সুতানুটি গ্রাম থেকে রাজধানী হলো কলকাতা

বিবিধ, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 16:15:09

ধীরে ধীরে বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রচুর মুনাফা ও জাঁকিয়ে বসার খবর খোদ ইংল্যান্ডে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করে। কোম্পানির হেড অফিসেও বাংলার সাফল্য গোপন থাকেনি। আরও সম্ভাবনার দ্বার যে বাংলায় খুলছে, তা বুঝতে ভুল করেনি বাণিজ্যপ্রিয় ইংরেজরা।

ফলে উৎসাহিত ইংরেজ ব্যবসায়ীদের একটি দল ১৬৯৮ সালে ইংল্যান্ডে আরেকটি নতুন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করে। এর নাম রাখা হয় ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পুরনো কোম্পানিটির নাম হয় লন্ডন কোম্পানি। নতুন কোম্পানির কর্তারা ইংল্যান্ডের রাজকীয় সনদ নিয়ে বাংলায় বাণিজ্য করতে আসেন এবং দিল্লির দরবারে একজন দূত পাঠিয়ে এ অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে সচেষ্ট হন। নতুন কোম্পানি বাণিজ্য-স্বত্ব লাভের জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালাতে লাগলেন। ফলে নতুন ও পুরনো, উভয় কোম্পানির মধ্যে প্রচণ্ড বিরোধ দেখা দেয়।

তৎকালীন নবাব আজিমুশ্বান কোম্পানিদ্বয়ের প্রতিযোগিতার কারণ ও উদ্দেশ্য অনুধাবনে ব্যর্থ হন। তিনি উভয় কোম্পানির কাছ থেকেই টাকা নেন বাণিজ্য সুবিধা দেওয়ার জন্য। পুরনো কোম্পানি তখন ১৬ হাজার টাকা এবং নতুন কোম্পানি ১৪ হাজার টাকা প্রদান করে।

এই পরিস্থিতিতে বিচক্ষণ ইংরেজগণ দেখলেন যে, দুইটি কোম্পানির কারণে উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং বাংলার নবাব দুই কোম্পানির কাছ থেকেই টাকা উসুল করছেন। তখন ১৭০২ সালে দুটি কোম্পানির কর্তারা একত্রে বসে নিজেরা সংযুক্ত হয়ে একটি কোম্পানি গঠনের সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৭০৪ সালে এটি কার্যকর হওয়ায় একটি কোম্পানি একচ্ছত্রভাবে বাংলায় তৎপরতা চালাতে থাকে। যার পরিণতিতে ঐক্যবদ্ধ ইংরেজরা প্রবলভাবে শক্তিশালী হয় এবং শেষ পর্যন্ত পলাশীর চক্রান্তের মাধ্যমে বাংলা গ্রাসের করুণ ঘটনাটিও সফল করতে পারে।

আদিতে মাত্র ৩০ জন সৈন্য নিয়ে বার্ষিক তিন হাজার টাকা খাজনায় দূরদর্শী ইংরেজরা বাংলার মাটিতে পা রাখার শক্ত জায়গা তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছিল কলকাতাকে কেন্দ্র করে। কালক্রমে সেটাই বিশাল আকার ধারণ করে কলকাতা হয় তাদের বাংলা ও ভারত দখলের ভিত্তিমূল। জব চার্নক পরিকল্পিত কলকাতা পরিণত হয় দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের কেন্দ্রবিন্দু।

কলকাতার কর্মকর্তাদের তদবির ও তৎপরতায় ১৬৯০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্য সনদ পায়। তারপর একে একে বাড়তে থাকে বাণিজ্য কুঠি। ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজ কলকাতা দখল করলেও তা ধরে রাখতে পারেননি; পরের বছরই ইংরেজ কোম্পানি ফের দখল নেয় শহরের। তারপর আস্তে আস্তে বাংলায় প্রতিপত্তি বাড়িয়ে পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক বিজয়ের পর ১৭৯৩ সালে কোম্পানি বাংলার যাবতীয় নিজামত বা স্বায়ত্তশাসনের অবলুপ্তি ঘটিয়ে কায়েম করে তাদের মৌরসি পাট্টা। কোম্পানি শাসন ও ব্রিটিশ রাজশক্তির প্রত্যক্ষ শাসনের প্রথমার্ধে কলকাতা ছিল একই সঙ্গে বাংলা ও ভারতের রাজধানী।

কলকাতায় আশ্রয় নিয়ে ইংরেজরা শুধু বাংলা বা ভারত রাজনৈতিকভাবে দখল ও শাসন-শোষণই করেনি, সমাজ-অর্থনীতি-শিক্ষা-ধর্ম-দর্শন ইত্যাদি জীবনের সকল ক্ষেত্রেই প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। বাংলার সব কিছু লুটে নিয়ে চরম দুর্ভিক্ষ দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, ঔপনিবেশিক দখলদার-শক্তি, জনতাকে বুভুক্ষ রেখে সাহেবি ও মোসাহেবি সমাজে ভোজসভায় পরস্পরকে লক্ষ্য করে রুটির টুকরো ছুড়ে মারার খেলা খেলে।

ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকতায়-সৃষ্ট নব্য-ধনী শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাড়িতে মদের চৌবাচ্চায় পদ্মফুল ভাসিয়ে সকলে মিলে মুখে করে পাইপে টেনে মদ্যপানের আমোদ-আহ্লাদে লিপ্ত হন। চরম নির্মমতায় গ্রাম-গঞ্জ থেকে ধরে আনা প্রতিবাদী মানুষদের বেঁধে ওড়ানো হয় তোপের মুখে। কাঠের তক্তায় গর্ত করে আটক প্রজার পা দু'টি ঢুকিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বীভৎস নির্যাতন চালায়। পরবর্তী প্রায় ২০০ বছর ধরে সাধারণ মানুষের ওপরে চলতে থাকে এহেন ঔপনিবেশিক নিপীড়ন।

বাংলা তথা ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের নির্মমতার সাক্ষী হয়ে বিকশিত হতে থাকে সুতানুটি গ্রাম থেকে রাজধানী কলকাতা।

আরও পড়ুন: ১৬৯৯ সালে প্রেসিডেন্সি হয় কলকাতা

আরও পড়ুন: জব চার্নকের কলকাতা

আরও পড়ুন: চট্টগ্রামের বদলে ইংরেজদের কাছে গুরুত্ব পায় কলকাতা

এ সম্পর্কিত আরও খবর