মায়াবী দ্বীপ, মনপুরা

, ফিচার

মনিরুল ইসলাম | 2023-08-31 17:12:02

১২ নভেম্বর ১৯৭০ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে হামলে পরলো ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার গতিবেগের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় গোর্কি। উপদ্রত এলাকা ঘুরে এসে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আঁকলেন বিখ্যাত এক ছবি “মনপুরা ৭০”। লোক চক্ষুর অন্তরালে থাকা এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হঠাৎ করেই খবরে চলে এলো ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহতা বিবেচনায়। হাল আমলে মনপুরা নামটি পরিচিত হয়ে উঠেছে গিয়াস উদ্দিন সেলিমের “মনপুরা” সিনেমার কল্যাণে। নানাকাজে দক্ষিণবঙ্গে যাত্রা কালে দূর থেকে অনেকবার দেখলেও কখনো ঘুরে দেখা হয়নি মনপুরা, জানা হয়নি দ্বীপটা আসলে কেমন?

মনপুরা যেতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। বেতুয়া বা হাতিয়াগামী যেকোনো লঞ্চে উঠলেই , সূর্য উঠার আগেই মনপুরা পৌঁছে দেয়। যদিও এযাত্রায় আমাকে কিছুই করতে হবে না। এবার যাচ্ছি অপু নজরুলের সঙ্গে, উনিই  সব ব্যবস্থা করে রাখবেন। অন্যের উপর ভর দিয়ে নিজে নির্ভার হয়ে ভ্রমণ করতে কেমন লাগে এরকম চিন্তা থেকেই উনার সাথে যাওয়া । দক্ষিণবঙ্গের সব যাত্রাই শুরু হয় সদরঘাট থেকে, মনপুরাও এর ব্যতিক্রম নয়। জ্যামের কথা চিন্তা করে সদরঘাটের নাম শুনলেই আগে মুখের মানচিত্র পরিবর্তন হয়ে যেত। তবে আমার বর্তমান অফিস পুরানো ঢাকায় হওয়াতে এযাত্রা ছিলাম চিন্তামুক্ত। রিক্সা করে হাওয়া খেতে খেতে অনুমিত সময়ের আগেই পৌঁছে গেলাম সদরঘাটে।

সদরঘাটের উল্টো দিকে

অনেক লঞ্চের ভিড়ে আমাদের জন্য নির্ধারিত লঞ্চ ফারহান-৩ খুঁজে পেতে সমস্যা হল না। সদর ঘাট আসলে মানুষ দেখে ভিরমি খেয়ে যেতে হয়, সবসময় হাটবার হাটবার ভাব বিরাজমান থাকে। নানা রকমের উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষ এখানে আসে। কেউ বা প্রিয়জনের সাথে মিলত হবার উৎকণ্ঠা নিয়ে দৌড় বেড়াচ্ছে, কেউ  এসেছে ব্যবসা কিংবা ভিক্ষা করতে, এমনকি অন্যের টাকা পয়সা হাতিয়ে  নেবার ধান্দায় আসা লোকের সংখ্যায় নেহাত কম হবার কথা না। যথা সময়ে নোঙর তুলে ভেঁপু বাজিয়ে চলতে শুরু করলো আমাদের লঞ্চ । ইতিমধ্যে এক ঝাঁক নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হল, চলল আড্ডাবাজি, একসঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে যার যার নির্ধারিত রুমে চলে গেলাম। প্লটুনে লঞ্চের ধাক্কায় যখন ঘুম ভাঙলো বাইরে তখন রামনেওয়াজ ঘাট। তখনও সূর্যের আলো পৃথিবীতে এস পৌঁছায়নি, তারপরও আমাদেরকে নেমে যেতে হলো কারণ লঞ্চের শেষ গন্তব্য হাতিয়ার তমরুদ্দিন ঘাট। মনপুরার প্রধান বাহন মোটর বাইক হলেও আমরা ব্যাটারি চালিত রিক্সা ধরে হাজির হাটে হাজিরা দিলাম। হাজির হাট হল মনপুরার প্রাণ কেন্দ্র। মনপুরা নামটার সঙ্গে কি মনের কোন সম্পর্ক আছে? কিভাবেই বা নামটা এলো?

যেকোনো স্থানের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন মত চালু থাকবে সেটাই স্বাভাবিক তার মধ্য থেকে গ্রহণযোগ্য বা সর্বাধিক প্রচলিত একটিকে বেছে নিতে হয়। কেউ কেউ বলে থাকেন মনগাজী নামের এক ব্যাক্তি ছিলেন যে কিনা বাঘের আক্রমণে নিহত হয়েছিলেন তার নামানুসরনে এই নাম। মনগাজী নামটা ঠিক থাকলেও ঐতিহাসিক বেভারিজ লিখেছেন অন্য কথা “ অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে, মনগাজী নামের এক ব্যাক্তি সেই সময়ের জমিদারি থেকে মনপুরা চর লীজ নেন । পরবর্তী সময়ে তার নামানুসারে এই দ্বীপটির নামকরণ করা হয় মনপুরা”। প্রায় আটশত বছরেরে পুরানো এই দ্বীপটিকে একসময় আরাকানী, মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুরা তাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যাবহার করত। কোম্পানি শাসনামলের বহু পূর্বেই পর্তুগিজদের আগমন ঘটে এই অঞ্চলে এবং পূর্বে সন্দীপ ও পশ্চিমে বাকলার মাঝখানে নিরাপদ বিবেচনায় তারা এখানে অবস্থান করত। মোগল আমলে সুবেদার শাহবাজ খান এই জলদস্যুদের বিদায় না করা পর্যন্ত তারা হামলা ও লুটতরাজ চালিয়ে যেতে পেরেছিল। যদিও পর্তুগিজ আমলের কোন স্থাপনার এখন আর কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। হয়তো জলোচ্ছ্বাস অথবা ঘূর্ণিঝড়ে সব নদীবক্ষে বিলীন হয়ে গিয়েছে। তবে পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত বড় লোময়ালা কুকুর এখনো দেখা যায়।

লবণ সহিষ্ণু ধান ক্ষেত

আমরা যখন হাজিরহাটে এসে পৌঁছলাম তখনও ভোরের আলো তার আলস্য ভাঙেনি। হোটেলে না ঢুকে চলে গেলাম মনপুরার আইকনিক ল্যান্ডিং স্টেশনে। দীর্ঘ জেটিটি মেঘনার বুক চিড়ে বেশ খানিকটা ভেতরে গিয়ে শেষ হয়েছে। এমনিতেই উত্তাল মেঘনা তার উপর নড়বড়ে এই জেটিটি ঢেউয়ের সাথে বুড়ো মানুষের দাঁতের মত এদিক সেদিক দুলছে। সেই দুলুনির সাথে সমান তালে বুকও কেঁপে উঠে। দৃষ্টিসীমা যতদূরে যায় শুধু পানি আর পানি । মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল আমি যেন নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। জেটিটি ব্যস্ত হয়ে উঠার আগেই আমরা ফিরে এলাম আমাদের হোটেলে ।

সকালের ল্যান্ডিং স্টেশন

আজকাল মনপুরাতে অনেক পর্যটক আসলেও থাকার জায়গার তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি। আমাদের একটা গ্রুপ উঠেছিলো হানিফ আবাসিক হোটেলে অন্য গ্রুপ উন্নয়ন সহযোগী কারিতাসের গেস্ট হাউসে। সবাই মিলে দুপরের পর রওয়ানা হলাম সাকুচিয়া সমুদ্র সৈকত যার কেতাবি নাম “দখিনা হাওয়া ”। অবারিত ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে পথ , আর পথের দুধারে বাবালা গাছের সাড়ি। ধাগাছগুলো  অবাক করার মত হলুদ, মাঝে মাঝে সরিষা বলে মনে হলে, মনকে দোষ দেওয়া যাবে না কারণ গাছের রঙটাই এরকম। সহজ সরল মানুষের ভালবাসা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু নিজের মত করে গড়তে চেয়েছিলেন দ্বীপটিকে। তাই অবকাশকালীন সময়ে চিত্তবিনোদন ও শান্তির জন্য মনপুরাতে চিন্তানিবাস স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিলেন। বর্তমান সরকার জাতির জনকের স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্যেগ নিলেও তার খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। রামনেওয়াজ বাজার সংলগ্ন বড় দীঘির পাশে বঙ্গবন্ধু চিন্তানিবাসের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিলো। যদিও সেই ভিত্তি প্রস্তরেরে কোন অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বর্তমান ভুঁইয়া হাট সংলগ্ন ব্রিজের পাশের স্থানটিতে চিন্তানিবাশ করার চিন্তা ভাবনা করছে সরকার।

দখিনা হাওয়া সমুদ্র সৈকত

সন্ধ্যার দিকে স্থানীয় বাজার দেখতে বের হলাম। ছোট কিন্ত আলোকিত এক বাজার।  জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ এখানে নেই তবে এক মেগাওয়াটের একটি জেনারেটর দিয়ে পুরো বাজার আলোকিত করা হয়েছে। এই অঞ্চলে মহিষের দুধের দই পাওয়া যায়। মজার ব্যপার হল সারা বাজার খুঁজেও মহিষের দুধের দই পেলাম না। যা পেলাম সবই গরুর দুধের। ঢাকা থেকে আসার পথে লঞ্চযাত্রায় ঘুম আসছিলনা। শত চেষ্টা করেও যখন কাজ হচ্ছিল না, তখন পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ করে নিদ্রাবিহীন রাত কাটিয়ে দিয়েছিলাম। তাই আজ একটু আগে ভাগেই রাত্রিবাসের ঠিকানার দিকে ফিরলাম। ফিরতেই রাতের খাবারের ডাক পরলো।

সম্মলিত প্রস্তাবের কারনে রাতের খাবারের পর আবার সবাই মিলে গেলাম ল্যান্ডিং স্টেশনে। বেশ বড় সাইজের একটি চাঁদ আকাশের সঙ্গে ঝুলে আছে। এখন কি পূর্ণিমা? নাকি দ্বীপের চাঁদ একটু বড়ই হয়?  কল্পনাতীত জ্যোৎস্নায় আলোকিত নদী বক্ষ। নদীতে তখন জোয়ার চলছে সম্ভবত। বড় ঢেউ নেই কিন্ত স্রোত আছে। বড় বড় ঢেউয়ের শব্দ নেই কিন্ত পানি বয়ে চলার নান্দনিক ছন্দ আছে। জেটির উপর গোল হয়ে সবাই বসে থাকলেও কারো মুখে কোন কথা নেই। চুপ করে থেকে সবাই যেন অন্যের অস্তিত্ব কে অস্বীকার করতে চাইছে। খানিকটা অনেক মানুষের ভিতরে থেকেও একাকীত্ব উপভোগ করা, যেন এখানে শুধু আমি আর কেউ নেই। সম্বিৎ ফিরে এলো বেরসিক এক ট্রলারের শব্দে। খানিকক্ষণ বাদে নিশিতে পাওয়া মানুষের মত নিঃশব্দে রওয়ানা হলাম মাথা গোজার ঠাইয়ের দিকে।

ভোর ৬ টায় বের হবো তাই রাতেই এক চাচাকে বলে রেখেছিলাম, যাতে করে পরিবাহনের সমস্যায় পরতে না হয়। হোটেলে থেকে বের হয়ে দেখি চাচা যথারীতি অপেক্ষা করে আছে। তখনও খাবার হোটেলগুলো খোলেনি , অগ্যতা নাস্তা না করেই ব্যাটারি চালিত রিক্সায় চেপে বসলাম আনন্দ বাজার ব্রিজের উদ্দেশ্য। ব্রিজের দুই পাশে অনেকগুলো সমুদ্রগামী ট্রলার সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পরার আগে বিশ্রাম নিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে যাবে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে তাই শেষ বেলার গোছগাছ চলছে। গ্যাসের সিলিন্ডার, বাজার সদাই ,খাবার পানি এমনকি মাছ ধরার জালের মেরামতির কাজও চলছে সমানতালে।

তুলাতলির চর

৭-৮ দিন পর ট্রলার ভর্তি রুপালী মাছ নিয়ে তীরে এসে নোঙর ফেলবে। মনপুরার মানুষ শুধু মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে তা কিন্তু নয়। সরকারের তথ্য বাতায়নের মতে উপজেলার ৬০ শতাংশ মানুষ মাছ ব্যবসার সাথে জড়িত। আবার এমনও তথ্যও দেয়া আছে যে ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী। লবণ সহিষ্ণু ধানের চাষ হওয়াতে কৃষি কাজে আগের চেয়ে বেশী মানুষ মনযোগী হয়েছে। লবণ সহিষ্ণু ধানের কারণেই পুরো উপকূল সোনালী হয়ে আছে।

মনপুরাকে কেন যে রুপালী দ্বীপ বলা হয়? এর উত্তর খুঁজে পায়নি। মনপুরা বা চর ফ্যাশন এই দিকটায় নদী দেখে যতটা ভয় লাগে সমুদ্র দেখলেও এতটা ভয় লাগে না আমার। ঠিক সেই ভয়াল দর্শন মেঘনার দেখা পেলাম তুলাতলির চরে এসে। আর একটু সামনে এগিয়েই মেঘনা তার সমস্ত রাগ-অনুরাগ নিয়ে সমুদ্রের বিলীন হয়েছে। জলরাশির ভয়ঙ্কর শব্দাবলী আর ঢেউয়ের উপর সূর্যের আলোর রুপালী ঝিলিক নিরাশ হতে দেয়নি। যতদূরে চোখ যায় শুধু জলরাশি। বেরিবাধের পাশে দুএকটা মাছ ধরা নৌকা বাধা। অদুরে ছোট একটা চায়ের দোকান আর দুটো বাড়ি। কতদিন ধরে আছেন এই বাড়িতে?

“বাজান বেশিদিন হয়নি।আর কতদিন বাস করতে পারবো তাও জানিনা” জিজ্ঞাসা করাতে শংকিত মনের উত্তর পেলাম কোনো এক নদীভাঙ্গা মানুষের।

এরকমই এদের জীবন,কতবার যে ভিটে পরিবর্তন করতে হয় দ্বীপের বাসিন্দাদের তার ইয়ত্তা নেই।একই বাড়িতে কতদিন বসবাস করতে পারবে এর বাসিন্দারাও জানে না। মেঘনা যতদিন চাইবে ততদিন!

এ সম্পর্কিত আরও খবর