছে

 

নজরুল নামে ওই বিক্রেতা জানালেন, ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত ক্রিকেট বিশ্বকাপের আগেও শতাধিক টেলিভিশন সেট বিক্রয় হয়েছে। এবারে ১০টিও হয়নি। মানুষ এখন হাতের ডিভাইসেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

গুলশান ১-এর একটি বড় ইলেকট্রনিক্স বিপনী বিতানের বিক্রেতারও কথা একই। বলেন, প্রায় সব টিভিতেই ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। কিন্তু বিক্রি নেই।

তিনি বলেন, এখন মানুষ যদিও টিভি কেনে, স্মার্ট টিভিই কিনছে। এর কারণও মূলত ইন্টারনেটের মাধ্যমে টিভি দেখা। সেই কেবল লাইনে টিভি দেখার যুগ শেষ হয়েছে। আর খেলা দেখার কথা বললে, যারা বড় স্ক্রিণে খেলা দেখতে চান, তারা টিএসসি বা মানিক মিয়া এভিনিউতে চলে যান।

কলাবাগানের বাসিন্দা মাসুম বার্তা২৪.কম-কে বলেন, এখন শহরের সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসছে। যেসব মানুষ আগে বড় স্ক্রিনে খেলা দেখার জন্য বাসায় বড় টিভি কিনতেন, তারা এখন ক্যাফেতে চলে যাচ্ছেন। রাজধানীতে ক্যাফে কেন্দ্রিক খেলা উপভোগের একটি সংস্কৃতি চালু হয়েছে। বা খোলা স্থানে বিভিন্ন কোম্পানির চালু করা প্রজেক্টরে খেলা দেখছেন। ফলে বাসায় টিভি কিনে খেলা দেখার সময় কিন্তু আর নেই। এমনকি মাঝ রাতের খেলার সময়ও কিন্তু ক্যাফেগুলোতে ভিড় থাকছে।

যারা বড় স্ক্রিণে খেলা দেখতে চান প্রজেক্টরে খেলা দেখছেন

 

তিনি বলেন, চলতি বিশ্বকাপ ক্রিকেটে, মানুষ বায়োস্কোপ বা রেবিটহোলের মতো অ্যাপসে খেলা দেখেছে। আমি নিজেও তাই। কারণ হাতে এত সময় নেই যে বাসায় টিভি নিয়ে বসে খেলা দেখতে পারব। আর মাত্র ৫০ বা ৬০ টাকার প্যাকেজেই পুরো একমাস চলছে। এছাড়াও অনেক অ্যাপস ফ্রি খেলা দেখাচ্ছে। এই যেমন গেল বছর লা লিগা বাংলাদেশের দর্শকরা ফ্রিতে ফেসবুকেই রিয়েল টাইম দেখতে পেরেছে।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ের ছাত্র মাসুম জানান, সময়ের সঙ্গে মানুষের গণমাধ্যমের ব্যবহারে পরিবর্তন এসেছে। আগে চ্যানেলগুলো যা দেখাত মানুষ তাই দেখত। আর এখন মানুষ যা চায়, তা-ই ইন্টারনেটে খুঁজে পাচ্ছে। তাই নিজেই চাহিদা তৈরি করতে পারছে। ফলে নেটফ্লিক্স বা ইউটিউব এমনকি ফেসবুকেও চাহিদা অনুযায়ী ভিডিও খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর চ্যানেলগুলোও দর্শকদের ডিভাইস এবং চাহিদার কথা বিবেচনা করে ইউটিউব বা ফেসবুকে যেমন লাইভ থাকছে, তেমনি নিজেদের অ্যাপসেও রিয়েল টাইম উপস্থিতি নিশ্চিত করছে। কারণ, শুধু এই শহর না, দুনিয়া জুড়েই বোকা বাক্সের দিন শেষ হয়ে আসছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর