জন্ম থেকে সংঘাতের চারণভূমি

বিবিধ, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 14:22:14

পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে জন্মের পর থেকেই সামরিক শাসন ও জাতিগত শোষণ-সংঘাতের উত্তপ্ত চারণভূমি। দেশটি এখন ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তাক্ত জনপদে রূপ নেওয়ায় বিক্ষত জনগণ, বিপন্ন পুরো দেশ।

আন্তঃমুসলিম সংঘাতের ধারায় শিয়া-সুন্নি সংঘর্ষ ও হামলা-পাল্টা-হামলা নিত্য চলছে সে দেশে। যে সংঘাতের রক্তাক্ত বহিঃপ্রকাশ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ জীবনে দগদগে ক্ষতের মতো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। যে ক্ষত দেশের নিরাপত্তা ও আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে তলানিতে নিয়ে এসেছে।

কাগজে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হলেও বাস্তব পরিস্থিতি পাকিস্তানকে পরিণত করেছে শিয়া-সুন্নি মতাবলম্বী মুসলিম জনগোষ্ঠীর চলমান সংঘাতের বিপন্ন জনপদে। বর্তমানে পাকিস্তান হলো সংঘাত কবলিত অনিরাপদ দেশের মধ্যে বিশ্বতালিকার শীর্ষে।

পাকিস্তানের স্বাধীনতার মাত্র ছয় বছর পর ১৯৫৩ সালে প্রথমবারের মতো সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল রাজনৈতিক নয়, ধর্মীয় কারণে। তারপর সমাজে ধর্মীয় সংঘাতের পেছন পেছন রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রবল সামরিক শাসন ক্রমেই পাকিস্তানের রাজনীতির গণতান্ত্রিক সম্ভাবনাকে নস্যাৎ ও গ্রাস করে।

ফলে জন্ম থেকেই ধর্মীয় সংঘাত পাকিস্তানের গণতন্ত্র ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় হুমকি বলে বিবেচিত হচ্ছে, যে হুমকি দেশটির গণতান্ত্রিক গতিকেও সামরিক আঘাতের মাধ্যমে রুদ্ধ করেছে এবং সামাজিক জীবনকে নিরাপত্তাহীন করে চরম অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

যদিও পাকিস্তানের ৯৫% ভাগ মানুষই মুসলমান (যাদের মোট সংখ্যা ২০৭৮ মিলিয়ন), তথাপি শান্তি ও সৌহার্দ্য দেশটিতে অনুপস্থিত। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠী একে অন্যের সঙ্গে লড়ছে। মুসলমান জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ সুন্নি মতাবলম্বী হলেও পাকিস্তানে শিয়া মতাবলম্বী মুসলমানদের শতকরা হিসাবটি কখনোই স্পষ্ট নয়।

সরকারি তথ্য ও অন্যান্য পরিসংখ্যানে পাকিস্তানে শিয়াদের শতকরা হার কখনো ১০%, আবার কখনো ২৫% ভাগ বলে উল্লেখ করা হয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো এই যে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তর শিয়া জনগোষ্ঠীর বসবাস পাকিস্তানে। বিশ্বের মানচিত্রে ইরানের পর পাকিস্তানেই সবচেয়ে বেশি শিয়ার বসবাস করে বলে পরিসংখ্যানের হিসাব থেকে জানা যাচ্ছে। পাকিস্তানি শিয়াদের বড় অংশটি ‘ইসনে আশারি’ বা ‘বারো ইমামপন্থী’। এছাড়াও পাকিস্তানে নেযারি ইসমাঈলি, হাজারা, দাউদি বোহরা, সোলেইমানি বোহরা, আলাভি প্রভৃতি উপ-সম্প্রদায়ের শিয়া মতাবলম্বী রয়েছে।

পাকিস্তানে বসবাসকারী সবগুলো জাতিগত, ভাষাগত, উপজাতিগত জনগোষ্ঠীতেই শিয়া সম্প্রদায়ের লোক দেখতে পাওয়া যায়। তার মানে হলো, বিষয়টি এমন নয় যে, বিশেষ বিশেষ জাতি বা ভাষা বা অঞ্চলগত গোষ্ঠীতে শিয়ারা সীমাবদ্ধ রয়েছে। বরং পাকিস্তানের সকল জাতি ও গোষ্ঠীতেই কম-বেশি হলেও শিয়া মতের বিশ্বাসী মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। শিয়ারা পাকিস্তানের জাতির পিতা বা ‘কায়েদে আজম’ নামে খ্যাত মোহাম্মদ আলী জিন্নাকে তাদের শিয়া সম্প্রদায়ের একজন বিশিষ্ট সদস্য হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করে।

পাকিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিকে সংখ্যালঘিষ্ট হয়েও উল্লেখযোগ্য ও ক্ষমতাবান শিয়া সদস্যের কমতি নেই। মূলত সংখ্যালঘু হলেও পাকিস্তানের শিয়ারা মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিদের সঙ্গে ক্ষমতা ও স্বার্থগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার সক্ষমতা রাখে। কিছু কিছু সেক্টরে শিয়ারা বরং সুন্নিদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।

শিয়ারা পাকিস্তানের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও দেশটির চারটি প্রদেশের কোথাও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। তবে পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত সায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল গিলগিট বেল্টিস্তানে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এলাকাটি বেলুচিস্তান প্রদেশ সংলগ্ন ও ইরানের সীমানা ঘেঁষা। ইরানের সংখ্যাগুরু শিয়া নাগরিকদের সামাজিক যোগাযোগের প্রভাব এ অঞ্চলে রয়েছে।

উল্লেখযোগ্য শিয়া বসতি রয়েছে খাইবার পাখতুন খাওয়া অঞ্চলের পেশোয়ার, কোহাট, হাঙ্গু, দারা ইসমাঈলি খান শহরে। আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী এ অঞ্চলটির আগের নাম ছিল উত্তর-পূর্ব সীমান্ত প্রদেশ। ফেডারেল শাসিত উপজাতি এলাকা খুররম ও ওরাকজাঈ এজেন্সিতেও শিয়ারা উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যায় বসবাস করে।

তাছাড়া বেলুচিস্তান প্রদেশের কোয়েটা ও মাকরান সমুদ্রতটে শিয়া বসতি রয়েছে। পাঞ্জাবের কেন্দ্র ও দক্ষিণাঞ্চল শিয়া অধ্যুষিত। সিন্ধু প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শিয়াদের উপস্থিতি রয়েছে। বিশেষত সিন্ধুর হায়দ্রাবাদ শহরে ভারতের গুজরাত থেকে দেশভাগের সময় অভিবাসী মেমন ও দাউদি বোহরা সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিয়া মতের মানুষ দেখতে পাওয়া যায়।

পাকিস্তানের অধিকাংশ বড় শহর, যেমন করাচি, লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি, ইসলামাবাদ, পেশোয়ার, মুলতান, জঙ্গ ও সারগোদায় পুরনো ও প্রতিষ্ঠিত শিয়া বসতি রয়েছে। শিয়ারা একটু আলাদা ও নিজস্ব কাঠামোর মধ্যে বসবাস করলেও সাধারণ সামাজিক জীবনে সুন্নিদের সঙ্গে দৃশ্যমান কোনও বৈপরীত্যের মুখোমুখি হতে চায় না। তারপরেও শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মুসলমানদের মধ্যে পৃথক মতাদর্শ ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব আড়াল করা সম্ভব হয় না।

পোশাক, পরিচ্ছদ, ধর্মীয় আচার-আচরণ এবং বিশ্বাসগত দিক থেকে শিয়া-সুন্নি প্রভেদ লক্ষ্যণীয়। শিয়াদের প্রিয় রং কালো, যাতে কারবালার ময়দানে ঈমামের শোকের প্রতিফলন ঘটেছে। সুন্নিরা পছন্দ করে সবুজ রং। শিয়া ও সুন্নিদের আলাদা মসজিদ আছে, সেখানে তারা নিজ নিজ পদ্ধতিতে ধর্ম পালন করেন।

শিয়াদের সমজিদ সংলগ্ন ইমামবাড়া একটি আলাদা স্থান যেখানে শিয়ারা মিলিত ও আলাপ-আলোচনায় লিপ্ত হয়। সুন্নিদের প্রার্থনাস্থলে এমন কোনও স্থানের অস্তিত্ত্ব নেই। শিয়ারা কারবালার হত্যাকাণ্ডের শোকাবহ স্মৃতিতে পুরো মহররম মাসেই তাজিয়া, মার্সিয়া ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে শোক পালন করে, যা সুন্নিরা পালন করে না।

এ সম্পর্কিত আরও খবর