প্রাচীন বাংলার পাল শাসনের ইতিবৃত্ত

, ফিচার

মো. তাহমিদ হাসান | 2023-09-01 16:43:27

শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলায় ১১৯ বছরের মৎস্যন্যায়ের যুগের পতন ঘটিয়ে ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে আর্বিভূত হন পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল। পালদের উত্থানের গল্প অধিকাংশ মানুষের জানা হলেও পালবংশের ৪০০ বছর শাসনের মধ্যে প্রায় ৯৪ বছর পরেই তাদের অবনতি গল্প খুব কম সংখ্যক পাঠকেই জানেন।

পালবংশের শক্তিশালী রাজাদের নাম আসলেই গোপাল, ধর্মপাল, দেবপালের নাম চলে আসে। পালদের তাম্রশাসন থেকে তাঁদের কৃতিত্ব কথা জানা যায়। কিন্তু দেব পালের পরেই পালদের সাম্রাজ্যের ক্রমাগত অবনতি শুরু হতেই থাকে।

পালদের অবনতি

ধর্মপালের ছেলে দেবপালের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসা নিয়ে মতবিরোধ তৈরি হয়। বাদল স্তম্ভলিপিতে শূর পালের নাম ও নারায়ণপালের ভাগলপুর তাম্রশাসনে বিগ্রহপালের নাম পাওয়া যায়। বিগ্রহপাল ছিলেন জয়পালের পুত্র এবং ধর্মপালের ভ্রাতা বাকপালের পৌত্র। কিন্তু অধিকতর ঐতিহাসিক শূরপাল ও বিগ্রহপালকে অভিন্ন মনে করেন। আবার কিছু ঐতিহাসিক দেবপালের মৃত্যুর পরে উত্তরাধিকার যুদ্ধের কথাও অনুমান করেন। ৮৬১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিগ্রহ পাল সিংহাসনে বসার পর মাত্র ৪ অথবা ৫ বছর রাজ্য পরিচালনা করেন।

বিগ্রহপালের মৃত্যুর পর অত্যন্ত দুর্বল ও শান্তিপ্রিয় শাসক নারায়ণ পাল সিংহাসন আরোহন করেন। ভাগলপুরের তাম্রশাসনে নারায়ণ পালের পিতা প্র. বিগ্রহপালের শান্তিপ্রিয় ও সংসারবিরাগীর কথা উল্লেখ ছিল। ঠিক তেমনি নারায়ণপালের স্বাভাব তার পিতা প্রথম বিগ্রহপালের মতোই ছিল। বাদল স্তম্ভলিপি বা তাঁর নিজস্ব ভাগলপুরের তাম্রশাসনে তাঁর সময়ে সাফল্যের কথা উল্লেখ নাই। রাষ্ট্রকূট রাজা দ্বিতীয় কৃষ্ণ পাল রাজ্যে আক্রমণ করেন কিন্তু রাষ্ট্রকূট রাজা বিজয়ের ফলেও কোনো অংশ রাষ্ট্রকূট রাজ্যের ভুক্ত হয়েছিল বলে মনে হয় না। তার সময়েই প্রতীহার রাজাদের আক্রমণের ফলে পাল সাম্রাজ্যের যথেষ্ট সংকোচন হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। নারায়ণপালের পাশাপাশি সময়ে দক্ষিণ ও পূর্ব বাংলায় স্বাধীন রাজবাংশের উত্থান ঘটে। নারায়ণপালের ১৭ বছর রাজত্ব পাল সাম্রাজ্য পশ্চিম বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

নারায়ণ পালের মৃত্যুর পর ৯০৬ খ্রিস্টাব্দে তার পুত্র রাজ্যপাল সিংহাসন আরোহন করেন। তার রাজত্বকালে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু তিনিও তাঁর অদূরদর্শিতার কারণে পাল সাম্রাজ্যের পতনরোধ করতে পারেনি।

নারায়ণ পালের মৃত্যুর পর ৯৪০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় গোপাল সিংহাসনে বসেন। তার শাসনামলে বিজয়ের কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি কিন্তু তার সময়ে বৈদেশিক আক্রমণ ঘটে। জানা যায়, চান্দেল্লরাজ যশোবর্ম পরবর্তীতে তার পুত্র ধঙ্গা দ্বিতীয় গোপালের সময় পাল সাম্রাজ্যে আক্রমণ ও লুণ্ঠন চালান। একই সময়ে কুলচুরি রাজবংশ পাল রাজ্যের উপর আক্রমণ চালায়। দুর্বল পাল রাজারা এইসব বিদেশি আক্রমণ প্রতিহত করতে পারেনি।

দ্বিতীয় গোপালের রাজত্বে শেষের দিকে ও দ্বিতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বে প্রথমদিকে যখন পাল সাম্রাজ্য বৈদেশিক আক্রমণে জর্জরিত, সেই সময়ে পাল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে, উত্তর ও পশ্চিম বাংলায় কম্বোজ বংশের অভ্যুত্থান ঘটে। বাইরে থেকে এসে ক্ষমতা দখল করেছিল এমনটি নয়, কম্বোজদের অভ্যুত্থান পালরাজাদের মধ্য হতেই ঘটেছিল। কম্বোজদের ক্ষমতা দখলেই প্রমাণ করে পাল সাম্রাজ্যের দুর্বলতার কথা।

কম্বোজ রাজবংশ

লুসাই পর্বতের নিকটবর্তী বঙ্গ ও ব্রহ্মদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে কম্বোজ জাতির কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার তিব্বতীয়েরা কোনো কোনো গ্রন্থে কম্বোজ নামে অভিহিত হয়েছে। আবার অনেকে মনে করেন কোচ জাতিই প্রাচীন কম্বোজ জাতির বংশধর। কম্বোজরা যে বাইরে থেকে এসে পাল বংশে আধিপত্য বিরাজ করেনি তা প্রমানিত। ধারণা করা হয় কিছু কম্বোজ বংশের লোক পাল বংশের রাজকার্যে নিয়োজিত ছিল। যখন পালবংশ দুর্বল হতে শুরু করে ঠিক তখনই কম্বোজরা ক্ষমতা দখল করেন। দুইটি লিপি থেকে উত্তর ও পশ্চিম বাংলায় কম্বোজদের রাজত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। দশম শতাব্দীর প্রথম দিক থেকেই তাদের এই উত্থানের শুরু এবং শতাব্দীর মাঝমাঝি সময় পর্যন্ত তাদের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। তিনজন রাজার নাম ছাড়া কম্বোজ রাজবংশের অন্যকারো শাসন সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।

পুনরায় পাল বংশের উত্থান

দশম শতাব্দীতে পাল সাম্রাজ্য যখন ধংসের দিকে তখনি আবির্ভাব ঘটে দ্বিতীয় বিগ্রহ পালের পুত্র প্রথম মহীপালের। প্রথম মহীপাল পিতার মতো অযোগ্য শাসনকর্তা ছিলেন না। তিনি ধর্মপাল, দেবপালের মতো দ্বিগবিজয়ী ছিলেন। সিংহাসন আরোহন করার পর তিনি পূর্বপুরুষের হারানো যাওয়া রাজত্ব পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন।

প্রথম মহীপালের ৫ম রাজ্যাঙ্কের বেলওয়া তাম্রশাসন ও ৯ম রাজ্যাঙ্কের বানগড় তাম্রশাসনে পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধারের কথা উল্লেখ আছে।

তাম্রশাসনটিতে বলা হয়েছে, "মহীপাল রণক্ষেত্রে বাহুদর্প প্রকাশে সকল বিপক্ষ পক্ষ নিহত করে অনধিকারী কতৃক বিলুপ্ত পিতৃরাজ্যের উদ্ধার সাধন করে রাজাগণের মস্তকে চরণপদ্ম সংস্থাপিত করে অবনীপাল হয়েছিলেন।"

সেই সময়ে কম্বোজরা উত্তর পশ্চিমের আধিপত্যে ছিলেন। সেই সময় প্রথম মহীপাল কম্বোজদের যুদ্ধে পরাজিত করে পিতৃরাজ্য উদ্ধার করতে সক্ষম হন। প্রথম মহীপালের বড় কৃতিত্ব তিনি পাল সাম্রাজ্যকে আসন্ন বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সেই সাথে ভারতের প্রবল দুই শক্তি চোল ও কলচুরিগণের হাত থেকে তিনি বাংলার স্বাধীনতা ও সার্বোভৌমত্ব রক্ষা করেছিল।

ইতিহাস সাক্ষী কোনো রাজ্যের উত্থানের পর কোনো না কোনো মাধ্যমে পতন ঘটেছিল৷ পালদের দীর্ঘ ৪০০ বছরের ক্ষমতার মধ্যে সাময়িক পতনের দিকে পাল সাম্রাজ্য ঝুঁকে গিয়েছিল। প্রথম মহীপালের কর্তৃক সেই যাত্রায় পাল বংশ পুনরায় উত্থান বা সাম্রাজ্যে ফেরত এসেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে পালদের প্রায় ৫০ বছর ধরে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও বহিঃশত্রুর আক্রমণের ফলে পুণরায় পতনের দিকে ধাবিত হয়৷ দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলার প্রায় ৪০০ বছর ধরে চলা পাল সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পতন ঘটে।

মো. তাহমিদ হাসান, শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এ সম্পর্কিত আরও খবর