আলোর ফেরিওয়ালা পলান সরকার

বিবিধ, ফিচার

এস এস আল আরেফিন, বার্তা২৪ | 2023-09-01 08:14:01

হারেজ উদ্দিন সরকার, নামটা আমাদের অনেকের কাছেই অজানা। তবে হারেজ উদ্দিন সরকার নামে না চিনলেও তাকে সবাই চেনেন ঝোলা কাঁধের বই দাদু, পলান সরকার হিসেবে। মা আদর করে ডাকতেন পলান নামে, সেখান থেকেই সবার কাছে পরিচিত হন তিনি পলান সরকার নামে। 

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা ইউনিয়নের বাউশা পূর্বপাড়া গ্রামের পলান সরকার দীর্ঘ ৩০ বছরের বেশী সময় ধরে বিলিয়েছেন শিক্ষার আলো। গ্রন্থমেলার মাস ফুরোতে না ফুরোতেই আজ (১ মার্চ) নিজ ঘরেই নিভেছে এই আলোর ফেরিওয়ালার জীবন প্রদীপ।

২০০৭ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর ক্রোড়পত্রে ‘বিনি পয়সায় বই বিলাই’ শিরোনামের মাধ্যমে প্রথম জনসম্মুখে আসেন পলান সরকার। হেঁটে হেঁটে মানুষকে বই দিয়ে বেড়ানো সেই মানুষটির কথা জানতে পারে সবাই।

১৯২১ সালে জন্ম নেওয়া হারেজ, জন্মের পাঁচ মাসের মাথায় বাবা কে হারিয়েছেন। আর্থিক অনাটনে ষষ্ঠ শ্রেণিতেই থমকে যায় তার পড়াশুনা। কিন্তু নিজের একাগ্র চেষ্টায় পড়ালেখা চালিয়ে যান বই পাগল মানুষটি।

স্থানীয় এক উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদে থাকাকালীন সময়ে প্রতিবছর সব ক্লাসের প্রথম দশজনকে উপহার দিতেন বই। সেই থেকে তার বই বিলানোর কাজ শুরু। এরপর থেকে তা চলতে থাকে তার মৃত্যু পর্যন্ত।

ডাক্তারি পরীক্ষায় ডায়বেটিস ধরা পড়ার পর থেকে মাইলের পর মেইল হেঁটে বই বিলানোর কাজ করতেন এই ফেরিওয়ালা। কারো একটি বই পড়া শেষ হলে সেই বই নিয়ে অন্য একটি আরেকটি বই দিয়ে আসতেন। সম্পূর্ণ নিজের টাকায় কেনা বই গুলোই তিনি এভাবে বিতরণ করতেন ছাত্র থেকে বৃদ্ধ সবার মাঝে।

মানুষকে বিনামূল্যে বই পড়াতে গিয়ে তিনি যেনো আশপাশের ২০ টি গ্রামে গড়ে তোলেন অভিনব এক আন্দোলন। বই পড়ার আন্দোলন। একেকদিন একেক গ্রামে গিয়ে তিনি মানুষকে বই দিয়ে আসতেন। মানুষের ঘুম ভাঙার আগেই যেনো তাদের বাড়ির উঠোনে এসে হাজির হতেন মানুষটি।

বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মানুষটি প্রতিদিন গ্রাম গুলোতে যেতে না পাড়ায় গ্রামে গ্রামে বই পাগল মানুষ গুলোকে নিয়ে গড়েন কেন্দ্র। এই বই পাগল মানুষ গুলোর বাড়িতে বা দোকানে রাখেন বই। মাঝে মাঝে সেসব কেন্দ্রে যেতেন ছেলের মটর সাইকেলে চেপে। পুরাতন বই গুলো নিয়ে দিয়ে আসতেন নতুন বই।

এই বই পড়ার আন্দোলনের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালে পলান সরকারকে প্রদান করেন অন্যতম রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘একুশে পদক’।

পলান সরকারের নিজ বাড়িতে সরকারিভাবে গড়ে তোলা হয় পলান সরকার পাঠাগার। ব্যবস্থা করা হয় সৌর বিদ্যুতের। যেখানে রাত দিন সব সময় মানুষ আসত শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে।

পলান সরকারের বয়স বিবেচনা করে তার সুবিধার জন্য একটি ভ্যান বানিয়ে দেওয়া হলেও তিনি সেই ভ্যান ব্যবহার করতেন না। পায়ে হেঁটে বই বিলি করাই যেনো তার নেশা।

প্যারিস ভিত্তিক সংগঠন স্পার্ক নিউজ প্রতিবছর ২০ সেপ্টেম্বর পালন করে ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে আর ২০১৪ সালের এই দিনে সারা বিশ্বের ৪০টি দেশে একযোগে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয় প্রথম আলোয় প্রকাশিত ফিচার এবং পলান সরকারের বই বিলি করার ছবি।

রাজশাহীর সেই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বিশ্ব গণমাধ্যমে এসেছেন পলান সরকার। না আসলেও বা কি হত? পলান সরকার তো কাজ করে গেছেন এই দেশের মানুষের জন্য, তাদের অন্তরে বইয়ের জন্য ভালোবাসা তৈরি করতে। করেও গেছেন সেই কাজ নিজের সবটুকু দিয়ে।

গত বছরের ২১ ডিসেম্বর প্রিয়তমা স্ত্রীর চিরবিদায় হয়তো মেনে নিতে পারেননি প্রায় শতবর্ষী পলান সরকার। তাইতো, ১৬ কোটি মানুষের আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে নিরবেই চলে গেলেন ওপারে।

শনিবার (২মার্চ) নিজ গ্রামেই চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন এই সাদামনের মানুষ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর