'মায়ের গান গাইলে কষ্টে চোখে পানি আইয়া পড়ে'

বিবিধ, ফিচার

রাকিবুল ইসলাম রাকিব, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ), বার্তা২৪.কম | 2023-08-27 16:07:14

জরাজীর্ণ একটা পুকুরঘাট। সেখানে বসে মিষ্টি কণ্ঠে এক ক্ষুদে শিল্পী গান গাইছে। গানের টানে বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়। মুহূর্তেই জমে উঠে আসর। আসর জমে উঠতেই ক্ষুদে শিল্পী একের পর এক গান গেয়েই যাচ্ছে। মুগ্ধ দর্শক সারি থেকে বেজে উঠে হাততালি। গানের ফাঁকে ফাঁকে ক্ষুদে শিল্পীটি সাহায্যের আকুতি জানায় দর্শক সারিতে। সেই আকুতিতে সাড়া দিয়ে দর্শকরাও ৫ টাকা কিংবা ১০ টাকার নোট দিয়ে তাকে সাহায্য করছে।

বুধবার (১৮ এপ্রিল) বিকালে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলা পরিষদের সামনের পুকুরঘাটে এই দৃশ্য ধরা পড়ে।

গান শেষে কথা বলে জানা যায় ছেলেটির নাম আব্দুর রহমান (১১)। বাবা- শাহ আলম পেশায় রাজমিস্ত্রি। মা- মৃত হুসনে আরা। বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজভাগ গ্রামে। সে ওই গ্রামের একটি বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। অভাব-অনটনের সংসারে জীবিকার তাগিদে সে পথে পথে গান গেয়ে টাকা উপার্জন করে।

আব্দুর রহমান বলে, ‘আমি কোনো ওস্তাদের কাছে গান শিহি (শিখি) নাই। টেলিভিশন ও মোবাইলে গান হুইন্যা (শুনে) গান শিইখ্যা (শিখে) ফেলছি। গান গাইলে আমার কোনো বাদ্য-যন্ত্র লাগেনা। রাস্তা-ঘাটে যেকোন হানে (জায়গায়) বইয়া (বসে) আমি খালি গলাতেই গান গাইবার পারি। আব্বায় যহন অসুখে বিছনায় পইরা যায় তহন আমি রাস্তায় ঘুইরা গান গাই। মাইনষ্যে (মানুষ) গান শুইন্যা আমারে টেকা-পয়সা দেয়। হেইডা আমি সংসারে দিয়া দেই। মাঝে নিজের জামা-কাপড়ও কিনি।’

গৌরীপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাটবাজারে বাউল ও ফোক ঘরানার বিভিন্ন গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন আব্দুর রহমান। গান শুনে শ্রোতারা খুশি হয়ে যা দেয় তা থেকে দিন শেষে তার আয় ৪ থেকে ৫শ টাকা। এছাড়াও স্থানীয় ছোট-খাটো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গেয়ে কিছু টাকা উপার্জন করে সে।

কথা প্রসঙ্গে জানা যায়, ছোট বেলায় আব্দুর রহমানে মা মারা যায়। এরপর সে সৎ মায়ের সংসারে মানুষ হয়েছেন। একদিন রাস্তায় তার গান শোনে স্থানীয় এক শিক্ষক তাকে ঈশ্বরগঞ্জের সাদরগোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। বর্তমানে সে ওই বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তবে জীবিকার তাগিদে রহমান বিদ্যালয়ে ততটা নিয়মিত হতে পারেনি।

জীবিকার তাগিদে প্রায়ই বিদ্যালয় ফাঁকি দিয়ে রাস্তায় বের হয়ে পড়ে গান গাওয়ার জন্য।

আব্দুর রহমান বলে, ‘আমি গরিবের ছেলে। পড়ালেহার (পড়ালেখা) করনের সামর্থ্য নাই। তয় গান গাইয়া বড় শিল্পী হইতে চাই। আর ডেলি (প্রতিদিন) ইশকুলে (স্কুল) গেলে আমার কামাই (আয়) বন্ধ হইয়া যাইবো। কামাই বন্ধ হইলে খামু কি। আইজকা (আজ) আমি বাজার লইয়া (নিয়ে) গেলে আম্মায় রান্ধা-বাড়া (রান্না) করব। কিন্তু অহনো গান গাইয়া বাজারের টেকাটা কামাই করতে পারি নাই।’

কথা বলতে বলতেই আব্দুর রহমান ঘাটে বসে ‘মধু হই হই বিষ খাওয়াইলা’ গানটিতে টান দেয়। গান শুনে মুহূর্তেই ঘাটে ভিড় জমে দর্শকদের। ফের জমে উঠে গানের আসর। গানের তালে তালে নেচে-গেয়ে রহমান বিমোহিত করে চলেছে দর্শকদের। হঠাৎ দর্শক সারি থেকে এক ব্যক্তি মাকে নিয়ে একটি গান গাওয়ার অনুরোধ করেন তাকে। জবাবে রহমান বলে, ‘আমার মা মইরা গেছে, মায়ের গান গাইলে কষ্টে চোখ দিয়া পানি আইয়া পড়ে। এই বলেই ‘একটু দাঁড়াও মায়েরে দেখি গো গ্রামবাসী’ গানটি গাওয়া শুরু করে রহমান। গান গাইতে গাইতেই তার চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে। সৃষ্টি হয় আবেগঘন এক পরিবেশ। নীরব দর্শক সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকেই তখন নিজের চোখের জল মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

গান শেষে এক দর্শকসারি থেকে সংগ্রহ করা টাকাগুলো রহমানের হাতে তুলে দেয় এক ব্যক্তি। চোখ মুছতে মুছতে রহমান বলে কত টাকা হইছে মামা? জবাবে ওই ব্যক্তিটি বলে ৬৪৫ টাকা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর