পরার্থে উৎসর্গিত হোক ঈদের আনন্দ

, ফিচার

মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 16:58:17

আনুমানিক শতবর্ষ আগে কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন ‘‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ/ মুমুর্ষ সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?'' কবিতা রচনার পটভূমি ছিল ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ব্রিটিশ-বাংলা। আজকের পটভূমিতেও কবিতাটি এতটুকু প্রাসঙ্গিকতা হারায় নি।

কারণ, একদিকে ঈদের আনন্দে ভাসছে মানুষ। আবার আরেকদিকেই চলছে চাপা হাহাকার। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির দ্বৈরথ তীব্রভাবে বিদ্ধ হয়েছে বহু মানুষে আনন্দ, উপভোগ, উৎসব ও উদযাপন।

অনেক উন্নতি ও প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির পরেও একথা সত্য যে সমাজে বৈষম্য কমেনি। সম্পদের বণ্টন সুষম হয়নি। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষের মধ্যে অনেকেরই স্বাভাবিক জীবনধারণ করতেই নাভিশ্বাস চলছে।

মুদ্রার আরেক পিঠে কেনাবেচা চলছে লাখ টাকার পাঞ্জাবি, বাহারি উপহার, অঢেল টাকাপয়সার সয়লাব। গণমাধ্যমের সংবাদে জানা গেছে, এবার ঈদ উপলক্ষে হরেক রকমের পাঞ্জাবি এসেছে। একেকটির দাম একেক রকম। কাপড়ের মধ্যেও আছে বিস্তর ফারাক। রাজধানীতে পোশাকের বিভিন্ন শোরুম ঘুরে একটিতে এমন একটি পাঞ্জাবি পাওয়া গেল, যেটির দাম ৭৯ হাজার টাকা। রাজধানীর গুলশান-১ নম্বরে এক ফ্যাশন ডিজাইনেট শোরুমে দেখা মিলল ‘সবচেয়ে দামি’ এই পাঞ্জাবির।

পলিনোজ জর্জেটের ওপর সূক্ষ্ম সেলাইয়ে জামদানির নকশা করা এই পাঞ্জাবি মাত্র একটি আনা হয়েছে। ‘আরোগ’ নামের একটি ব্র্যান্ডের জন্য এই পাঞ্জাবি তৈরি করা হয়েছে ভারতে। পাঞ্জাবির গায়ে থাকা মূল্য ৭৫ হাজার টাকা। তবে এর সঙ্গে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) যোগ করলে এটির মোট দাম দাঁড়ায় ৭৯ হাজার টাকা।

এমন এক পাঞ্জাবির টাকায় কয়েকটি পরিবারের মাসের খরচ চলে যাওয়ার কথা। বিশেষত সদ্য প্রবহমান দারুণ গরমে গ্রামবাংলার বিশাল কৃষকগোষ্ঠী যে নিদারুণ কষ্টে নিপতিত হয়েছে, তাদের কাছে এই গৌরবময় পাঞ্জাবির সংবাদ বজ্রাঘাত-সম। যে শ্রমিক ও দিনমজুর রোজার চরম কষ্টের পর সামান্য কটি টাকায় পরিবারপরিজনের মুখে ঈদ আনন্দের হাসি ফুটাতে লবেজান, তার কাছে দামি পাঞ্জাবির খবর তৃপ্তির বদলে কষ্ট বাড়ায়।

সামর্থ্যানুযায়ী মানুষ খরচ করবে, এতে কোনো অন্যায় নেই। কিন্তু সেই খরচ যদি হয় শুধুমাত্র আত্মসুখ কবলিত, তাহলে একটি নৈতিক চাপ থেকে যায়। বরং যে খরচে নিজের পাশাপাশি সমাজের বহু মানুষের মঙ্গল নিহিত থাকে, তেমন খরচই কল্যাণকর।

কবিতায় সবাই পড়েছি, "আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে/সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।" আরেকটি কবিতায় বলা হয়েছে, "আপনা রাখিলে ব্যর্থ জীবন সাধনা/ জনম বিশ্বের তরে পরার্থে কামনা।"

কবিতাগুলো এমনিতেই রচিত হয়নি। সামাজিক প্রয়োজনে ও মানবিক কল্যাণেই কবি আরো বলেছেন, "আত্মসুখ অন্বেষণে আনন্দ নাহিরে/বারে বারে আসে অবসাদ/পরার্থে যে করে কর্ম তিতি ঘর্ম-নীরে/সেই লভে স্বর্গের প্রসাদ।"

অতএব, পরার্থে জীবন উৎসর্গ করার মাধ্যমে মানবজীবন সার্থকতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সমাজের কল্যাণে নিজেদের নিঃশেষে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে আছে পরম সুখ, অনির্বচনীয় আনন্দ ও অপরিসীম পরিতৃপ্তি।

অন্যের উপকার সাধনই তাই সবার লক্ষ্য হওয়া উচিত। মানুষ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল বলে তাকে সমাজবদ্ধভাবে বাস করতে হয়। এজন্য পরস্পর প্রীতি ও ভালােবাসা, নির্ভরতা ও সহযােগিতার পরিবেশ মানুষ নিজের প্রয়ােজনেই সৃষ্টির গােড়া থেকে গড়ে তুলেছে।

শুধু পরিবার বা সমাজ নয়, রাষ্ট্র নয়, সমগ্র পৃথিবী ও রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং জাতিগােষ্ঠী পরস্পর সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য, নির্ভরতা ও সহযােগিতার মধ্যে বাস করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। কারণ একজন মানুষ যেমন সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে বাস করতে পারে না, তেমনি পৃথিবীর বৃহৎ মানবগােষ্ঠীও পরস্পর নির্ভরশীলতা ছাড়া বাস করতে পারছে না।

এমন একটি বৈশ্বিক সমাজে আমরা নিজেদের নিয়ে আত্মকেন্দ্রিকভাবে, শুধু নিজের সুখ-শান্তির কথা চিন্তা করে বাস করতে পারব না। প্রকৃতপক্ষে, মানুষ শুধু ভােগ-বিলাস ও স্বার্থের জন্যেই জন্মগ্রহণ করে নি। পরের কল্যাণে জীবনকে উৎসর্গ করার মাঝেই তার জীবনের চরম ও পরম সার্থকতা। ঈদের সময় এই মনোভাবই সবার মধ্যে জাগ্রত হোক। ঈদ মোবারক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর