উপমহাদেশ ভাগাভাগির ৭৫ বছর

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-30 17:08:54

১৯৪৭ সালের বাটোয়ারা শুধু সিরিল র‌্যাডক্লিফের তৈরি সীমারেখা নয়, ছিন্নমূল মানুষের মনেরও দ্বিধাদীর্ণ বিভাজন, দেশভাগ এবং ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা। মধ্য আগস্টে এতোগুলো রাজনৈতিক ঘটনার রক্তাক্ত ধারায় সংগঠিত হয়েছিল 'পার্টিশান', 'দেশভাগ' কিংবা 'বাটোয়ারা, যা দক্ষিণ এশিয়ার হাজার বছরের সভ্যতা ও মানববসতি তছনছ  করে এনেছিল এমন এক স্বাধীনতা, যাকে বিতর্কিত লেখক সালমান রুশদির ভাষায় বলা যায় 'মিডনাইট'স চিলড্রেন' বা 'মধ্যরাতের সন্তান'।

আক্ষরিক অর্থেই দেশভাগের পটভূমিতে মধ্যরাতের স্বাধীনতা প্রাপ্তিকালে সমগ্র উপমহাদেশ  জুড়ে এক অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। হিন্দুদের জন্য ভারত আর মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান- এমন ধারণা ও সিদ্ধান্ত রক্তারক্তির উপসংহারে বদলে দিয়েছিল ভূমি ও মানুষের ভাগ্য। গান্ধী তখন আশাহত। নেহেরু ও জিন্নাহ যথাক্রমে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পুরো শক্তিতে দেশভাগ ও বাটোয়ারায় মত্ত। কংগ্রেসের হাইকমান্ডের মধ্যে দুইজন মাত্র দেশভাগের বিরোধিতা করেছিলেন। একজন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এবং অন্যজন সীমান্ত প্রদেশের খান আবদুল গাফফার খান। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার আবেগে উন্মত্ত বৃহত্তর নেতৃত্বের কাছে তাঁদের মত ছিল সংখ্যালঘু।

তারপরের ঘটনা সবারই জানা। কয়েক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হলেন। দাঙ্গা ও হানাহানিতে নিহত হতে হয়েছিল হাজার হাজার অসহায় মানুষকে। নারী ও শিশুকে। যে কোনো যুদ্ধ ও দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারীরা। ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময়েও প্রচুর নারীকে নির্যাতিত হতে হয়েছিল প্রতিপক্ষের হাতে। শত শত বছর একই সাথে বসবাস করা মানুষগুলো রাতারাতি কীভাবে হিংস্র দানবে রূপান্তরিত হয়েছিল তা দেখে শুধু শান্তিপ্রিয় উপমহাদেশবাসী নয়, সদ্য ভারতত্যাগী ঔপনিবেশিক ব্রিটিশরাও দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিল।

ভাগাভাগি ও বাটোয়ারার সবচেয়ে বেশি দাম দিতে হয়েছে পাঞ্জাব, বাংলাকে। কারণ এ দুইটি প্রদেশও বিভক্ত অর্থাৎ ভাগ হয়ে পড়েছিল দুই দেশে। বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে এপার থেকে ওপারে, ওপার থেকে এপারে পাড়ি জমাতে হয়েছে লাখ লাখ মানুষকে। এদের অনেকেই হয়ে পড়েছিলেন ঠিকানাহীন। এক কোটিরও বেশি  মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়েছিল। লাখ লাখ মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে গিয়েছিল। অনেকে রাতারাতি রাজা থেকে ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল মানবতা। সে মৃত্যু, দেশত্যাগ, লাঞ্ছনা, অত্যাচার আর ভয়াবহ নির্যাতনের ক্ষত উপমহাদেশের রাজনীতি থেকে এখনো শুকায়নি। সেই অসভ্যতা, বন্যতা চিরস্থায়ী ক্ষত রেখেই ক্ষান্ত হয়নি, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে প্রায়শই দূষিত ও রক্তাক্ত করছে পুরো উপমহাদেশে এবং উপমহাদেশের বিভাজিত দুই জনপদ, ভারত ও পাকিস্তানকে।

১৯৪৭ সালে রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার ফলে সৃষ্ট চরম নির্মমতা, নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিলেন উপমহাদেশের মানবিক ও মুক্তমনা কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা। এসব ঘটনা নিয়ে রচিত হয় অনেক কবিতা, গল্প ও উপন্যাস। সে ভয়াবহ দাঙ্গার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন উর্দু সাহিত্যের কিংবদন্তিতুল্য লেখক কৃষণ চন্দর, খাজা আহমদ আব্বাস, সাদত হাসান মান্টো, রাজেন্দ্র সিং বেদী, আহমদ নাদিম কাসমী, ইসমত চুগতাই, রায়নাল কুদরউল্লাহ, অমৃতা প্রীতম প্রমুখ। বাংলা ভাষার পাঠকরা এই লেখকদের অধিকাংশের লেখার সঙ্গে পরিচিত।

১৯৪৭ সালের নির্মম,  নিষ্ঠুর পরিস্থিতি নিয়ে ভারতে কয়েকটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। এরমধ্যে সম্প্রতি নির্মিত 'পার্টিশান ১৯৪৭' একটি উল্লেখযোগ্য ছবি। ১৯৪৯ সালে মুম্বাইয়ে পরিচালক এম এন আনন্দ তৈরি করেন 'লাহোর' ছবিটি। এরপর বিজয় রায়ের পরিচালনায় মুক্তি পায় 'ক্যায়া দিল্লি ক্যায়া লাহোর'। এরপর সলিল সেনের 'নতুন ইহুদি' (১৯৫৩)  শান্তিপ্রিয় চট্টোপাধ্যায়ের 'রিফিউজি' (১৯৫৪)।  ঋত্বিক ঘটকই এই বিষয়টাকে তার তিন-তিনটি ছবিতে অত্যন্ত শিল্পসম্মত ভাবে ফুটিয়ে তোলেন। ছবি তিনটি, 'কোমল গান্ধার', 'মেঘে ঢাকা তারা' এবং 'সুবর্ণরেখা'। 

ঋত্বিকের পরে বেশ কিছু ছবি তৈরি হয়েছে দেশভাগকে কেন্দ্র করে। 'বিপাশা', 'আলো আমার আলো' ইত্যাদি ছবিতে দেশভাগ প্রসঙ্গ এসেছে। রাজেন তরফদার তার 'পালঙ্ক' ছবিতে দেশভাগের প্রসঙ্গটিকে চমৎকারভাবে নিয়ে আসেন।

তবে ইদানিংকালে নতুন করে দেশভাগকে কেন্দ্র করে ছবি তৈরির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গৌতম ঘোষের 'শঙ্খচিল', বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'কাঁটাতার', বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের 'তাহাদের কথা', সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের 'রাজকাহিনি' কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের 'বিসর্জন',  'বিজয়া' দেশভাগের ছবি।

১৯৪৭ সালের সেই অন্ধকার অধ্যায় ৭৫ বছর পেরিয়ে এলেও কিছুকাল আগে পর্যন্তও তথ্যনিষ্ঠ, লেখ্যাগার-নির্ভর/ আর্কাইভনির্ভর, তথাকথিত উচ্চমার্গীয় ইতিহাস দেশভাগজনিত ব্যথা, বেদনাবোধ এবং সর্বোপরি মানসিকতার ইতিহাস রচনার কলাকৌশল ঠিক আয়ত্ত করতে সমর্থ ছিল না। সুখের কথা, মহাফেজখানার দলিল-দস্তাবেজের বাইরে অন্য ধরনের তথ্যসূত্রের সাহায্যে এই মানবিক ট্র্যাজেডিকে ধরার প্রয়াসও শুরু হয়েছে ক্রমশ।

গবেষণার ধারায় ভাগাভাগি বা দেশভাগের গল্প বলতে গিয়ে কান্তি পাকড়াশির দ্য আপরুটেড (১৯৭১) উদ্বাস্তু মানুষের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেয়। ভারত ও পাকিস্তানে দুই পাঞ্জাবের উদ্বাস্তু মহিলাদের অভিজ্ঞতাকে উলটেপালটে দেখে সেই প্রয়াসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেন উর্বশী বুটালিয়া, রিতু মেনন, কমলা ভাসিনরা, আর প্রায় একই সময়ে জ্ঞানেন্দ্র পান্ডেও তার লেখায় বলেন যে, "দেশভাগের আগুনে দগ্ধ হয়েছেন এমন মানুষদের দৃষ্টিকোণ থেকেই খুঁজে পেতে হবে দেশভাগের অন্যতর মানবিক ইতিহাস।"

মৌলিক গবেষণার বাইরে স্মৃতিকথাকে ভিত্তি করে উদ্বাস্তুদের ইতিহাস লিখলেন নীলাঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, যশোধরা বাগচি, শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত, প্রফুল্ল চক্রবর্তী, দীপেশ চক্রবর্তী প্রমুখ। জয়া চ্যাটার্জি রচনা করেছেন দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িকতার রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত।

এভাবেই তৈরি হওয়া দেশভাগের বিভিন্ন প্রান্ত ও পর্বের ইতিহাসচর্চার সঙ্গে স্মৃতিকথনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কসূত্রের ধারায় আনাম জাকারিয়া নামের এক তরুণী হারপার-কলিন্স থেকে প্রকাশ করেছেন একটি গবেষণাগ্রন্থ, যার নাম দ্য ফুটপ্রিন্ট অব পার্টিশান, যাতে ১৯৪৭ সালের পর চার প্রজন্মের স্মৃতি-সত্তা-অভিজ্ঞতায় বিভাজনের নানা দাগ ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আন্তরিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

১৯৪৭ সালে বাটোয়ারা ও ভাগাভাগিতে প্রাপ্ত ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তি অবশ্যই সেসব দেশে উদ্‌যাপন করার মুহূর্ত, কিন্তু একই সঙ্গে দু’দণ্ড থমকে দাঁড়িয়ে এটাও ভাবা প্রয়োজন যে, এতটা পথ পেরিয়ে আসতে গিয়ে কোন কাজগুলো ঠিক, আর কোনগুলো ভুল হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আজ উপমহাদেশ একটা পথসন্ধিতে দাঁড়িয়ে— রাজনীতির মেরুকরণ সম্পূর্ণ, সাম্প্রদায়িকতার বাড়বাড়ন্ত।  সমাজে তার ছাপ প্রকট, অর্থব্যবস্থা গতি হারিয়েছে এবং একই সঙ্গে চড়া বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি চলছে।

উপমহাদেশের এই সর্বব্যাপী অস্থিরতা কি নতুন উচ্চতায় পৌঁছনোর জন্য যাত্রা শুরু করার প্রাক্‌মুহূর্ত, না কি এ এক পতনের সূচনালগ্ন? পঁচাত্তর বছরের অভিজ্ঞতার প্রান্তে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো নিয়ে স্ব স্ব দেশের নেতৃত্ব ও নীতিপ্রণেতারা  নিশ্চয় ভাববেন। স্বীয় ইতিহাস বিশ্লেষণ করে অতীতের সূত্র ধরে বর্তমানের চ্যালেঞ্জগুলোকেও বোঝার চেষ্টা করবেন। তাতে ভবিষ্যতের পথটি আবার কালো, রক্তাক্ত, বিভাজিত অন্ধ-গহ্বরের বদলে আলোর দিশা পেতে পারবে।

যখন নেতৃত্বের লালসা, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, ক্ষমতার মোহ, ধর্মীয় মেরুকরণ, সাম্প্রাদায়িকতার রণহুংকার উপমহাদেশের উদার, বহুমাত্রিক, ধর্ম ও সমাজের মানবিক যাত্রাকে গতিরোধ করে দাঁড়াচ্ছে; বাক্‌স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, আইনের শাসন ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে; সংখ্যালঘু-দলিত-ভিন্নমত প্রতিনিয়ত আক্রান্ত, কোণঠাসা ও প্রান্তিক অবস্থানে চলে যাচ্ছে; তখন গণতন্ত্র, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, আইনের শাসন ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সমুন্নত রাখা এবং জাত-পাত ও ধর্মীয় বিভাজন, জাতিভেদ প্রথা দূর করার আন্তরিক ও সম্মিলিত প্রচেষ্টাই অপরিহার্য। ১৯৪৭ সালের ভাগাভাগি, বাটোয়ারা ও সহিংস বিভাজনের প্রতিধ্বনি প্রগতি, মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের জন্য মোটেও সহায়ক ও কল্যাণকর হয় নি এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের কখনোই হতে পারে না, ৭৫ বছরের ইতিহাস এই সত্যেকেই সত্যায়িত করছে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর