সাকরাইনে মাতল পুরান ঢাকা: বর্ণিল ঘুড়ি উড়িয়ে দিলো সম্প্রীতির বার্তা

, ফিচার

আহসান জোবায়ের, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট বার্তা২৪.কম ঢাকা | 2024-01-15 11:52:25

মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ছেয়ে গেছে রঙবেরঙের ঘুড়িতে। হরেক রকম রঙিন আর নানান ডিজাইনের ছোট বড় আকৃতির ঘুড়ি। ঘুড়িগুলো ঘুরে ঘুরে পুরান ঢাকার আকাশকে রঙিন করে তুলছে। কোনো ঘুড়ি মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে আবার কোনটা আকাশে রাজত্ব করছে। কোনো ঘুড়ি দিগন্ত ছাড়িয়ে যায় অন্য দিগন্তে।


কোনো ঘুড়ি নাটাই ছেড়ে উড়ে যায় আকাশের নীল সীমানায়। পৌষ মাসকে বিদায় দিতে পুরান ঢাকাবাসীর আয়োজন সাকরাইন উৎসব, যা ঘুড়ি উৎসব নামেও পরিচিত।


আকাশ কুয়াশাচ্ছন্ন থাকলেও রোববার ভোরে সূর্য উঠার আগে থেকে নাটাইয়ে সুতো বেধে ঘুড়ি আকাশে উড়িয়ে দেয় পুরান ঢাকাইয়ারা। বেলা গড়ানোর পর পিঠাপুলির বানানো শেষে এই উৎসবে যোগ দেন বাড়ির গৃহিণীরাও। ঘুড়িকে আকাশ ছোঁয়ানোর চেষ্টা সবার। তবে ক্ষণে ক্ষণে একে অপরের কাটাকাটিতে যোগ হয়েছে মান-অভিমান। ‘বাকাট্টা… বাকাট্টা ধর ধর’ বলে ভেসে আসে চিৎকারও।


দিনের আলো শেষে যেমন অন্ধকার নামে তেমনি ঘুড়ি নাটাইয়ের কাছে এসে পৌঁছায় সন্ধ্যার লাল আলো জ্বলে উঠলে। শুরু হয় রাতের কসরত; সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় আঁতশবাজি, ফানুস উড়ানো, আগুন নিয়ে খেলা, বড় বড় গ্যাস বেলুন উড়ানো, হরেক রকমের লাইটিং যা অন্ধকার আকাশকে বিভিন্ন আলোয় অলোকিত করে। আর ডিজের তালে তালে চলতে থাকে তরুণ-তরুণীদের উদ্যম নাচ। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে উৎসবের মহাযজ্ঞ। ছাদে ছাদে দেখা যায় পুরান ঢাকাবাসীর উচ্ছ্বাস।


পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, মিলব্যারাক, সদরঘাট, নবাবপুর, লালবাগ, চকবাজার, দয়াগঞ্জ , মুরগিটোলা, ধুপখোলা মাঠ, বংশাল, ওয়ারী, ইসলামপুর, শাঁখারিবাজার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, তাঁতিবাজার, রায়সাহেব বাজার এলাকার মানুষ ঘটা করে সাকরাইন পালন করে।


এদিন বিকালে ধুপখোলা মাঠে বাবা-মায়ের সাথে সাকরাইন উৎসবে আসেন নাজিফা নুসরাত। চার বছরের নাজিফা হাতে ঘুড়ি আর নাটাই পেয়ে যারপরনাই খুশি। হাতে ঘুড়ির সুতো ঝুলিয়ে মাঠের এপাশ-ওপাশ দৌঁড়ে তার খুশির সীমা নাই। পরিবারের সদস্যদের সাথে সেলফি তুলে শেষ হয় তাদের বিকালের উৎসব।

ধুপখোলায় সাকরাইনের উৎসবে যোগ দেন বিভিন্ন বয়সী মানুষেরা। ষাটোর্ধ্ব নজরুল ইসলাম নাটাই হাতে, ঘুড়ি হাতে সাথে তার বন্ধু মনোয়ার হোসেন। গানের তালে নাচানাচি আর বিশেষ কায়দায় ঘুড়ি উড়ানো; দুই বন্ধুর এমন উদ্দীপনা নজর কেড়েছে উপস্থিত সবার।


সন্ধ্যার পর রাজধানীর মুরগিটোলা মোড়ে জামান ভিলার ছাদে জমে উঠে ডিজে গানের উৎসব। উঠতি বয়সী তরুণ তরূণীদের সাথে শিশুদের উপস্থিতিও ছিলো দেখার মতো। ধানমন্ডি থেকে উৎসবে যোগ দিতে আসেন লাবণ্য কবির। তিনি বলেন, উৎসব আয়োজনে পুরান ঢাকার মানুষের জুড়ি নেই। আর সাকরাইনের আয়োজন শুধু পুরান ঢাকাতেই হয়। তাই বন্ধুদের সাথে প্রতিবছর এই দিন এখানে চলে আসি।


দিনভর ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব সবার জন্য উন্মুক্ত থাকলেও ডিজে পার্টিতে সবার প্রবেশাধিকার মিলে না। ডিজে পার্টিকে ঘিরে বিভিন্ন আয়োজন করেন মহল্লার তরুণরা। নির্দিষ্ট চাঁদার বিনিময়ে টোকেন সংগ্রহ করেন আগতরা। এরপর টোকেন দেখিয়ে প্রবেশ করতে হয় ডিজে পার্টির অনুষ্ঠানে। এতে নাচ-গানের পাশাপাশি থাকে বিভিন্ন খাবারের আয়োজন।


শিংটোলা পঞ্চায়েত মহল্লায় থ্রি স্টার বয়েজের উদ্যোগে চলে পার্টির আয়োজন। মহল্লার উদ্যোক্তা সজিব বিশ্বাস বলেন, পুরান ঢাকার উৎসব বলতে আমরা সাকরাইনকেই বুঝি। তাই সাকরাইন আসলে আমাদের মহল্লার তরুণদের নিয়ে আয়োজন করি। ফেসবুকে ইভেন্ট ছাড়ি, সেখান থেকে অনেকেই রেজিস্ট্রেশন করে। আবার আশপাশের মহল্লার বন্ধুরাও ঘুরতে আসে।

সাকরাইনের মূল উৎসবকে ঘিরে ধুপখোলা মাঠে ছিলো বিশেষ আয়োজন। মাঠের একপাশে জমে উঠে পিঠাপুলির আয়োজন। নানান বয়সী মানুষ এসে ভিড় করছেন পিঠার ভ্রাম্যমাণ স্টলগুলোতে। বিক্রেতারাও পিঠা বিক্রি করতে যেন হাঁপিয়ে উঠছেন।


এদিন বিকাল সাড়ে তিনটায় ধুপখোলা মাঠে সাকরাইন উৎসবের উদ্বোধন করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপস। এ সময় তিনি বলেন, আকাশে আজ শুধু ঘুড়ি আর ঘুড়ি। আমরা আনন্দিত ঐতিহ্যবাহী ধূপখোলা মাঠে প্রাচীনতম এই উৎসবে সমবেত হয়েছি। আমাদের কাউন্সিলরদের সহযোগিতায় আমরা এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। বাসা বাড়িতে অনেকে ঘুড়ি উড়াচ্ছে, সকলে মজা করছে। শিশুরা-যুবকেরা ঘুড়ি উড়াচ্ছে।

ঢাকা দক্ষিণের মেয়র বলেন, প্রায় ৩০ বছর পর নাটাই হাতে নিয়েছি। এই অনুভূতি প্রকাশ করার মতো না। ঢাকাবাসীর ঐতিহ্য আমরা ঢাকাবাসীর মধ্যে ফিরিয়ে দিতে চাই, শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বেড়ে ওঠে।

জানা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই পুরান ঢাকায় এ উৎসব চলে আসছে। হতে পারে এটা হাজার বছরের উৎসব বা তারও আগের। ১৭৪০ সালের দিকে মোঘল আমলে নায়েব-ই-নাজিম নওয়াজেশ মোহাম্মদ খানের আমলে ঘুড়ি উড়ানো এই দিনটি কেন্দ্র করে বর্তমানে সাকরাইন একটি অন্যতম উৎসব ও আমেজের পরিণত হয়েছে। ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ না রেখে সকলে এই উৎসব পালন করে থাকেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর