একজন ডা. শেখ মহিউদ্দিন

বিবিধ, ফিচার

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 21:00:03

অনেক শিল্পপতির আগমনে সেই অফিস-কারখানার কর্মচারীদের চলাচল সীমিত করা হয়। কেউ কেউ আছেন প্রটোকল পেতে ভালোবাসেন। তারা যতক্ষণ যে কম্পাউন্ডে অবস্থান করবেন এমনকি যে করিডোরে হাঁটা-চলা করবেন সে সব এলাকায় সেই অফিসের স্টাফদের চলাচলও সীমিত করার নজির অহরহ।

মালিক যখন হাজির হবেন, তাকে রিসিভ করার জন্য মূল ফটকে প্রথম সারির কর্তারা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকবেন। অনেকেই মালিকের উপস্থিতিতে হাত ঘষতে ঘষতে তালুর চামড়া তুলে ফেলেন। এটা এখন অনেকটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। একই দৃশ্য চোখে পড়বে মন্ত্রী কিংবা সরকারি বড় কর্তার পরিদর্শনেও।

কিন্তু আদ্-দ্বীন ব্যারিস্টার রফিক উল হক হাসপাতালে যা দেখলাম তা যেনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করার মতো নয়। হাসপাতালটির পরিচালকের সঙ্গে কথা বলছিলাম, পরিচালক কথার এক ফাঁকে বললেন, ‘আমি যে বেশি সময় দিতে পারছি না আমাদের নির্বাহী পরিচালক স্যার এসেছেন।’

কথা শেষে তার সঙ্গে বের হলে সামনের করিডোরে দেখা মেলে নির্বাহী পরিচালক বিশিষ্ট শিল্পপতি ডা. শেখ মহিউদ্দিনের। যার হাতেই শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে দেশের আলোচিত আটটি হাসপাতাল, চারটি মেডিকেল কলেজ, আকিজ বেকারি, আকিজ বিড়ি, আকিজ মাদার কেয়ার, আকিজ ফার্মাসিউটিক্যাল ও আকিজ কলেজিয়েট স্কুলসহ অনেক খ্যতনামা প্রতিষ্ঠান।

কিন্তু কী অসাধারণ, তাকে যেনো কেউ গায়ে মাখছেন না। যে যার কাজে নিমগ্ন। এমনকি যে ক্লিনারটি করিডোর মোছার কাজে ব্যস্ত ছিলেন, তিনিও তার কাজ চালিয়ে গেলেন আপন মনে। অনেক সময় দেখানোর জন্য যত্নসহকারে কাজ করে থাকেন অনেকে। এখানে কিন্তু তেমনটা লক্ষণীয় নয়। ভাবটা এমন যেনো তিনি মালিককে চিনতেই পারলেন না। একেবারেই স্বাভাবিকভাবে কাজ চালিয়ে যেতে থাকলেন। আর ১০টা রোগিকে যেভাবে এড়িয়ে চলেন।

এখানে বলে রাখা আবশ্যক, আদ্-দ্বীনের হাসপাতালগুলোতে খালি পায়ে হাঁটার ব্যবস্থা রয়েছে। সার্বক্ষণিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। এ জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। একদল কর্মী রয়েছে যারা মব হাতে সার্বাক্ষণিক চক্কর দিতে থাকেন। এখানেও কর্মীটি আপনমনে কাজ চালিয়ে গেলেন।

ঘুরে ঘুরে কয়েকটি বিভাগে গেলেন, কিন্তু রোগিদের বুঝবার কোনো জোঁ নেই হাসপাতালটির খোদ মালিক এসেছেন দেখতে। তার এই আগমনের হেতু হচ্ছে নাক-কান-গলা রোগিদের ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্প উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া।

মিনিট বিশেক পরে শুরু হলো সেই অনুষ্ঠান। সেখানে নিজে গিয়ে বসলেন দর্শক সারিতে। আর তারই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কর্তাদের বসিয়ে দিলেন মঞ্চে ভিআইপি আসনে। আলোচনায় অংশ নিলেন দর্শক সারি থেকেই উঠে গিয়েই। কোরআন তেলাওয়াত করলেন অনুষ্ঠানের শুরুতে, তাফসীর ও শানে নযুলসহ।

অতিথি বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যরিস্টার রফিক উল হকের হুইল চেয়ারটি নিজে ঠেলে নিয়ে গেলেন ফিতা কাঁটার জন্য। এখনকার দিনে বিষয়টি অনেকটা অবাক করার মতো। অন্তত তার মতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেওয়াদের কাছে তো নয়ই। তিনি যেন একবারে অন্য ধাঁচের। না আছে নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি, না আছে প্রটোকলের বাহুল্যতা।

আর অবাক হতে হলো আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশনের ডিজিএম (প্রশাসন) তারিকুল ইসলাম মুকুলের সঙ্গে আলাপ করে। তিনি বললেন, ‘স্যার এমনই। সাধারণত কখনই মঞ্চে বসেন না। ওনি এখনও অনেক সময়ে নিজে হাতে হাসপাতাল পরিচ্ছন্ন করার মেশিন চালান। মেঝেতে টিস্যু কিংবা কাগজ পড়ে থাকতে দেখলে নিজে কুঁড়িয়ে ফেলে দেন।’

শেখ মহিউদ্দিনের সহধর্মিনী ডা. মাহফুজা জেসমিন যেন আরও একধাপ এগিয়ে। বলা চলে সৃষ্টিকর্তার অপার জুটি। হাসপাতালটির উপ-পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। তারও কোনো আড়ম্বর নেই। নেই পোশাকের বাহারি প্রদর্শন। তিনিও দর্শক সারিতে বসেই অনুষ্ঠান উপভোগ করলেন। তিনি যে মালিকের সহধর্মিনী তার চাল চলনে বুঝবার কোনো উপায় নেই। আমারও বুঝতে সময় লেগেছে অনেকটা।

অনুষ্ঠানের আগে শেখ মহিউদ্দিনের চেম্বারে বসে কথা হয়। সেখানেও নেই কোনো বাহারি জৌলুস। যেন একজন নিরীহ সাধারণ ডাক্তার। আর দশটা ডাক্তার আর তার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তিনিও তাদেরই একজন। কর্মীদের অবাধ যাতায়াত তার কক্ষে।

স্লোগান হচ্ছে সাশ্রয়ী মুল্যে উন্নত চিকিৎসা। আর সার কথা হচ্ছে টাকার জন্য যেন কেউ বিনা চিকিৎসায় না মারা যান। অর্থাৎ দরিদ্র রোগীদের জন্য সব সময়েই রয়েছে বিশেষ সুযোগ। দেশের একমাত্র বেসরকারি হাসতাপাল, যারা সবচেয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আদ্-দ্বীন হাসপাতাল। ২০০৩ সাল থেকে এ যাবত ৭০ হাজার রোগীর ফ্রি চোখের ছানি অপারেশন করেছে। খুলনা, যশোর অঞ্চলে গর্ভবতী মহিলাদের ফ্রি চিকিৎসা ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সিজার যখন ট্রেডিশন হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন আদ্-দ্বীন হাসপাতাল নরমাল ডেলিভারির রেকর্ড গড়েছে। সিজারে আগ্রহীদের কনসালটেশনের মাধ্যমে নরমাল ডেলিভারি করানো হচ্ছে।

ঢাকা সিটিতে মাত্র ৩৫০ টাকায় অ্যাম্বুলেন্স সেবা। নিরক্ষর হতদরিদ্রদের হাতের লেখা শিখিয়ে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দিয়ে নতুন নজির গড়েছেন আদ্-দ্বীন হাসপাতাল। সারা বছরেই থাকে নানা রকম ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা।

পেশাগত কারণে বাংলাদেশ ও দেশের সীমানার বাইরেও বড় বড় শিল্পপতিদের খুব কাছ থেকে দেখার জানার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু আকিজ পরিবারের এই সদস্য যেনো পুরোপুরি অন্য মাপের। অর্থ, প্রতিপত্তি, তার পায়ে লুটোপুটি খেলেও তাকে ছুঁতে পারেনি। উচ্চ শিক্ষা তাকে বিনয়ী আরও মানবিক আরও সাধারণ ও অনন্য করে তুলেছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর