চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিবন্দনা

, ফিচার

মাহমুদ হাফিজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | 2023-08-31 21:26:46

গাড়ি চেরাপুঞ্জির দিকে যতো এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের এক্সাইটমেন্ট ততোই দানা বাধছে। কিশোর-যুবাদের কাছে চেরাপুঞ্জি এক নস্টালজিক গন্তব্য। স্কুলস্তরের ভূগোল বইয়ে বিশ্বের সবচেয়ে  বেশি বৃষ্টিপাত কোথায় হয়- প্রশ্নে চেরাপুঞ্জির নামটি লিখতে হয়েছে বার বার। কিশোর বয়স থেকে নামটি মনে গেঁথে রয়েছে। অতিবৃষ্টির এই বিশ্ব রাজধানীতে আজ সরজমিন দেখতে যাচ্ছি-ভেবেই গা শিউরে উঠছিল।

আজ গাড়িতে খাসি মেজবানদের ইভানিশা নেই। নতুন যোগ হয়েছে ডোডো নামে দলনেতা মিসেস ডেখারের বোন। আলাপ-গুঞ্জনে আমরা যতো চেরাপুঞ্জি শব্দ উচ্চারণ করি, তারা সোহরা সোহরা বলে খাসি ভাষায় বাতচিত করতে। ধারণা আছে চেরাপুঞ্জি বৃটিশদের দেয়া নাম। আদি নাম সোহরা ব্যবহার করতেই তারা বেশি স্বচ্ছন্দ। চেরা বা সোহরারিম ছিল আদি গ্রামটির নাম। এই ইস্ট খাসি হিল  জেলার  সাবডিভিশন। বৃটিশরা আসার পর চেরা গ্রামের দক্ষিণে তাদের সদর দফতর নির্মাণ করলে তখন থেকে এটি ‘সোহরা’ নামে পরিচিতি পায়। পরে যা চেরাপুঞ্জি নামে অভিহিত হতে থাকে। বৃটিশরা ১৮৩২ সালে এ্রখানে আসামের রাজধানীও প্রতিষ্ঠা করেছিল, ১৮৬৬ সালে তা সরিয়ে নেয়া হয় শিলংয়ে। এই সৌন্দর্যময় পাহাড়প্রকৃতির দূরত্ব শিলং থেকে ৫৬ কিলোমিটার।

এসব হিসাব নিকাশের দিকে মনযোগী না হয়ে আমরা এখন মত্ত হতে চাই বৃষ্টিবন্দনায়। কিশোর বয়স থেকে মনে  গেঁথে থাকা গন্তব্য দেখে নয়ন জুড়াতে চাই। ভারতীয় বন্ধুরাই সাবধান করে দিয়েছে, যাচ্ছো তো যাও, বৃষ্টি পাবে না। চেরাপুঞ্জিতে এখন বৃষ্টি হয় না। ভাবি, বৃষ্টি যদি না পাই, তাহলে চার পরিব্রাজকের সঙ্গে নেয়া চার রেইনকোট আর তিনটি ছাতার কি দশা হবে ! পায়ের জুতো, গায়ের জ্যাকেট সবই বৃষ্টি সহনক্ষম। বিশ্বের আর কোন ভ্রমণে এমন পূর্বপ্রস্তূতি নিয়েছি কিনা মনে পড়ে না। বৃষ্টিবন্দনায় খোদ মেঘের মধ্যে গাড়িতে বসে মনে মনে ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে, ছায়া দে রে তুই’ গেয়ে চলেছি।  

গাড়ি ছুটছে। পূর্বদিনের গাড়িচালক আজ আসেনি, নতুন একজনকে সেই চুক্তি করে পাঠিয়েছে। এই চালক কিছুটা বাংলা ভাষা জানে, আলাপীও। সে এটা ওটা দেখিয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করতে চাচ্ছে। আমাদের মন পড়ে আছে জানালার অদূরের অপূর্বমনোহর প্রকৃতিতে। শিলং থেকে ডাউকিমুখো যে রাস্তা, সেটি ধরে ছুটে চলেছি। পথে উমতিঙ্গর নামে একটি চমৎকার পাহাড়ি ছড়া বা খাল। খালটিতে পানি বেশি নেই। ভারিবষর্ণের সময় দূর পাহাড় থেকে নুড়ি ও বড় বড় পাথরের চাঁই এসে এর তলদেশে জমা হয়েছে। এই খাল গিয়ে মিশেছে মাফলাঙ ড্যাম থেকে উৎপন্ন উমলি নদীর সঙ্গে। উমতিঙ্গর সেতু পার হয়ে বামের দিকের রাস্তা চলে গেল ডাউকির দিকে। আমরা ছুটে চলি সোজা, মাজরঙের দিকে। মাজরঙ জনবসতিটি পেরিয়ে গেলেই গাড়ি ঢুকে পড়ে চমৎকার যাদুবাস্তবতার এক মেঘদল,পাহাড়ি ক্যাসকেডময় জগতে। আশপাশের দৃশ্যপট দ্রুতই বদলে যেতে থাকে। যেখানে জনবসতি কম, প্রকৃতিরই কর্তৃত্ব। এই অপার  সৌন্দর্যের শুরু মাউকদক সেতু থেকেই। সেতু পেরিয়ে কিছুদূর এগোলে কুয়াশাময় মেঘের ভেলার মধ্যে গাড়ি ঢুকে যায়। মেঘ জাপটে ধরে আমাদের। মেঘ কাটিয়ে কাটিয়ে গাড়ি সামনে এগোতে থাকে। গাড়ির মধ্যে আনন্দে হৈ চৈ করতে থাকি সবাই। কেউ গান ধরে, কেউ ছবি তোলে, কেউ মগ্ন আলাপচারিতায়। রাস্তার ডাইনে পাহাড় বামে খাদ, কখনো বামে পাহাড় ডাইনে খাদ। পাহাড়ের গা ঘেঁষে নির্মিত রাস্তা দিয়ে বাঁকের পর বাঁক পেরিয়ে গাড়ি  উঠে যাচ্ছে ওপরে। হিসাবমতে, আমাদের ঊর্ধ্বগামী হতে হবে সমুদ্রসমতল থেকে পাঁচ হাজার ফুটের মতো। মাউকদক উপত্যকার মজাটা হচ্ছে, এখানে পাহাড়ের পর পাহাড়। দুইপাহাড়ের মাঝখানে উপত্যকাজুড়ে সাদা মেঘের মেলা খেলা করে বেড়াচ্ছে। পাহাড়ি সবুজ আর সাদা মেঘ তৈরি করছে নয়নজুড়ানো দৃশ্যপট।

আমরা এই স্বর্গীয়  সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকি। আরও কয়েকটি পাহাড় পেরিয়ে গেলে কিছু জায়গা চোখে পড়ে যা মালভূমির মতো। রাস্তার পাশে বিভিন্ন হোটেল-রিসোর্টের সাইনবোর্ড। এর কিছু পর ঘন মেঘের মধ্যে ইশারা করে আমাদের হোস্ট কাম গাইড স্ট্রিমলেট ডেখার বলে ওঠেন, ‘ওই যে, কোল মাইনিং এরিয়া। এগুলোর কয়লা সব রফতানি হয়ে গেছে। এখন পরিত্যক্ত ’। একসময়ের জ্বালানি সাংবাদিক বলে এনার্জি নিয়ে আমার আগ্রহ এন্তার। দেখি ঘনমেঘের আবছা আঁধারে টিলা টিলা কিছু একটা দেখা যায়। কিছু ছোটখাটো স্থাপনাও আছে। র‍্যাটহোল মাইনিংয়ে মেঘালয়ে পাহাড় খুঁড়ে কয়লা তোলা হয় বলে মাইনিংয়ের বড় কোন স্থাপনা নেই বুঝতে পারি।

বৃষ্টির বিশ্ব বাড়িতেই আছি। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে মেঘ ছুঁতে পারছি না। কিছূক্ষণ বাইরে হাত রাখলেই হাত ভিজে যাচ্ছে পানিতে, কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই। সামনে চেরাপুঞ্জি টাউনশিপ। আমরা সেদিকে না গিয়ে সোজা এগোতে থাকি। হাতের বামদিকে ইকো পার্ক যাওয়ার রাস্তা পেরিয়ে গেলে সেভেন সিস্টার  ফলস। মেঘে ঢাকা বলে সেখানে ছবি তোলার জো নেই। আমরা সেখানে না নেমে বাংলাদেশ ভিউপয়েন্ট পেরিয়ে এগিয়ে যেতে থাকি খুব কাছ থেকে বাংলাদেশ দেখতে। গন্তব্য চেরাপুঞ্জি সেন্টার থেকে আট কিলোমিটার দূরে কোহ রামহা পিকনিক স্পট ও থাংখারাং পার্ক।

আট কিলোমিটার রাস্তার তিন কিলোমিটার কাঁচা। কংক্রিটের বদলে পাহাড়ি নুড়ি আর মাটি বালির। কাঁচা রাস্তাটির কোথাও কোথাও এবড়োখেবড়ো। ভারিবর্ষণ হলে তা আর চলার মতো অবস্থা থাকে না, বন্ধ হয়ে যায়। সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছতে এপথ ক্রমশ পাহাড়ি ঢালুর দিকে নামতে থাকে। সচরাচর ড্রাইভাররা এই স্পটের দিকে ভুলেও যেতে চায় না বলে জানাচ্ছে আমাদের আজকের ড্রাইভার। এমনিতে দূর, রাস্তা কাঁচা, দূর্গম। এরওপর একবার আটকে পড়লে ফিরে আসা দুষ্কর। তাই সেভেন স্টার জলপ্রপাতের কাছে ‘বাংলাদেশ ভিউপয়েন্ট’ নামের একটা জায়গায় নিয়ে বায়োস্কোপওলার মতো ‘ওই যে বাংলাদেশ’ বলে গাড়িচালকরা পর্যটকদের দিয়ে থাকে। আমাদের সঙ্গে খাসি হোস্টগণ, আমাদের ফাঁকি দেয়ার জো ড্রাইভারের নেই।

যাওয়ার পথে আর কোন গাড়ি দেখি না। ইতোমধ্যে বেলা গড়িয়ে বিকালের দিকে মোড় নেয়াও আরেকটি কারণ হতে পারে। একপাশে পাহাড়, আরেকপাশে ঘনবন মাঝে  মধ্যে পাতলা। চলার পথে মুহূর্তে চোখে ধরা দেয় অদূরের সমতলভূমি। পানিতে ভাসমান সবুজ থোকা থোকা গ্রাম। গুগলে দেখি, সেটা বাংলাদেশের কোম্পানিগঞ্জ।

ভ্রমণসঙ্গী কবি কামরুল হাসান বললেন, প্রাকৃতিক  সম্পদওলা পাহাড়ের সবগুলোই প্রতিবেশীদের, আমাদের শুধুই সমতল?

বললাম, জানে র‍্যাডক্লিফ সাহেব।

বললেন, সাহেব তো আর নিজহাতে মাপজোঁক করেননি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর