বাবা নাই, কষ্ট এটাই!

, ফিচার

কবির য়াহমদ | 2023-08-31 18:25:03

 

এবারের বাবা দিবসের এক সপ্তাহ আগে ছিল আমার বাবার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিক। বাবা নামের যে আকাশ সমান ছায়া তার অনুপস্থিতি টের পাচ্ছি গত তিন বছর ধরে। ২০১৯ সালের জুন। ক্যালেন্ডারের হিসাবে দিনটা ছিল শুক্রবার, ১৪ তারিখ। বিকালে আমার বাবা যাকে আমরা ‘আব্বা’ বলে ডাকতাম তিনি শেষ ঘুমে মগ্ন হয়েছিলেন। শেষ ঘুমের আগে প্রকৃতির নিয়মে জাগতিক অনেক ঘুমে যেতেন তিনি। আমরা কেউ জানতাম না সেদিনের সেই ঘুম ছিল তাঁর শেষ ঘুম। আগের দিন থেকেই তীব্র জ্বর ছিল তাঁর। খানিক বিরতি দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন, জেগেও ওঠছিলেন। কিন্তু শুক্রবারের দুপুরের পর থেকে যে ঘুমে মেতেছিলেন তার পর থেকে আর জাগেননি। এই ঘুমের সময়েই তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছিলেন। বারবার তাঁর শরীরের তাপমাত্রা মাপতে এসে একটা সময়ে টের পেলাম সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তাঁর। জাগাতে চেয়েও পারিনি। শেষমেশ যখন তীব্র ঠান্ডা জমেছিল তাঁর শরীরে তখন পায়ের তলার মাটিগুলো সরে গিয়েছিল আমার, আমাদের।

বাবাহীন হতে পারি আমরাও—এমন ভাবনা তাঁর অসুস্থ হওয়ার ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়লেও বিপদ ভেবে সেটা দূরে সরিয়ে রাখছিলাম। কেন আমরা বাবা-হারা হবো; আমাদের কী বাবার আশ্রয়ের দরকার নেই—এমন ভাবনায় তাঁর কাছাকাছি থেকেছিলাম শেষ কবছর। এর মধ্যিখানে কোথাও জরুরি প্রয়োজনে গেলেও তিনি ফোন দিয়ে ‘কখন ঘরে ফিরছি’ এমনটা জানতে চাইতেন বারবার। সন্ধ্যা হলেই এমন হতো নিয়মিত। ফিরে এসে খোঁজ করার কারণ জানতে চাইলে প্রতিবারই বলতেন—‘ঘরে থাকলে ভরসা পাই, মনে শক্তি পাই’। প্রথম প্রথম একথাগুলোর গুরুত্ব বুঝতে না পারলেও একটা সময়ে বুঝতে পারি কতটা ভরসা আর ভালোবাসা থাকলে এমন প্রশ্ন, কাছে রাখার এমন আকুতি ঝরত তাঁর। স্বজনদের কাছ থেকে শুনেছি এবং ছেলেবেলার যতটুকু মনে পড়ে আব্বা আমাকে ‘অন্ধের যষ্টি’ বলে ডাকতেন। এ কারণেই বুঝি সেই ছোটকালের যে স্বপ্ন বড়কালেও এসে সেটার ছাপ রয়ে গিয়েছিল পুরোটাই, যদিও জানি অন্ধের যষ্টি হওয়ার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি আমি।

আব্বার একাধিকবার স্ট্রোক করেছিলেন, হাই ব্লাড প্রেসার ছিল, কোলেস্টেরল সমস্যা ছিল, হার্টে রিঙ পরানো ছিল তাঁর। শেষ সময়ে এসে মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগে থেকে কিডনিজনিত রোগ ছিল। ওটাই ভুগিয়েছে তাঁকে। ঢাকায়-সিলেটে একাধিকবার তাঁর কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হয়েছিল। শেষবার যখন হাসপাতালে ছিলেন তখন ১০ দিনের বেশি সময় ছিলেন আইসিইউতে। আইসিইউতে থাকাকালে ওই ইউনিটে সবসময় ঢোকা যেত না, বাইরে পায়চারি করতাম। রাতের পর রাত ঘুমহীন থেকে থেকে তাঁর সামান্য চোখ মেলার অপেক্ষা করতাম। সামান্য নড়লে-চড়লে মনে হতো প্রাণ ফিরেছে আমারও দেহে। আইসিইউ থেকে কেবিনে নেওয়ার পর সামনাসামনি থাকার সুযোগ হয়েছিল। অসুস্থ তবু মনে শান্তি ফিরত, সামনে ত আছেনই। এরপর বাড়িতে নিয়ে আসার সময়ে মনে হচ্ছিল যেন যুদ্ধজয় করে ফিরছি। তাঁর চিকিৎসাকালে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের করার কিছু ছিল না, কিন্তু ফিরিয়ে নিয়ে আসার সময়ে সত্যি সত্যি যুদ্ধজয়ের সেনাপতি ভাবছিলাম। এভাবে কয়েকবার, বেশ কয়েকবার। প্রতিবারই একই অনুভূতি হতো।

আব্বাকে প্রতিদিন একগাদা ওষুধ খেতে হতো। ডা. ফয়সল আহমদ, ডা. নাজমুস সাকিব, ডা. আবদুল লতিফ রেণুসহ অনেক চিকিৎসক আব্বাকে চিকিৎসা দিয়েছেন। বিভিন্ন সময় হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর যখনই দরকার পড়েছে চিকিৎসকবন্ধু ডা. এনামুল হক এনাম, ডা. আলিম আল রাজি, ডা. সুমন দে, ডা. জোবায়ের আহমেদদের কাছে নানা পরামর্শ পেয়েছি। তাদের কারণে মনে হতো আমার আব্বা পুরোটা সময়ই আছেন চিকিৎসকের পরামর্শাধীন। তাদের সকলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই।

আমার আব্বার সঙ্গে আমার ছেলে রাইআনের দুরন্ত সম্পর্ক ছিল। কিডনি রোগ তাই টক জাতীয় কিছু খেতে ডাক্তারের বারণ ছিল। তবু মাঝে মাঝে দেখতাম আব্বা আর রাইআন দুজনে মিলে আমের আচার, বরইয়ের আচারসহ বিবিধ আচার খাচ্ছেন। দাদা-নাতির এই আচার খাওয়ার সময়টাতে অনেকবার বাধা দিয়েছি মূলত চিকিৎসকের পরামর্শের কারণে। আব্বা রাইআনকে ‘দাদা’ সম্বোধনে ডাকতেন। রাইআন যখন খুব ছোট ছিল তখন তার সামান্য কান্নাতে আব্বা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন। রাইআনের খাবারদাবারের সমস্যা হচ্ছে কি-না এনিয়ে সতর্ক দৃষ্টি ছিল তাঁর। রাইআনের দুধসহ খাবারদাবারের টাকাগুলো আব্বাই দিতেন। সময়ে সময়ে জিজ্ঞেস করতেন তার কিছুর দরকার কি না, আবার সামান্য অথচ বাচ্চাদের স্বাভাবিক কান্নাকাটিতেও ভাবতেন তার বুঝি খাবারদাবারের সঙ্কট! স্কুলে ভর্তির টাকা তিনিই দিয়েছিলেন। রাইআন-আয়ানের মাসে-মাসে স্কুলের বেতনের টাকা তিনিই দিতেন। এত বেশি কেয়ারিং ছিলেন তাদের প্রতি।

আব্বা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বঙ্গবন্ধুর সময়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন, ছিলেন সাবেক জনপ্রতিনিধি। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-মসজিদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তাঁর। ছিলেন সালিশ ব্যক্তিত্ব। নিজেদের উপজেলাসহ আশপাশের এলাকার মাঝেও পরিচিত ছিলেন তিনি। যেকোনো প্রয়োজনে এলাকায় কিংবা দূরে কোথাও গেলেও মুরুব্বিদের কারও সঙ্গে দেখা হলে এলাকার নাম বললে স্বাভাবিক প্রশ্ন ছিল—‘আজিজ উদ্দিন চৌধুরী ভাইস চেয়ারম্যান সাহেবের কিছু হই কি-না?’ পরিচয় দেওয়ার পর বিভিন্ন এলাকার মানুষদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি সেটা ভুলার মত নয়। এগুলো আদতে অর্জন। আব্বা নেই আজ তিন বছরের বেশি সময় হয়ে গেছে, অথচ সেই একই পরিচিতি, একই ভালোবাসা আমরা পেয়ে যাচ্ছি। এগুলো দেখে মনে হয় আব্বা দৈহিকভাবে হয়ত নেই কিন্তু তাঁর পরিচিতি এখনও রয়ে গেছে। এগুলো দেখে একদিকে গর্ব হয়, আবার অন্যদিকে নিজেকে পিতৃহীন ভেবে বুকটা হাহাকার করে ওঠে! এই হাহাকারের যন্ত্রণা যে কতটা ভারী সেটা ঠিক ঠিক টের পাই; আমি নিশ্চিত জগতের অধিকাংশ পিতৃহীনেরাই টের পায়।

আব্বা খেলাধুলা-ভক্ত ছিলেন। দেশে যখন ক্রিকেট এত বেশি জনপ্রিয় ছিল না, তখন টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখালে সেগুলো দেখতেন। আমরাও তাঁর সঙ্গী হতাম। ফুটবলের প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল তাঁর। রাত জেগে বিশ্বকাপের খেলাও দেখতেন। টেলিভিশনে খেলার আওয়াজ শুনলে যোগ দিতেন আমাদের সঙ্গে। পত্র-পত্রিকা পড়তেন, বইপত্র পড়তেন। সে কারণে ছোটবেলা থেকে বইয়ের প্রতি আমাদের অনুরাগও জন্মেছিল। আব্বা মারা যাওয়ার পর এবার প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল আসছে। এবার খেলাগুলো দেখা হবে না তাঁর। ব্রাজিল যদি বিশ্বকাপ জেতে সে সংবাদও জানা হবে না তাঁর!

সিলেট ভাসছে বানের জলে। আব্বার জীবদ্দশায় একাধিকবার আমরা বন্যা আক্রান্ত হয়েছিলাম। ১৯৯১ সালের বন্যায় আমাদের ঘরে পানিও উঠেছিল। তিন-রুমের পুরনো সেই ঘর এখন নেই। সে ঘরের কেবল একটি রুম ছাড়া বাকি দুই রুমে পানি উঠে পড়েছিল। সেই বন্যায় গাদাগাদি করে আমরা থেকেছিলাম সবাই একটা মাত্র ঘরে। চারদিকে পানি, উঠানে পানি; আব্বা খাবারদাবার নিয়ে আসতেন নৌকায় করে। সেই স্মৃতি এখনও ভাসে। ভাসে পরম মমতার এক পিতৃছবি যেখানে সন্তান এবং সন্তানের হাসিই মুখ্য। দেশের নানা দুর্যোগ-দুর্বিপাকে আব্বা এলাকার মানুষদের সহায়তা দিতে আমাদের ভাইবোনদের উদ্বুব্ধ করতেন। দেশের বাইরে থাকা তাঁর সন্তানদের বলতেন কিছু করতে। তারা কখনই তাঁকে হতাশ করেনি। টাকা হাতে এলে ডেকে এনে দিতেন, অথবা আমাদের কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন। তাঁর মৃত্যুর পর এখনও মানুষ সে স্মৃতি রোমন্থন করে। আব্বার মৃত্যুর পর আমাদের ভাইবোন ও বোনদের স্বামীরা মিলে প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা জমা রাখে। বেশ কিছু টাকা একত্র হলে সেগুলো দেশে পাঠায় মানুষের জন্যে। মানুষকে ভালোবাসার-সহায়তা করার আব্বার যে চেষ্টা সেটাই ধরে রাখা উদ্দেশ্য আমাদের।

আমরা বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চলের মানুষ বলে ঝড়বৃষ্টি নিয়মিত ঘটনাই। টিনের চালে ঝড়ের ধাক্কা লাগত নিয়মিত। ঝড় শুরু হলেই আব্বা আমাদের সাত ভাইবোনকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন। আমরা সবাই তাঁর কাছে গিয়ে আশ্রয় নিতাম। ঝড়ে তাঁর ছিল প্রচণ্ড ভয়, তাই ওই সময়টা সবাইকে একত্র করতেন; ঘুম থেকে তোলে হলেও! এখনও ঝড় হয়, কিন্তু আগের মতো সেভাবে টের পাই না, আগের মতো কেউ আর ঝড়ে অভয় দিতে ডেকে তোলে না!

আজ বাবা দিবস। দেশে দেশে আছে এর দিবসী আয়োজনও। দিবসী এসব আয়োজন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যত মত-প্রতিমতই থাকুক না কেন ‘বাবা’ শব্দটাই স্বতন্ত্র আবেগের, নির্ভরতা আর আশ্রয়ের। ২০১৯ সালের ১৪ জুন আমার বাবা, আমার আব্বাকে হারিয়ে আমি এবং আমরা যে নির্ভরতা আর আশ্রয় হারিয়েছি সেটা অব্যাখ্যেয়। বাবাকে হারানোর সোয়া দুইবছরের মাথায় আম্মাকেও হারিয়েছি ২০২১ সালের ২ নভেম্বর; অনেক কিছু থাকা আমাদের ঘরে মা নেই, বাবা নেই—এরচেয়ে কষ্টের আর কিছু থাকতে পারে না!

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক, ইমেইল: kabiraahmed007@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও খবর