গাছের ডালে ডালে পাতায় পাতায় যে পাখির প্রেম

, ফিচার

বিভোর বিশ্বাস, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট | 2023-09-01 13:38:50

পাহাড়ি বন-বনান্তরকে মুখর করে রাখে সে। চারদিকে কেবল তার ডাক আর ডাক! বিরামহীন সেই ডাক। প্রেয়সীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ক্লান্তহীন আহ্বান তার। মেয়ে পাখিটির প্রজননপ্রণয়ে বাঁধা না পড়া পর্যন্ত কিছুতেই থামে না ছেলেপাখির ডাক। সুমিষ্টি স্বরে বনান্তর মাতিয়ে রাখা এ পাখিটির নাম ‘দাগি-বসন্ত’।

বনের গাছে গাছে, ডালে ডালে কিংবা পাতায় পাতায় এভাবেই প্রকম্পিত হয় তার প্রেমধ্বনি।

সব বসন্তের মধ্যে দাগিবসন্তের গলা সবচেয়ে জোড়ালো। সব বনে গিয়ে প্রথমে দাগি-বসন্তের ডাক শুনেই আমার মনটা আনন্দে ভরে যায়। পাহাড়ি বনটাকে যেন ও সজীব-সতেজ করে রেখেছে। বন তো সাধারণত নীরব থাকে; কেমন যেন নীরবতা চারদিকে। কিন্তু ই দাগি-বসন্ত জোরে জোরে ডেকে সরগরম করে রাখে পুরো বন। সে ক্রমাগত ডেকেই যাচ্ছে, ডেকেই যাচ্ছে।

পাহাড়ি বনের উপকারী পাখি ‘দাগি-বসন্ত’। ছবি: ইনাম আল হক

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, এ পাখির ইংরেজি নাম Lineated Barbet এবং আমরা বাংলাদেশে একে ‘দাগি-বসন্ত’ বলি। ২৮ সেন্টিমিটারের এ পাখি আমাদের প্রতিটি পাহাড়ি বনেই রয়েছে। সে পুরোপুরি বনের পাখি। মাঝে মাঝে হয়তো বনের বাইরে বট বা পাকড়গাছে হঠাৎ এসে পড়ে। বনের পাশের যদি লোকালয়ে যদি কোনো বট গাছ থাকে তবে সেখানেও তাকে দেখা যায় তবে খুবই কম। মাথা এবং বুক হালকা খয়েরি রঙের। বুকের মাঝে লম্বা লম্বা সাদা দাগের জন্যই ‘দাগি’ বলা হয়। এজন্য ওর নামকরণ দাগিবসন্ত। ফলে পাখিটিকে মনে রাখাও সহজ।

‘দেখা সহজ নয়’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পাখিটি কিন্তু সহজ নয় দেখা, যদিও বড় পাখি। কারণ ওর রংটা গাছের পাতার সাথে একেবারে মিশে যায়। ওর মাথা এবং বুক শুধু হালকা খয়েরি। ওটাও চোখে পড়ার মতো রং নয়। আর বাকি পুরো শরীর সবুজ বলে ওর সারা গাছ ভরে থাকলেও আপনি ওকে সহজে দেখতে পাবেন না। কিন্তু আপনি যে কোনো পাহাড়ি বনে ঢুকার আগে এই দাগি-বসন্তের উপস্থিতির কথা সহজেই জানতে পারবেন। কারণ সে খুবই চিৎকার করে ডাকে। এই ডাকটা এক মাইল দূর থেকে পর্যন্ত শোনা যায়। এতো জোরে ডাকে! এতো জোরে ডাকা পাখি বাংলাদেশে খু্বই কম আছে। বিশেষ করে বনের পাখি তো নেই-ই। বনের পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে জোরে ডাকে আমার মনে হয় এই দাগি-বসন্ত। উঁচু গলা; তবে তীক্ষ্ম-কর্ষক নয়; বেশ মিষ্টি: ‘পুকুক-পুকুক-পুকুক’ -এ রকম করে ডাকতেই থাকে। বিশেষ করে এই প্রজননের সময় অনেক ডাকে; ফলে বন একেবারে সোরগোল করে মাতিয়ে রাখে এই একটি প্রজাতির পাখি।

বুনো ফল খেয়েই বনের সম্প্রসারণ করে ‘দাগি-বসন্ত’। ছবি: ইনাম আল হক

দাগি-বসন্তের প্রণয়ের দিক উল্লেখ করে এ পাখিগবেষক বলেন, ‘এই পাখিটি বনের গাছের উপরই নির্ভর করে তার জীবন। গাছের ফল যদি না থাকে; তাহলে সে বাঁচবে না। কারণ বুনো ফল ছাড়া সে কিছুই খায় না। সে কখনোই মানুষের লোকালয়ে বা মানুষের ক্ষেতখামারে কখনই ফলমূল খেতে আসে না। আর সে বাসাও করে গাছের কোটরে। প্রতি বছর সে নতুন করে একটা কোটর বানায়। পুরানো কোটরে সে বাসা করে না। কারণ কোটর বানানোর যে প্রক্রিয়া এটাই হলো ছেলে এবং মেয়ে দাগি-বসন্তে প্রণয়ের একটা অঙ্গ। তার মানে ও যদি নতুন কোটর না বানায় তাহলে মেয়ে দাগি-বসন্ত পাখিটি ছেলেটির প্রতি আকর্ষণ তৈরি হবে না। ওর হরমোন রিলিজ (নির্গমন) হবে না, ডিম তৈরি হবে না। গাছের কোটর বানানোটা প্রথমে শুরু করে ছেলে দাগি-বসন্ত। পরে মেয়ে দাগি-বসন্ত এসেও যোগ দেয়। সে শুরু না করলে মেয়ে পাখিটা আসবেই না। পরে মেয়ে পাখিটা ছেলে পাখিটর ক্রমাগত আহ্বানে সাড়া দিয়ে এসে কোটরের বাসাটি তৈরিতে শেষের কাজগুলো করে।’

এটা আমন্ত্রণের মতো ব্যাপার একটা। ওরা একে অপরকে হয়তো এভাবে বলে যে- ‘এই যে আমার সুন্দর বাসা। আসো জোড়া বাঁধি।’ কোটর তৈরির ৯০ শতাংশ কাজ পুরুষ দাগিবসন্তকেই করতে হয়। ওই সময়ই সে ক্রমাগত ডাকে। একটু গর্ত করবে; আবার ডাকতে শুরু করবে। আবার একটু গর্ত করবে; পুনরায় আবার ডাকতে আরম্ভ করবে। তাই কোটর বানাতে হবে। তার মানে এ বছরে যে কোটর বানালো সেই কোটরে সে আর বাসা করবে না। নতুন করে আরেকটা কোটর বানাতে হবে বলে জানান এই পাখিগবেষক ইনাম আল হক।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর